অধ্যায়-০৭: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি
সেশন-৭.২: বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ
ক্লাসের আলোচ্য বিষয়:
৫) আমাদের জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহার সম্পর্কে লিখুন।
৬) শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির কীভাবে কাজে লাগে?
৭) প্রযুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করুন।
৮) প্রযুক্তির অপব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ দিন।
৫) আমাদের জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহার সম্পর্কে লিখুন।
আধুনিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তি আমাদের ঘিরে রয়েছে। ঘর হতে অফিস, শিক্ষা, কৃষি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবন ও জীবিকা অর্জনে অবদান রাখছে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
শিক্ষা ক্ষেত্রে:
শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বৈপ্লবিক প্রযুক্তি হলো কাগজ উদ্ভাবন। এরপর ছাপাখানা উদ্ভাবনের মাধ্যমে জ্ঞান বিকাশের অন্যতম সঙ্গী গ্রন্থ প্রকাশের দ্বারা অতি দ্রুত জ্ঞান বিস্তার আরো সহজ হয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কম্পিউটার ও ইন্টারনেট উদ্ভাবন জ্ঞান আদান-প্রদানের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে চলেছে। ই-লার্নিং, ইবুক, ই-লাইব্রেরী, ডিজিটাল কনটেন্ট’র ব্যবহার আজ প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতিনিয়ত জ্ঞানচর্চার পথ অবারিত করে চলছে।
যাতায়াতের ক্ষেত্রে:
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নৌকা তৈরি করে জলপথে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করত। পরবর্তীতে চাকা উদ্ভাবন হওয়ায় গরুচালিত, ঘোড়াচালিত গাড়িতে করে স্থালপথে মানুষ ও মালামাল পরিবহন সহজ হয়ে ওঠে। স্থলপথে বড় পরিবর্তন আসে স্টিম ইঞ্জিন উদ্ভাবনের পর। রেল ও মোটরগাড়ি মানুষ ও মালামাল পরিবহনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জলপথেও ইঞ্জিনচালিত স্টিমার/জাহাজ অনেক দ্রুত ও সহজে পরিবহনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। সবশেষে আরেকটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে অ্যারোপ্লেন উদ্ভাবনের পর। এরপর মানুষ অনেক কম সময়ে আকাশ পথে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহন শুরু করল।
কৃষি ক্ষেত্রে:
কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলছে। যেমন-বর্তমানে ট্রাক্টর, সেচপাম্প, ফসল মাড়াইযন্ত্র ইত্যাদি আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি স্বল্প সময়ে অধিক খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করছে। ফলে মানুষ কম পরিশ্রমে স্বল্প সময়ে খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। কৃষিতে জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তি মানুষকে অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ, পোকামাকড় প্রতিরোধী এবং অধিক ফলনশীল উদ্ভিদ উৎপাদনে সহায়তা করছে। যা তার নিজের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করে অর্থ উপার্জনে সাহায্য করে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে:
নতুন নতুন ওষুধ, যন্ত্রপাতি, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, লেজার অপারেশন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন ও বদল, কৃত্রিম কিডনি, পেস মেকার, রোগ প্রতিরোধক টিকা বা ইনজেকশন ও বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশক। প্রতিনিয়ত চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। যেমন-
১. টেলিমেডিসিন প্রযুক্তি: এই প্রযুক্তির মাধ্যমে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে রোগীদের সঙ্গে ডাক্তারদের সংযোগ স্থাপন করে তোলে প্রযুক্তি। চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীদের ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলে সমস্যা সমাধান করাতে সময় অপচয় কম হয় বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য টাকা খরচও কম হয়।
২. মোবাইল প্রযুক্তি: চিকিৎসকরা এখন মুহূর্তের মধ্যে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য অ্যাক্সেস করতে পারেন। যেমন- ড্রাগ ইনফরমেশন, গবেষণা সম্বন্ধিত তথ্য, রোগীদের তথ্যের রেকর্ড ইত্যাদি। মোবাইল ডিভাইস প্রযুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসকরা তাদের যে কোন প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্বের যে কোন স্থানে বহন করে নিয়ে যেতে পারে।
৩. চিকিৎসা গবেষণা প্রযুক্তি: বিজ্ঞানীরা সেলুলার স্তরে রোগ নির্ণয় এবং রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবায় প্রযুক্তি ম্যালেরিয়া, পোলিও, এম এম আর মতো জীবন বিপন্ন রোগগুলি বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কার করে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষের প্রান বাঁচায়।
৪. চিকিৎসা প্রযুক্তির সরঞ্জামঃ চিকিৎসা সাজসরঞ্জাম প্রযুক্তি এবং টেলিহেলথ রোবোটিক সার্জারি সৃষ্টি করছে, যেখানে কিছু কেসে সার্জারি চলার সময় চিকিৎসককে রোগীর সঙ্গে অপারেটিং রুমে থাকার প্রয়োজন হবে না। এর পরিবর্তে সার্জন তাদের হোম সার্ভিসের মাধ্যমে নিজ কক্ষ থেকেই রোগীদের নিজস্ব শহরের কাছাকাছি যে কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কার্যপ্রণালী সম্পাদন করতে পারে।
৫. দৈনন্দিন জীবন ও বিনোদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি: টিভি, ফ্রিজ, এয়ারকুলার, ভিসিআর, ডিভিডি, সিডি, স্বয়ংক্রিয় দরজা, ডিশ অ্যান্টেনা, লিফট, রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তির উদ্ভাবন আমাদের জীবনমানকে করেছে অনেক উন্নত। এছাড়াও আমরা প্রতি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকি।
৬) শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির কীভাবে কাজে লাগে?
