এম.এড

বহুমূখী বুদ্ধিমত্তার প্রকারভেদঃ প্রয়োজনীয়তা ও শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ

হাওয়ার্ড গার্ডনারের বহুমূখী বুদ্ধিমত্তার প্রকারভেদ এবং শ্রেণিকক্ষে এর প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগ

ক্লাসের আলোচ্য বিষয়:
  • হাওয়ার্ড গার্ডনারের বুদ্ধিমত্তাগুলোর বর্ণনা দিন।
  • শ্রেণিকক্ষে বুদ্ধির বহু উপাদান তত্ত্বকে প্রয়োগের জন্যশিক্ষকের করণীয় দিকসমূহ বর্ণনা করুন।
  • একজন শিক্ষক হিসেবে বহুমূখী বুদ্ধিমত্ত্বার জানার প্রয়োজনীতা ব্যাখ্যা করুন।

হাওয়ার্ড গার্ডনারের বুদ্ধিমত্তাগুলোর বর্ণনা দিন।

১. মৌখিক বা ভাষাভিত্তিক বুদ্ধিমত্তা:

শব্দ বা ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে কোন কিছু প্রকাশের দক্ষতাই হলো মৌখিক বা ভাষাভিত্তিক বুদ্ধি। উদাহরণস্বরূপ- কোন বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারা বা ব্যাখ্যা করতে পারা, কোন কিছু রচনা করতে পারা, বক্তৃতা বা বিতর্ক করার দক্ষতা ইত্যাদি। লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বক্তা- এদের মাঝে এ ধরনের বুদ্ধি দেখা যায়।

২. যুক্তিমূলক-গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা:

এ ধরনের বুদ্ধি হলো যুক্তিমূলক ও গাণিতিক প্রয়োগের দক্ষতা। কোন বিষয়ে যুক্তি প্রদান, বিচার বিশ্লেষণ ও গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারার দক্ষতা ইত্যাদি। বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, হিসাবরক্ষক এদের মধ্যে এই দক্ষতা দেখা যায়। এ বুদ্ধিতে যারা অগ্রগণ্য তারা সাধারণত গণিত ও কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ অন্যদের চেয়ে ভাল এবং যুক্তি প্রদানে বেশি পারদর্শী হয়ে থাকে।

৩. দৃষ্টি বা স্থান সম্পর্কীয় বুদ্ধিমত্তা:

এটি হলো ত্রিমাত্রিক চিন্তার দক্ষতা। আনুপাতিক দিক ঠিক রেখে ছবি আঁকতে পারা, ছবি ব্যাখ্যা করতে পারা, মানচিত্র, চার্ট ও নকশা বুঝতে পারা, কোন কিছুর চিত্র কল্পনা করতে পারা ও প্রতিকৃতি বানাতে পারার দক্ষতা। স্থপতি, চিত্রশিল্পী, কারিগর ও নাবিক এদের মধ্যে এই দক্ষতা দেখা যায়। এ ধরনের ব্যক্তিরা সাধারণত হাত ও চোখের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উ‪চ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।

৪. শরীরবৃত্তীয় বা শারীরিক ক্রিয়াজনিত বুদ্ধিমত্তা:

শরীর ও অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং শরীরচর্চামূলক ক্রিয়াকলাপে ব্যবহৃত বুদ্ধি, যেমন- দৌড়, সাঁতার, ক্রিকেট, ফুটবল, হাডুডু ইত্যাদিতে যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রদর্শন। হস্তশিল্পী, কর্মকার, চাষী, কাঠুরিয়া খেলোয়াড়, সার্জন, নৃত্যশিল্পী প্রভৃতি পেশার ব্যক্তিরা এ ধরনের দক্ষতার অধিকারী।

৫. সংগীতে পারদর্শিতা বা সংগীতমূলক বুদ্ধিমত্তা:

গান-বাজনা, অঙ্গভঙ্গি, নৃত্য, প্রকৃতির বিভিন্ন শব্দ সহজে অনুধাবন ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপে পারদর্শিতা প্রদর্শন করা। সঙ্গীত কম্পোজার ও সঙ্গীত শিল্পীদের মাঝে এই দক্ষতা দেখা যায়।

৬. আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা:

অন্যকে বোঝার এবং অন্যের সাথে সুসম্পর্ক গড়ার দক্ষতাকে বুঝায়। এ শ্রেণির বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা বহির্মুখী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন (Extrovert) হয়ে থাকে। এরা নেতৃত্বদান এবং জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে দক্ষ হয়ে থাকে। দক্ষ শিক্ষক, মানসিক চিকিৎসক, প্রশিক্ষকরা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই দক্ষতা দেখা যায়।

৭. অন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা বা বুদ্ধিমত্তা:

ব্যক্তির নিজেকে বুঝার এবং নিজের জীবনকে সার্থকভাবে পরিচালনার দক্ষতাকে বুঝায়। আত্মসচেতন হওয়া, আত্মপোলব্ধি করতে পরা, একা একা কাজ করতে ভালবাসা ইত্যাদি হলো অন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা বা বুদ্ধির উদাহরণ। মনোবিজ্ঞানী, সাধু, ধর্মসাধক-এদের মাঝে এই দক্ষতা বেশি থাকে। এ ধরনের বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন (Introvert) এবং জটিল দশর্নের অধিকারী হয়ে থাকে এবং একাকিত্ব ভালবাসে। বহু উপাদান তত্ত্বের একটি দুর্বলতা হলো অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধি কারণ এ ধরনের বুদ্ধি পরিমাপ করা কঠিন।

৮. প্রকৃতিবিষয়ক দক্ষতা বা বুদ্ধিমত্তা:

প্রকৃতিবিষয়ক দক্ষতা বা বুদ্ধি বলতে প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ করার এবং প্রকৃতি ও মানুষের ক্সতরি বিষয়কে অনুধাবনের দক্ষতাকে বুঝায়। এইবুদ্ধি প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থা ও গতির সাথে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা, প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগাতে পারা, প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের তথ্য সংগ্রহ করা ও গবেষণা করা ইত্যাদি দক্ষতাকে বুঝায়। কৃষক, উদ্ভিদবিদ, পরিবেশবাদীদের মধ্যে এই পারদর্শিতা দেখা যায়।

৯. অস্তিত্বমূলক বুদ্ধিমত্তা:

মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কিত গভীর প্রশ্ন করার যোগ্যতা বা সংবেদনশীলতা এইবুদ্ধির অন্তর্গত। যেমন-জীবনের অর্থ কী; কেন আমরা মারা যাই বা কেন মানুষ মারা যায়; আমরা এখানে কীভাবে এসেছি; এ পৃথিবীতে আমাদের কাজ কী ইত্যাদি। বুদ্ধির এক্ষেত্রটি দর্শনের সাথে সম্পর্কিত।

শ্রেণিকক্ষে বুদ্ধির বহু উপাদান তত্ত্বকে প্রয়োগের জন্য শিক্ষকের করণীয় দিকসমূহ বর্ণনা করুন।

শিখনের ক্ষেত্রে এ বুদ্ধিমত্তাগুলোর নানামূখী ভূমিকা রয়েছে। গার্ডনার মতে- প্রতিটি বুদ্ধিমত্তার জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ বা প্রকাশভঙ্গি। একজন শিক্ষক যদি এই বহুমূখী বুদ্ধিমত্তা তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখেন এবং সে মোতাবেক বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করেন তবে শিক্ষার্থীরা তা দ্রুত শিক্ষণীয় বিষয়গুলোআয়ত্ত করতে পারবে। নিম্নে শিক্ষকের করণীয় দিকসমূহ তুলে ধরা হলো:

  • পাঠ উপস্থাপনের সময় শিক্ষক বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদান করা।
  • শ্রেণিকক্ষ বিভিন্ন ধরনে শিক্ষা উপকরণ দ্বারা সজ্জিত করা। যেমন- বিজ্ঞান ক্লাশে শিক্ষক কোন উপকরণ দিয়ে অনুসন্ধান বা তুলনা করতে দিতে পারেন।
  • ভাষা সাহিত্যের ক্লাশে শিক্ষার্থীদের কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে  ভাষাগত এবং কাল্পনিক দক্ষতার বিকাশ ঘটানো।
  • চারু ও কারুকলার ক্লাসে শিক্ষার্থীর জ্ঞানগত, প্রকৃতি সম্পর্কিত দক্ষতার বিকাশ ঘটানো।
  • বহুবিধ বুদ্ধি তত্ত্বের জ্ঞান দ্বারা শিক্ষকগণ শেখন-শেখানো ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কোন একক দক্ষতা বা কোন একই সাথে একাধিক দক্ষতার বিকাশ ঘটানো।
  • শিখন শেখানো পদ্ধতিতে শুধু ভাষাগত এবং গাণিতিক বুদ্ধিমত্তার ওপর জোর না দিয়ে বহুমুখী বুদ্ধি উপাদানের জ্ঞান ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করা।
  • প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করা।

একজন শিক্ষক হিসেবে বহুমূখী বুদ্ধিমত্ত্বার জানার প্রয়োজনীতা ব্যাখ্যা করুন।

গার্ডনার বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিমত্তা অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনা কৌশল ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মনির্ভরশীল হয়। গার্ডনারের মতে বিদ্যালয়ে সমস্ত রকমের বুদ্ধির বিকাশ ঘটাবার চেষ্টা চালাতে হবে। এ তত্ত্বটি শিক্ষকরা জানলে তারা বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যকলাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে পারেন, যেমন- গান, নাচ, সহযোগিতামূলক শিখন, শিল্পকর্ম, ভূমিকা অভিনয়, খেলাধুলা, বিতর্ক ইত্যাদি। শিক্ষকগণ শিখণের বিষয় অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারেন।

শিক্ষার্থীদের শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারেন তা ব্যাখ্যা করা হলো:

  •  মৌখিক বা ভাষাভিত্তিক বুদ্ধিমত্তা – শব্দার্থ, শব্দভান্ডার বৃদ্ধি করা, গল্প বলা, সারাংশ করা ইত্যাদি।
  • যুক্তিমূলক-গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা – সংখ্যার ধারণা, বিভিন্ন ধরণের হিসাব করা ইত্যাদি।
  • দৃষ্টি বা স্থান সম্পর্কীয় বুদ্ধিমত্তা – ছবি, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, ঐতিহাসিক ধারণা প্রদান ইত্যাদি।
  • ·সংগীতমূলক বুদ্ধিমত্তা –সঙ্গীত, ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি।
  • অন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা বা বুদ্ধিমত্তা– আত্ম-প্রতিফলন, একাকী চিন্তা করা, প্রশ্নের উত্তর প্রদান ইত্যাদি।
  • শরীরবৃত্তীয় বা শারীরিক ক্রিয়াজনিত বুদ্ধিমত্তা – ব্যায়াম, নৃত্য, খেলাধুলা ইত্যাদি।
  • আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা – দলীয় কাজ, মিলেমিশে কাজ করা, সামাজিক অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।
  • প্রকৃতি বিষয়ক দক্ষতা বা বুদ্ধিমত্তা – প্রাকৃতিক পরিবেশের অভিজ্ঞতা।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।