চারু ও কারুকলা : সংজ্ঞা, শ্রেণিবিভাগ ও প্রয়োজনীয়তা

চারু ও কারুকলা : সংজ্ঞা, শ্রেণিবিভাগ ও প্রয়োজনীয়তা

চারুকলা বলতে কী বুঝায়?

আমাদের জীবনে এমন কতগুলো বিষয় আছে যা মনের খোরাক বা আনন্দ জুগিয়ে থাকে। এগুলো আমাদের মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে তোলে, কল্পনাবোধকে সঞ্চারিত করে, সৌন্দর্যবোধকে প্রসারিত করে এবং নান্দনিক অনুভূতিকে জাগরিত করার মধ্য দিয়ে মানসিক প্রয়োজন মেটায়, তাকে চারুকলা বলে। শিল্পী আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে স্বাধীনভাবে যে শিল্প সৃষ্টি করে তাই চারুকলা। আরো বলা যায় যে কলা মনের অনুভূতিকে সৌন্দর্য রসে সিক্ত করে মনে বিপুল আনন্দ সঞ্চার করে ও দর্শক শ্রোতার মনকে দোলা দেয় এবং যা প্রধানত হৃদয়াবেগপ্রসূত ও সৃষ্টিমূলক তাই চারুকলা।

চারুকলা ব্যাপক একটি বিষয় তাই এ সম্পর্কে অল্প কথায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। চারুকলা বিষয়টি সরাসরিভাবে মন ও অনুভূতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর মূল ব্যবহার সৃজনী শক্তি বিকাশে মূল্যবোধ এবং আবেগের সাথে যুক্ত। চারুকলা মানুষের সৌন্দর্য ক্ষুধা নির্বৃত্ত করে মনে আনন্দদান করে।

চারুকলা সম্পর্কিত সংজ্ঞা

শ্রীশচন্দ্র্র দাসের ভাষায়-

‘‘যে সৃষ্টির মধ্যে মানুষের প্রয়োজন সাধন অপেক্ষা অহেতুক আনন্দ বেশি, যাহাতে মানুষের জৈব অপেক্ষা আত্মিক ও মানসিক আনন্দ বেশি তাহাকে আমরা চারুশিল্প বা ললিত কলা বলিয়া আখ্যাত করিতে পারি।”

দার্শনিক টলস্টয় বলেছেন-

“আর্ট বা চারুকলা একটি মানবীয় ক্রিয়া, যা দ্বারা সজ্ঞানে কতিপয় বাহ্যিক প্রক্রিয়া দ্বারা নিজের মনের অনুভূতি বা কোন ভাবকে এমনভাবে অপরের নিকট পৌঁছে দেয়, যে অপরের মন সেভাবে সংক্রমিত হয়ে তা উপলব্ধি করতে পারে।”

চারুকলার শ্রেণিবিভাগ

১. চিত্রকলা :

কতগুলো রেখার সমন্বয়ে, রং তুলির ব্যবহারে যে আবেগ-অনুভূতি, ভাব-উচ্ছাস সৃষ্টি হয় তাকে চিত্রের মাধ্যমে রূপায়িত করাকে চিত্রকলা বলা হয়।

২. সংগীতকলা :

যে কলা মানব মনে সুরের মাধ্যমে আনন্দ ও অনুভূতির উদ্রেক করে, তাকে সংগীতকলা বলে।

৩. নৃত্যকলা :

যে কলা অঙ্গের নানারূপ ভঙ্গীমায় সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে দর্শকের মনে অপরিসীম আনন্দের খোরাক যোগায় তাকে নৃত্যকলা বলে।

৪. সাহিত্যকলা :

মনের ভাব, আবেগ ও কল্পনাকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, কাব্য প্রভৃতি লেখার মাধ্যমে মানুষের মনে সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করে এবং ছন্দ, রূপ ও শব্দ বিন্যাস দ্বারা মনে অফুরন্ত আনন্দ সৃষ্টি করে, তাকে সাহিত্যকলা বলে

৫. স্থাপত্যকলা :

ইট, সুরকি, বালি, মাটি, পাথর, সুড়কি প্রভৃতি দিয়ে বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা-ইমারত নির্মাণের সু-কৌশলকে স্থাপত্যকলা বলে। স্থাপত্যকলা দর্শকের মনে এক বিস্ময়কর সৌন্দর্য অনুভূতি জাগায়। যেমন- ‘তাজমহল’।

৬. ভাস্কর্যকলা :

প্রস্তর, কাঠ, মাটি, সিমেণ্ট ইত্যাদি উপকরণের সাহায্যে খোদাই বা রিলিফ বা চারমাত্রিক উন্নতমানের শিল্প সৃষ্টি করে যা দর্শকের মনে আনন্দ-ভাব-বেদনা-উচ্ছ্বাস আনে, তাকে ভাস্কর্যকলা বলে।

৭. অভিনয়কলা :

যে কলা বিষয়বস্তুকে কথাবার্তা ও অংগ-ভঙ্গীর মাধ্যমে মানুষের মনে রেখাপাত করে, সুনিপুণভাবে ভাব-আবেগ-উচ্ছাস প্রকাশ করে, তাকে অভিনয়কলা বলে। যেমন- নাটক, যাত্রা, আবৃত্তি ইত্যাদি।

কারুকলা কাকে বলে?