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টিতে সারাবিশ্বেই নানাবিধ প্রয়াস পরিলক্ষিত হয। বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের নাগরিকদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষাক্রমে ICT অন্তর্ভূক্ত করেছে। আবার আইসিটি জ্ঞান ব্যবহার করে আকর্ষণীয় ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করা যায় ফলে শিক্ষার্থীরা সহজে ও আনন্দের সাথে শিখতে পারে। নিম্নে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা উল্লেখ করা হলো:
- ICT ব্যবহার করে আকর্ষণীয় ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করা যায়, যা গতানুগতিক শিক্ষা উপকরণের চেয়ে যথেষ্ট কার্যকর। শিক্ষকগণ ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে সফলভাবে শ্রেণিতে পাঠদান করতে পারেন।
- ইন্টারনেটের ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রেণিকক্ষ ও পাঠ্য পুস্তকের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যপী জ্ঞানের সন্ধান করতে পারে।
- ICT-র সাহায্যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের (যেমনঃ প্রতিবন্ধী ও অটিষ্টিক) জন্য বিভিন্ন Computer Assisted Learning (CAL) ও Computer Assisted Instruction (CAI) সফটওয়্যার প্রস্তুত করা যায়। ফলে বিশ্বব্যাপী সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে ICT গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
- ইবুক তথা ই-লাইব্রেরীর ব্যবহার আজ প্রযুক্তির কল্যাণে অবারিতভাবে জ্ঞান চর্চা করা যায়।
- ই-লার্নিং বা অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে ঘরে বসেই বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে। প্রযুক্তির কল্যাণে শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে; এখন যেকোন মানুষ যেকোন সময় যেকোন স্থান (anyone, anytime, anywhere) থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে। বাংলাদেশে বসেও এখন একজন শিক্ষার্থী চাইলে আমেরিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স করতে পারে। এটা সম্ভব হয়েছে ICT-র বহুমূখী সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে। বাস্তবে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে মুখোমুখী না দেখেও বরং ইমেইল, চ্যাটিং, ভিডিও কনফারেন্সিং-এর সাহায্যে পাঠ গ্রহন করতে পারেন।
- অনলাইনে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়ন করে সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারে।
৭) প্রযুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করুন।
প্রযুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব:
প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে নিরাপদ ও উন্নত করার পাশাপাশি নানারকম সমস্যাও সৃষ্টি করছে। যেমন-
- বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কয়লা পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করি কিন্তু এর ফলে বায়ু দূষিত হয়। এই বায়ু দূষণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও এসিড বৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী।
- রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অধিক পরিমাণে ব্যবহারের ফলে মাটি ও পানি দূষিত হয় যা জীবের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
- আধুনিক প্রযুক্তির সবচেয়ে ভয়াবহ প্রয়োগ হলো যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি ও এর ব্যবহার। যেমন-বন্দুক, বোমা, ট্যাংক ইত্যাদি।
- প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
- এছাড়া প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে।
৮) প্রযুক্তির অপব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ দিন।
প্রযুক্তির অপব্যবহারে কয়েকটি উদাহরণ:
- আধুনিক প্রযুক্তির সবচেয়ে ভয়াবহ প্রয়োগ হল যুদ্ধের অস্ত্র নির্মাণ ও এর ব্যবহার।
- নিয়মিত খেলাধুলা, ব্যায়াম, মুক্তচিন্তার পথে প্রযুক্তি বাঁধা সৃষ্টি করে।
- প্রযুক্তির অত্যাধিক ব্যবহার যেমন- ভিডিও গেইম, টেলিভিশন ও কম্পিউটার ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
- তথ্য বিকৃতি, ব্যক্তিগতভাবে সমাজের কোনো মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, প্রতিকৃতির ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপন ইত্যাদি বিষয় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া।
- ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেল করা।
- অপরাধী চক্র তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য ইন্টারনেটকে গোপনীয় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা।