বি.এড

শিখন তত্ত্ব

শিখন তত্ত্ব (Learning theory)


পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ মানুষ বা প্রাণির আচরণের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী পরিবর্তনকে শিখন বলা হয়। শিখন একটি অবিরাম প্রক্রিয়া কারণ আমরা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে পর্যন্ত কিছু না কিছু শিখে থাকি। সাধারণভাবে শিখন বলতে বুঝায় আচরণের তুলনামূলক স্থায়ী পরিবর্তন।

মানুষ প্রতিনিয়ত জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কিছু না কিছু শিখছে।  এখন প্রশ্ন হলো- ‘মানুষ কীভাবে শিখে’? মানুষের শেখার এই ব্যাপারটি নিয়ে মনোবিদ ও শিক্ষাবিদগণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের তাত্ত্বিক ধারণা প্রকাশ করেছেন যেখানে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন যা শিখন তত্ত্ব নামে পরিচিত।

শিখন তত্ত্ব শিখন শেখানো প্রক্রিয়ার সঠিক এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার উপায় এবং এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অর্থপূর্ণ ধারণা লাভে সহায়তা করে। মূলত শিখন তত্ত্ব হতে প্রাপ্ত লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে একজন শিক্ষক শিক্ষণ পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে ফলপ্রসূ পাঠদানে সমর্থ হন।

এসকল শিখন তত্ত্ব হতে শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কিত নানা ধরণের প্রশ্ন লক্ষ্য করা যায়। যেমন

  • শিক্ষার্থী কীভাবে শেখে?
  • শিক্ষক কীভাবে পাঠ দান করেন?
  • শিখন কীভাবে ঘটে?
  • কোন ধরনের উপাদান শিখনকে প্রভাবিত করে?
  • শিখনে স্মৃতির ভূমিকা কী?
  • কীভাবে শিখনের সঞ্চালন ঘটে? ইত্যাদি।

যে সকল তত্ত্ব যা প্রকৃতি, প্রক্রিয়া মানুষ ও প্রাণীদের শিখণের প্রভাবকে প্রভাবিত করে তাকে শিখন-তত্ত্ব বলা হয়। মনোবিদগণ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং নানাবিধ পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ হতে প্রাপ্ত ডেটাভিত্তিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রস্তাব করেছেন। তাদের এই তত্ত্বগুলো সাধারণত ২টি প্রধান তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে বিভক্ত। সেগুলো হলো:

১. উদ্দীপনা-প্রতিক্রিয়া তত্ত্ব (Stimulus-response theory) এবং

২. জ্ঞানীয় তত্ত্ব (Cognitive theory) ।

তবে মানুষ বা প্রাণি একইভাবে শেখে না বরং মানুষ বা প্রাণি তার নিজস্ব ভঙ্গিতে শিখে থাকে। শিখনের তত্ত্বগুলোও মানুষ বা প্রাণির শিখন প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এসব ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে শিখন তত্ত্বগুলোকে আবার ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-

ক. আচরণবাদ (Behaviorism);

খ. সমগ্রতাবাদ (Gestalt theory);

গ. গঠনবাদ (Constructivist) ।

আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বহুল প্রচলিত শিখন তত্ত্ব :

  • আচরণবাদ ও করণ সাপেক্ষণ;
  • স্কিনারের তত্ত্ব;
  • গঠনবাদ শিখন তত্ত্ব ও সমগ্রতাবাদ;
  • থর্নডাইকের সংযোগবাদ;
  • হাওয়ার্ড গার্ডনারের বহুমুখী বুদ্ধিমত্তা তত্ত্ব;
  • জ্যাঁ পিয়াজের জ্ঞান বিকাশের তত্ত্ব;
  • লেভ ভিগস্কির সামাজিক সাংস্কৃতিক তত্ত্ব;
  • ব্রনফ্রেনব্রেনারের বাস্তুসংস্থান তত্ত্ব।

শিশু বিকাশের তত্ত্ব :

শিশু শিক্ষা ও বিকাশের ধারণায় বিভিন্ন তত্ত্বের প্রভাব অনস্বীকার্য৷ যুগে যুগে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও শিক্ষা বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত তত্ত্ব ও ধারণাসমূহ শিক্ষাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে৷ আধুনিক যুগে শিশু শিক্ষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষক্ষভাবে বিভিন্ন তত্ত্বের প্রয়োগ বেশ ব্যাপক৷ এসব তত্ত্ব ও গবেষণার ফলাফল আমাদের শিশুদের জন্য ফলপ্রসূ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে৷ শিক্ষার ধারণা ও বিষয়বস্তু, শেখার ধরন ও পদ্ধতি, মূল্যায়ন এবং অন্যান্য বিষয় কার্যকর ও যুগোপযোগী করতে আমরা বিভিন্ন তত্ত্ব থেকে নির্দেশনা পাই৷ শিক্ষা বিজ্ঞানে তত্ত্ব হলো, ‘কতকগুলো ধারণার সমষ্টিগত রূপ, যা মানুষের আচার-আচরণকে সুসংগঠিতভাবে অনুমান, বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে ঐ বিষয় সম্পর্কে কার্যকর নির্দেশনা প্রদান করে থাকে’৷

