এম.এড

প্রেষণা কী? প্রেষণার শ্রেণিবিভাগ

প্রেষণা কী? প্রেষণার শ্রেণিবিভাগ

প্রেষণা বলতে কী বুঝায়?

প্রেষণা শব্দটির উৎপত্তি বাংলা ‘প্রেষ’ শব্দ থেকে যার অর্থ চাপ। ইংরেজি Motivation শব্দটির আদি রূপ হলো গ্রিক বা ল্যাটিন শব্দ ‘Movers’ যার দ্বারা জীবের সক্রিয়তা বা নড়াচড়াকে বোঝানো হয়। অন্যদিকে গ্রিক ‘Movers’ -এর আধুনিক ইংরেজি রূপ ‘Motive’ যার অর্থ নড়ন, চলন বা সক্রিয়তা। ইংরেজি Motivation একটি নামবাচক শব্দ যার অর্থ হল আলোড়ন, তাড়না, নোদনা, সক্রিয়তা বা বল বৃদ্ধিকারক কার্যক্ষমতা ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় Motivation শব্দটিকে প্রণোদনা, তাড়না, নোদনা, প্রেষণা রূপে গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রেষণা হলো মানুষ ও প্রাণির এমন একটি অবস্থা যা তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করে বা কর্মশক্তি দান করে। প্রেষণা থাকার জন্যই মানুষ বা প্রাণীর মধ্যে কর্মস্পৃহা পরিলক্ষিত হয়। প্রেষণাকে আমরা গাড়ি বা রেলগাড়ির সাথে তুলনা করতে পারি। জ্বালানি বা বাষ্প যেমন গাড়ি বা রেলগাড়িকে শক্তি যোগায় ও সামনের দিকে নিয়ে যায়, প্রেষণাও তেমনি আমাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয় আচরণের জন্য শক্তি বা তাড়না প্রদান করে। তাই বলা যায় উদ্দেশ্য দ্বারা প্রণোদিত হলে মানুষ বা প্রাণির মধ্যে যে সক্রিয় বা গতীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকেই বলা হয় প্রেষণা। 

প্রেষণার সংজ্ঞা

প্রেষণাকে মনোবিজ্ঞানীগণ বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

ই. হাল বলেন, “প্রেষণা হল উদ্দেশ্য হাসিলের ক্রমাগত প্রচেষ্টা।”

Crider, Goethals, Kavanaugh I ও Solomon -এর মতে, “আকা‫ক্ষা, প্রয়োজন এবং আগ্রহ যা একটি প্রাণীকে কর্মে উদ্বুদ্ধ বা সক্রিয় করে তোলে এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর দিকে পরিচালিত করে তাকে প্রেষণা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়।”

উডওয়ার্থ এর মতে, “প্রেষণা হল ব্যক্তির এমন একটি অবস্থা বা গতি যা তাকে কোন আচরণের জন্য বা কোন অভীষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য উদ্বুদ্ধ করে।”

সুতরাং আমরা বলতে পারি, যে পরিস্থিতি বা আচরণ আমাদের কোন অভাববোধের চাপ বা তাড়নার পরিস্থিতিতে সক্রিয় করে তোলে এবং উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জনের দিকে চালিত করে তাকেই প্রেষণা বলা হয়।

প্রেষণা চক্র কী?

প্রেষণা হচ্ছে একটি গতিশীল অবস্থা যা আমাদের মাঝে কোন উদ্দেশ্য লাভের তীব্র আকাঙ্খা বা ইচ্ছা জাগ্রত করে। এই গভীর অবস্থা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। প্রেষণার কয়েকটি স্তর বা পর্যায় রয়েছে যেগুলো অতিক্রম করে আমরা আমাদের কা‫ঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করি। এ স্তরগুলো হলো-

১. অভাববোধ (Need)

২. তাড়না (Drive)

৩. করণ আচরণ (Instrumental Behaviour)

৪. উদ্দেশ্য সাধন বা লক্ষ্যবস্তু (Goal)

প্রেষণার স্তরগুলো একসাথে দেখা যায় না, একটির পর আরেকটি পর্যায়ক্রমে আসে। অর্থাৎ স্তরগুলো একটিচক্রের আকারে আবর্তিত হয়। প্রেষণার পর্যায় বা স্তরগুলোর চক্রাকারে আবর্তিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রেষণা চক্র।

প্রেষণা কয় প্রকার ও কী কী?

প্রেষণার শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে মত পার্থক্য থাকলেও বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানী প্রেষণাকে সাধারণত দু’ভাগে ভাগ করার পক্ষপাতী, যেমন-

১. শারীরবৃত্তীয় বা জৈবিক প্রেষণা (Biological drives) এবং

২. সামাজিক প্রেষণা (Social drives)।

প্রেষণার শ্রেণিবিভাগ উল্লেখপূর্বক বর্ণনা দিন।

প্রেষণার শেণিবিভাগ নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীদের মতে প্রেষণাকে দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো:

১. জৈবিক প্রেষণা (Biological drives)

যেসব প্রেষণা প্রাণীর জৈবিক অস্তিত্ব থেকে অর্থাৎ শরীরের বিপাক ক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয় সেসব প্রেষণাকে বলা হয় জৈবিক প্রেষণা। জৈবিক প্রেষণার কিছু উদাহরণ হলো ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, যৌন প্রেষণা ও মাতৃত্ব ইত্যাদি। এসব প্রেষণার সৃষ্টি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য বলে এসব প্রেষণাকে অনেক সময় মূখ্য প্রেষণাও (Primary drive) বলা হয়। ক্সজবিক প্রেষণার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো হল-

  • জৈবিক প্রেষণা প্রাণীর শারীরিক তাগিদ বা প্রয়োজন থেকে সৃষ্টি হবে;
  • এটি মানুষ বা প্রাণীর জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য;
  • প্রেষণাটি জন্মগত, শিক্ষার্জিত নয়;
  • জৈবিক প্রেষণা একই শ্রেণির সকল প্রাণীর মধ্যে সমানভাবে বিদ্যমান থাকবে; এবং
  • শরীরের ভিতরের অস্থির অবস্থা ও অভাববোধ প্রাণীর মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি এবং শরীরের ভারসাম্য সংস্থাপক হিসেবে প্রেষণাটি কাজ করে।
২. সামাজিক প্রেষণা (Social drives)

সামাজিক প্রেষণার উদ্ভব হয় মানুষের সমাজ জীবন থেকে। এসব প্রেষণা মানুষ তার পরিবেশ বা সমাজ জীবন থেকে শিখে থাকে বলে এদের বলা হয় অর্জিত বা শিক্ষালব্ধ প্রেষণা। সামাজিক পরিতৃপ্তি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য নয় বলে এসব প্রেষণাকে গৌণ প্রেষণা (Secondary dirve) বলা হয়। এরূপ কিছু সামাজিক প্রেষণা হলো- যুথচারিতা, স্বীকৃতির চাহিদা, কৃতি প্রেষণা ইত্যাদি। কোন কিছু অর্জনের ওপর ভিত্তি করে প্রেষণাকে আমরা আরও দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন-

  • অভ্যন্তরীণ বা অন্তর্নিহিত প্রেষণা (Intrinsic motivation) ও
  • বাহ্যিক বা বহির্জাত প্রেষণা (Extrinsic motivation)।

শিখনে প্রেষণার প্রয়োজনীয়তা

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সকল কর্মশক্তির মূল উৎস হলো প্রেষণা। প্রেষণা আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করে। শিক্ষকদের প্রেষণা সংক্রান্ত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের চাহিদা সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে সহায়তা করে থাকে। শেখার প্রতি আগ্রহের অভাবে অনেক শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ে ভাল ফলাফল করতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষক বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষার্থীর মাঝে প্রেষণার সঞ্চার করতে পারেন। নিম্নে শিশুর শিখনে প্রেষণার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো:

  • প্রেষণা মূলত শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর কাজের স্বীকৃতি। এর ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সু-সম্পর্ক তৈরি হয় যা পাঠদান কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ করতে সহায়ক হয়।
  • পুরস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিখন উপযোগী প্রেষণা সৃষ্টি করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বলবর্ধক সৃষ্টিকারী উদ্দীপক যেমন- শাস্তি অপেক্ষা যোগ্যতার স্বীকৃতি, প্রশংসা ও উৎসাহদান ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি করা যায়।
  • ব্যর্থতার অনুভূতি ব্যক্তির মাঝে হীনম্মন্যতা জাগায় এবং কর্মবিমুখ করে তোলে। সে কারণে সাফল্যের অভিজ্ঞতার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং ব্যর্থতাকে পরিহার করতে শেখানো প্রেষণা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
  • শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক গুণসমূহ, যেমন- অন্যের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া বা সহমর্মিতা প্রকাশ করা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত দক্ষতা বিকাশের ওপর জোর প্রদানের মাধ্যমে পাঠের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গঠন করা যায়।
  • প্রেষণার জ্ঞানীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি তার প্রেষণা বা চাহিদাকে পরিচালনা করে। শিক্ষার্থীর কোন কিছু অর্জনের জন্য অভ্যন্তরীণ প্রেষণা অর্থাৎ তাদের ব্যক্তিগত গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করে।
  • বিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী যত্নশীল ও সম্মানযোগ্য আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের সুযোগ পায় তাদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ও মূল্যবোধ তৈরি হয়।
  • প্রেষণার মাধ্যমে পাঠের কাঙ্খিত শিখনফল অর্জন করা যায়।
  • শিক্ষার্থীদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা ও পরামর্শ প্রদান প্রেষণার সৃষ্টি করে ফলে শিক্ষার্থীরা অধিকতর প্রচেষ্টার সঙ্গে বিষয়টি শিখতে উৎসাহিত হয়।
  • যেকোনো কাজের ভালো ফলাফল ব্যক্তির মাঝে আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা ও নিরাপত্তাবোধের অনুভূতি সৃষ্টি করে যা পরবর্তীতে ভালো করার ক্ষেত্রে প্রেষণা হিসেবে কাজ করে।
  • শাস্তি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বিধায় প্রেষণা সৃষ্টির ক্ষেত্রে শাস্তি পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষার্থীকে তার পছন্দসই বিষয়টি থেকে বঞ্চিত করা, যেমন- খেলার সময় তাকে খেলতে না দেয়া অথবা ক্লাসের শেষে তাকে অতিরিক্ত কোনো কাজ দেয়া ইত্যাদি।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।