বৌদ্ধ ধর্মের মূলকথা, চার আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, শীল এবং ধর্মগ্রন্থ
বৌদ্ধ ধর্মের মূলকথা, চার আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, শীল এবং ধর্মগ্রন্থ
ক্লাসের আলোচ্য বিষয়:
Ø
বৌদ্ধ
ধর্মের মূলকথা কী?
Ø
বৌদ্ধধর্ম
যে ‘চার আর্যসত্যে’ বিশ্বাসী সেগুলো কী কী? আলোচনা করুন।
Ø
অষ্টাঙ্গিক
মার্গ কী?
Ø
শীল
কী?
Ø
বৌদ্ধদের
প্রধান ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে ধারণা দিন।
বৌদ্ধ ধর্মের মূলকথা কী?
জীবন সংগ্রামে প্রতিনিয়ত মানুষকে দুঃখ, জরা, ঘাত-প্রতিঘাত, সীমাহীন যন্ত্রণা ইত্যাদি কষ্টের মধ্যে লড়াই করে চলতে হয়। দুঃখ মানবজীবনের অন্যতম সমস্যা। মানবজীবনে সুখের চেয়ে দুঃখই সবচেয়ে বেশি যা বুদ্ধ চারিনিমিত্ত দর্শনেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দুঃখের উপলব্ধি থেকেই গৌতম বুদ্ধ সংসার ত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, যেহেতু দুঃখ আছে সুতরাং দুঃখকে জয় করার উপায়ও আছে। তাই দুঃখকে জয় করার উপায় হিসাবে তিনি চারটি আর্যসত্য দর্শনের কথা বলে গেছেন সেটাই বৌদ্ধ ধর্মের মূলকথা। তার প্রচারিত বৌদ্ধ ধর্ম হলো এক ধরণের বিশ্বাস ও জীবন দর্শন।
আর্যসত্য হলো বৌদ্ধধর্মের মূলকথা। গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত একটি ধর্ম বিশ্বাস
এবং জীবন দর্শন। বৌদ্ধ ধর্ম আপাত অর্থে জীবন দর্শন। অনুসারীদের সংখ্যায় বৌদ্ধধর্ম
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম।
বৌদ্ধধর্ম যে ‘চার আর্যসত্যে’ বিশ্বাসী সেগুলো কী কী? আলোচনা করুন।
আর্যসত্য
হলো বৌদ্ধধর্মের মূলকথা। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হলো চার আর্যসত্য।
এ সম্পর্কে বুদ্ধ বলেন- ‘চতুরার্য সত্য ব্যতীত আর কোনো ধর্ম নেই’ ।
‘চার আর্যসত্যে’ হলো:
১. দুঃখ,
২. দুঃখ সমুদয়: দুঃখের
কারণ,
৩. দুঃখ নিরোধ: দুঃখ
নিরোধের সত্য, এবং
৪. দুঃখ নিরোধ মার্গ: দুঃখ
নিরোধের উপায়।
১। দুঃখ:
দুঃখ
ছিল, আছে এবং
থাকবে এটাই চিরন্তন সত্য। গৌতম বুদ্ধ ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্রে দুঃখকে ৮টি
পর্যায়ভুক্ত করেছেন। যেমন-
১) জন্ম দুঃখ,
২) জরা দুঃখ,
৩) ব্যাধি দুঃখ,
৪) মৃত্যু দুঃখ,
৫) অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ,
৬) প্রিয় বিয়োগ দুঃখ,
৭) আকাক্সিক্ষত বস্তুর
অপ্রাপ্তি দুঃখ, এবং
৮) পঞ্চ উপাদান স্কন্ধময় এ
দেহ-মন দুঃখ।
পঞ্চস্কন্ধ:
পঞ্চস্কন্ধ
হলো লৌকিক ধর্ম। এর পাঁচটি উপাদান আছে। উপাদানগুলো যখন ব্যক্তির তৃষ্ণার বিষয়
হয়ে নিকটে আসে তখনই তাকে বলা হয় উপাদান স্কন্ধ। সর্বজ্ঞানী বুদ্ধ এগুলোকে
দুঃখরূপ বলে অভিহিত করেছেন যেগুলো দুঃখমুক্তির প্রধান অন্তরায়। পঞ্চস্কন্ধের উপাদানগুলো
হলো:
১. রূপ,
২. বেদনা,
৩. সংজ্ঞা,
৪. সংস্কার, এবং
৫. বিজ্ঞান
২। দুঃখের কারণ:
দুঃখের
অন্যতম কারণ হচ্ছে তৃষ্ণা। তৃষ্ণা মানুষকে সর্বনাশ করে। এর দ্বারাই মানুষ কলুষিত
হয়। তৃষ্ণা বিবেককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এই তৃষ্ণার কারণে রাজায়-রাজায়, ক্ষত্রিয়ে-ক্ষত্রিয়ে,
ব্রাহ্মণে-ব্রাহ্মণে, মাতা-পিতা,
পিতা-পুত্রে, মাতা-কন্যা, ভাই-ভাইয়ে, মিত্র-মিত্রের সঙ্গে দ্বন্ধে
লিপ্ত হয়। এর ফলে তারা মৃত্যু বরণ করে এবং মরণ সমান দুঃখের সন্মুখীন হয়।
তৃষ্ণা তিন প্রকার। যথা:
১. কাম তৃষ্ণা (সুখ
সম্ভোগের তৃষ্ণা),
২. ভব তৃষ্ণা (বেঁচে থাকার
তৃষ্ণা) এবং
৩. বিভব তৃষ্ণা (জাগতিক
উন্নতি-শ্রীবৃদ্ধির তৃষ্ণা)।
৩. দুঃখ নিরোধ:
যা
তৃষ্ণার অশেষ, বিরাগ,
নিরোধ, ত্যাগ, নিবৃত্তি,
মুক্তি ও অনাসক্তি তাই দুঃখ নিরোধ। কোনো বস্তুতে সেই তৃষ্ণা
ক্ষয়প্রাপ্ত হবার থাকলে ক্ষয় হয় এবং নিরুদ্ধ হবার কারণ থাকলে নিরুদ্ধ হয়।
তৃষ্ণার বিনাশ হলে উপাদানের নিরোধে ভব লোকের (বিশ্ব) নিরোধ হয়। ভব নিরোধ থেকে
জন্মের (পুনর্জন্ম) নিরোধ হয়। জন্মের নিরোধে জরা, মরণ,
শোক, রোদন, দুঃখেরনিরোধ
হয়। এভাবেই দুঃখের নিরোধ হয়।
৪. দুঃখ নিরোধের উপায়:
সমস্যা
থাকলে সমাধানও থাকে, রোগ থাকলে প্রতিকারও থাকে। গৌতম বুদ্ধ প্রদর্শিত চারি আর্যসত্য পথ
অবলম্বন করলে দুঃখের অবসান ঘটানো যায়। উত্তরণের জন্য পথ বা মার্গ অনুসরণের কথা
বলা হয়েছে তা হলো আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই মার্গের ব্যাখ্যায় আট প্রকার
নিয়মাবলি বা কার্যপদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। বুদ্ধ এটাকে মধ্যপন্থা হিসেবে অভিহিত
করেছেন। এই মধ্যপন্থার মাধ্যমে মুক্তিলাভের উপায় নির্দেশ করা হয়েছে। আর্য
অষ্টাঙ্গিক মার্গের মধ্যেই বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি বা বুদ্ধের নীতিতত্ত্বকে প্রকাশ
পেয়েছে। এই মার্গ অনুযায়ী জীবনযাপন করতে পারলেই মানুষ ইহজীবনে দুঃখ থেকে মুক্তি
লাভ করতে পারে।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ কী?
অষ্টাঙ্গিক
মার্গ হলো এমন আটি উপায় যার দ্বারা জীবন থেকে দুঃখ দূর করা বা নির্বাণ প্রাপ্তি সম্ভব। আর এই আটটি উপায়কে একত্রে বলা হয় আয্য
অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই আয্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপর ভিত্তি করেই বৌদ্ধ ধর্মে দশশীল,
অষ্টশীল এবং পঞ্চশীলের উৎপত্তি। অষ্টাঙ্গিক মার্গকে বৌদ্ধ ধর্মের
মূল ভিত্তি বলা যায়, যা মধ্যপথ নামে অধিক পরিচিত।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ:
১. সম্যক দৃষ্টি, (সম্যক ধারণা বা চিন্তা) (Right
View),
২. সম্যক সংকল্প, (Right Resolve),
৩. সম্যক বাক্য, (Right Speech),
৪. সম্যক আচরণ, (Right Action),
৫. সম্যক জীবিকা (জীবনধারণ),
(Right Livelihood),
৬. সম্যক প্রচেষ্টা, (Right Effort),
৭. সম্যক স্মৃতি (মনন), (Right
Mindfulness),
৮. সম্যক সমাধি (একাগ্রতা) (Right Samadhi/Concentration)।
শীল কী?
শীল
অর্থ নিয়ম বা নীতি। বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে ভিক্ষু,শ্রমণ,গৃহী বা সাধারণ মানুষদের জন্য শীল
রয়েছে। এই শীল পালন করা একান্ত নিজের উপর নির্ভরশীল।
বুদ্ধ প্রবর্তিত গৃহী বা সাধারণ মানুষের জন্য পঞ্চশীল বা পাঁচ
নীতিগুলো নিম্নরূপ:
১. প্রাণী বা যাদের পাঁচ
ইন্দ্রীয় আছে তাদের হত্যা না করা,
২. অদত্ত বস্তু বা পড়ে
থাকা কোন বস্তু না নেয়া,
৩. কামাচার বা অবৈধ্য
সম্পর্ক না করা,
৪. মিথ্যা কথা না বলা,
৫. সুরা জাতীয় অর্থাৎ মদ,গাঁজা প্রভৃতি সেবন না করা বা
না খাওয়া।
বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে ধারণা দিন।
বৌদ্ধদের
প্রধান ধর্মীগ্রন্থ হলো ‘ত্রিপিটক’। এটি পালি ভাষায় লেখা। খ্রিস্টপূর্ব
৩য় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের শাসনামলে ত্রিপিটক পূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবে গৃহীত
হয়। ত্রিপিটক
মূলত গৌতম বুদ্ধের দর্শন ও উপদেশের সংকলন। এটি মূলত তিন পিটকের সমন্বিত সমাহার।
পিটক শব্দটি পালি । এর অর্থ হলো বাক্স বা ঝুড়ি বা পাত্র। পিটক তিনটি হলো:
১.
বিনয় পিটক
২.
সূত্র পিটক
৩.
অভিধর্ম পিটক।
মতামত দিন