শিশুর বর্ধন ও বিকাশ

শিশু বিকাশের ক্রমধারা উল্লেখপূর্বক বর্ণনা দিন।

মানব জীবনের সূচনা ঘটে মাতৃগর্ভে। এরপর প্রতিটি শিশুকে বিকাশের ক্রমধারার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্র বিকাশ সার্বজনীন ধারা অনুসরণ করে। মাতৃগর্ভে ভ্রুণ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানবসত্তা রূপ পেতে যে সকল পরিবর্তনগুলো দেখা যায় তা নিম্নরূপ:

১. আকারের পরিবর্তন: ওজন, উচ্চতা ও দেহের আয়তন বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। একই সাথে আভ্যন্তরীন যন্ত্র-হার্ট, পরিপাকতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রেরও পরিবর্তন হয়।

২. অনুপাতের পরিবর্তন: অতি শৈশবে শিশুর দেহের তুলনায় মাথা ও কপাল বড় এবং ঘাড় ছোট থাকে। বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে মাথার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

৩. পুরনো বৈশিষ্ট্যের বিলুপ্তি ঘটা: সহজাত প্রতিবর্তী ক্রিয়া (Reflex) চলে যায়, শিশুর চুলের প্রকৃতি, দুধের দাঁত ও অন্যান্য শিশুসুলভ আচরনের বিলুপ্তি ঘটে।

৪. নতুন বৈশিষ্ট্যে অর্জন: বাল্যকালে নতুন দাঁত ওঠা, কৈশোরে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। একটি শিশু মাতৃগর্ভে ভ্রুণ থেকে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়ে একটি মানবসত্তার রূপ নেয়। স্বাভাবিক নিয়মে চল্লিশ সপ্তাহ মাতৃগর্ভে অবস্থানের পর এই মানবসত্ত্বা পৃথিবীতে আসে। এরপর শিশুটি বিভিন্ন বয়সে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে জীবনের কতগুলো ধাপ অতিক্রম করে। এক্ষেত্রে যেমন শিশুর শারীরিক পরিবর্তন হতে থাকে তেমনি শিশু নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আচরণিক দক্ষতা অর্জন করতে থাকে।  এই পরিবর্তনসমূহকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা:

১. আকার-আকৃতিগত পরিবর্তন বা বর্ধন (growth) এবং

২. আচরণগত পরিবর্তন বা বিকাশ (development)।

বর্ধন (growth)  কি?

বর্ধন বলতে দৈহিক আকার আয়তনের পরিবর্তনকে বোঝায়। বর্ধন হলো পরিমাণগত পরিবর্তন। নির্দিষ্ট সময় র্পযন্ত মানব জীবনে বর্ধন সাধিত হয়। বর্ধনের গতি ঊর্ধ্বমুখী। এটি প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে। ব্যক্তির ও সামাজিক অভিযোজনের সাথে বর্ধন সরাসরি সম্পর্কিত নয়। বর্ধন কেবল শারীরিক দিক নিয়েই আবর্তিত।

জন্ম পরবর্তীকালে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি বা বর্ধন:

উচ্চতা : জন্মের সময় আমাদের দেশে সাধারণত একটি শিশুর উচ্চতা ১৭ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। এরপরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথম ৭-৮ বছরে শিশুর উচ্চতা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও পরবর্তীতে এর গতি অনেক ধীর হয়ে যায়।

ওজন : জন্মের সময় শিশুর ওজন সাধারণত ৬-৭ পাউন্ড বা তার কম-বেশি থাকে এবং শিশু জন্মের পর প্রথম বছর ওজন অতি দ্রুত বাড়ে। ছয় মাসে শিশুর ওজন দ্বিগুণ হয় এবং এক বছরে তিন গুণ হয়।

আকার : বয়সের সাথে সাথে যেহেতু শিশুর ওজন, উচ্চতায় পরিবর্তন আসে, কাজেই তার সার্বিক আকারেও পরিবর্তন আসে, যা আমরা সাধারণভাবে পর্যবেক্ষণ করি এবং শিশুর বৃদ্ধি বুঝতে পারি।

বিকাশ (development)কি?