কারুশিল্পকে দৃষ্টি নন্দন করার জন্য কায়িক পরিশ্রমে নক্সা অঙ্কনকে কারুকলা বলা হয়। কায়িক পরিশ্রমে ব্যবহারিক প্রয়োজনে যে শিল্পকর্ম তৈরি হয়, তাই কারুশিল্প। কারুশিল্প যখন ক্রমান্বয়ে একাধিক লোকের মাঝে প্রসার লাভ করবে তখন তা লোকশিল্প। কারুশিল্প যখন গুণগত মানের চেয়ে সংখ্যার হিসেব বেশি হবে এবং কিছুটা যন্ত্রের ব্যবহার হবে, তখনই তা কুটির শিল্প হিসেবে পরিচিতি হবে। ব্যবহারিক বস্তুকে সৌন্দর্য দান করার উদ্দেশ্যে জটিলতা বর্জিত, সহজ উপকরণ বা হাতিয়ার দ্বারা কায়িক কৌশলে যে অলংকরণ করা হয় তার নাম কারুকলা।

এই কারুকলা লোকশিল্প, হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প প্রভৃতি কারুশিল্পের মাঝেই পরিলক্ষিত। সহজ কথায় কারুশিল্পের উপর কারুকলা প্রয়োগ করা হয়। কারুকলায় কৌশল ও বুদ্ধিবৃত্তি অধিকভাবে কাজ করে।

কারুকলা শিল্পকলারই একটা অংশ যা দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক মূল্যের সাথে বস্তুগত ভাবে সম্পর্কিত। এ কলা সহজে অর্থোপার্জন বা প্রাত্যহিক প্রয়োজনের সাথে যুক্ত এবং একই সাথে এর সৌন্দর্য উপভোগ্য। কারুকলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি ব্যবহারিক শিল্প। চারুকলা যেমন সৌন্দর্য রসে সিক্ত হয় কারুকলা তেমনি চারুকলার সংস্পর্শে আরো আকর্ষণীয় হয়ে মানুষের নিত্য ব্যবহারিক প্রয়োজন মিটায়। তাই বলা যায়, যে শিল্প প্রধানত দৈহিক, মানবিক ও ব্যবহারিক চাহিদা মিটানোর সাথে আনন্দদান করে তাকে কারুকলা বলে।

কারুকলার শ্রেণিবিভাগ

১. মৃৎশিল্প

২. দারু শিল্প

৩. সীবন শিল্প

৪. ধাতব শিল্প

৫. কাগজ শিল্প

৬. চর্ম শিল্প

৭. বাঁশ ও বেতশিল্প

৮. কাতাই শিল্প

৯. রেশম শিল্প

১০. বয়ন শিল্প ইত্যাদি।

চারু ও কারুকলার মধ্যে পার্থক্য কী?

চারু ও কারুকলার মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ:

চারুকলা কারুকলা
শিল্পীর মনের আবেগ, অনুভূতি ও কল্পনা দ্বারা সৃষ্ট শিল্প। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে দক্ষ শিল্পী বা কারিগর দ্বারা সৃষ্ট শিল্প।
চারুকলা মূলত অধিকতর সৃজনশীল। কারুকলা মূলত অধিকতর অনুকরণমূলক।
সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার প্রাধান্য বেশি থাকে। সৃজনশীলতার পাশাপাশি ব্যবহারিক গুরুত্ব প্রাধান্য বেশি থাকে।
বাস্তবতাকে অতিক্রম করে যেতে পারে। তুলনামূলকভাবে কম অতিক্রম করতে পারে।
সূক্ষ্ম মাংসপেশি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বৃহৎ মাংসপেশি ব্যবহারে অভ্যস্ত।
ক্ষণ-সৌন্দর্য্যকে চিরত্ব দান করে। সাময়িক পরিতৃপ্তির পর বিনষ্ট হতে পারে।
টেবিল: চারু ও কারুকলার পার্থক্য
চারুকলার প্রয়োজনীয়তা

  • নান্দনিক বিকাশ লাভ হয়।
  • স্মৃতি ও কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটে।
  • সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধন হয়।
  • রুচিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
  • মনযোগ ও ধৈর্য শক্তির বিকাশ ঘটে।
  • মানসিক পরিতৃপ্তি পাওয়া যায়।
  • শিক্ষোপকরণ তৈরি করা যায় ফলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে সহজ হয়।
  • অর্থোপার্জনে করা যায়।
কারুকলার প্রয়োজনীয়তা
  • সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত হয়।
  • হাত চোখের ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
  • স্মৃতি ও কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটে।
  • বাস্তব জ্ঞান লাভ করা যায়।
  • চঞ্চলতা হ্রাস পায়।
  • মডেল তৈরি করে পাঠদানের সময় উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। হস্ত ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করা যায়।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।