শিশুর বিকাশে সামাজিক শিখনের তত্ত্বের (Social learning theory)ধারণা শিশু শিক্ষায় বেশ প্রভাব বিস্তার করে৷ এ তত্ত্বের আলোকে, ‘অন্যরা কী করে তা দেখে এবং অনুকরণ করে শিশুর শেখার ধারণাটি প্রাধ্যন্য পায়’৷ প্রতিটি শিশুই অন্যরে কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে শেখে এবং তাদের আচার-আচরণ অনুকরণ করতে চেষ্টা করে৷ সামাজিক শিখনের তাত্ত্বিকরা মনে করেন, শিশুরা তাদের নিজের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ যেমন- যদি কোনো শিশু তার বড় ভাই অথবা বোনকে অন্যের সাথে কতৃর্ত্বসুলভ এবং বিশ্রী আচরণ করতে দেখে এবং এ ধরনের আচার-আচরণকে অরুচিকর বলে মনে করে, তবে সে সচেতনভাবে তার ছোট ভাই অথবা বোনের প্রতি উত্সাহমূলক এবং সহায়তাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করবে না৷ শিশুদের যার যার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা তাদেরকে তাদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাবের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও উত্সাহিত করে৷

শিশু শিক্ষায় বিভিন্ন তত্ত্বের প্রভাব সত্ত্বেও, জ্ঞান বিকাশের তত্ত্বের (Cognitive-developmental theory) বিশেষ প্রভাব বর্তমানকালে আলাদা গুরুত্ব পেতে ও মূল্যায়ন করতে থেকে দেখা যায়৷ জ্ঞান বিকাশের তত্ত্ব শিশুর শিক্ষা ও বিকাশে এক নতুন দিক উন্মোচন করেছে বলে প্রতীয়মান হয়৷ বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের শিখন ও বিকাশে জ্ঞান বিকাশের তত্ত্ব বিশেষভাবে কার্যকরতা প্রমাণ করেছে নানাভাবে৷ যেখানে বলা হয়েছে, শিশুর জ্ঞান বিকশিত হয় সক্রিয় ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে৷ এই ধরনের সক্রিয় ক্রিয়াকলাপ যেমন সমস্যার সমাধান, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও ক্রিয়াকলাপ এবং ভাষার ব্যবহার শিশুর শেখা বা জ্ঞানার্জনের জন্য আবশ্যক৷ এ তত্ত্বের তাত্ত্বিকগণ দাবি করেন, একজন মানুষের জীবনের সকল অংশই তার চিন্তা ও ভাষা দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়৷ যেমন- বন্ধুত্ব স্থাপন, ভালো-মন্দ অনুভূতি, তথ্য সংগ্রহ, কার্যকারণ সম্পর্ক, এমনকি কোনো কিছু উপভোগ করা পর্যন্ত মানুষের চিন্তা ও ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়৷ জ্ঞান বিকাশের তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বুদ্ধিভিত্তিক কার্যকলাপ একটি অত্যন্ত জটিল এবং মনোজাগতিক বিষয়।’ শিশুর শিখরে মতো দক্ষতাসমূহ জটিল ও অভ্যন্তরীণ মানসিক কার্যকলাপের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়া মনের অভ্যন্তরে ঘটে, যা বাইরে ঘটে না৷ যে কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ তত্ত্ব অনুযায়ী শিশুর বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো তার মানসিক বিকাশ৷

এ তত্ত্বের আলোকে, শিশুর বিকাশে অন্যান্য তত্ত্ব ও ধারণার প্রভাবকে স্বীকার করার পরও শিশুর বিকাশে তার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা, বড়দের প্রভাব, অভিজ্ঞতা ও সমাজের বিভিন স্তরের মিথষ্ক্রিয়া ও প্রভাবকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়া হয়।  শিশুর জ্ঞান বিকাশের তত্ত্বের গোড়াপত্তন করেন যে সকল শিক্ষা মনোবিদ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-

১. সুইস শিক্ষাবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিয়াজে,

২.রাশিয়ার শিক্ষাবিদ লেভ ভিগস্কি

৩. রাশিয়া বংশোদ্ভুত আমেরিকান শিক্ষাবিদ ব্রনফেনব্রেনার

 প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শিশুর শিখন ও বিকাশকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করার কারণে এ তত্ত্বসমূহ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করার দাবি রাখে৷

তথ্যসূত্র:

১. ডিপিএড মড্যুল, পেশাগত শিক্ষা ১ম ও ২য় খন্ড।

২. বি.এড মড্যুল, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

৩. উইকিপিডিয়া।

৪. ইন্ডাকশন প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।