বিকাশ বলতে বোঝায় দৈহিক আকার ও আয়তন, আচরণ ও দক্ষতা এবং কার্যক্ষমতার পরিবর্তন। বিকাশ হলো গুণগত পরিবর্তন। বিকাশ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। বিকাশের গতি জীবনের শুরুতে ঊর্ধ্বমুখী, মধ্যবয়সে মন্থর এবং বৃদ্ধ বয়সে নিম্নমূখী। বিকাশ মানবজীবনের বিভিন্ন দিক যেমন- শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগীয়, ভাষাগত বিভিন্ন দিক নিয়ে আবর্তিত।

শিশু বিকাশের সাধারণ নীতিগুলো লিখুন।

বিকাশ হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক, অব্যাহত ও সমষ্টিগত প্রক্রিয়া। জন্মগত ভাবেই মানব শরীর নতুন নতুন উদ্দীপনা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকে। প্রতিনিয়ত উদ্দীপনার ফলে মস্তিষ্ক ও শরীর ক্রমাগত অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকে। দৃষ্টিগ্রাহ্য শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি শিশুর অভ্যন্তরীণ চিন্তা-চেতনার পরিবতর্নের প্রকাশ ঘটে তার আচার আচরণে। এরূপ মানসিক বা আচরণিক গুণাবলীর পরিবর্তনকে শিশুর বিকাশ (Development) বলে।

বিকাশের সাধারণ নীতি:

১. বিকাশ ক্রমধারা এবং পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী হয় এবং বিকাশের মধ্যে সহসম্পর্ক রয়েছে: যদিও কোন দুটি শিশুই একরকম নয়, তথাপি সকল শিশুই একটি সাধারণ ক্রমধারা অনুসরণ করে;

২. বিকাশের ধারায় সাদৃশ্য রয়েছে: প্রথমে ঘাড় শক্ত হয়, হামাগুড়ি দেয়, বসে, দাঁড়ায় এবং এরপর হাটে;

৩. বিকাশের ধারা ক্রমসংযোজনশীল বা বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে বিকাশ সম্পন্ন হয়;

৪. বিকাশ প্রক্রিয়া খুবই জটিল: শরীরের বিভিন্ন অংশের বৃদ্ধি বিভিন্ন হারে হয়। মাতৃগর্ভে মাথা দ্রূত বাড়ে।

জন্মের পর ধড়, হাত, পা দ্রূত বাড়ে। শৈশবকালের শেষে শারীরিক বৃদ্ধি মন্থর হয় এবং কৈশোরোত্তরকালে তা আবার দ্রুত হয়। ক্ষুদে শিশুদের মধ্যে কল্পনা প্রবণতা, আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা যায়। অন্যদিকে ৯-১০ বছরের কিশোরদের মধ্যে বাস্তবমূখিতা, যুক্তিপূর্ন চিন্তার উন্মেষ ঘটে;

৫. বিকাশ দুটি বিশেষ ধারায় সংগঠিত হয়:

ক) সেফালোকডাল (Cephalocaudal): ভ্রুন অবস্থায়, জন্ম পরবর্তী সময়ে বিকাশের গতি ক্রমশ: মাথা হতে পায়ের দিকে অগ্রসর হয়;

খ) প্রক্সিমোডিস্টাল (Proximodistal): শিশু প্রথমে চোখ,মাথা,ঘাড় এবং পরে বাহু,কনুই অর্থাৎ বিভিন্ন অঙ্গের কাজ কেন্দ্র হতে বাইরের দিকে এই নিয়মে সংগঠিত হয়;

৬. বিকাশ সাধারন থেকে বিশেষ ভাবে ঘটে- প্রথমে পুরো শরীর এগিয়ে দেয় ক্রমে হাত বা পা বাড়ায় । প্রথমে সবগুলো আঙুল মুঠো করে ধরে,ধীরে ধীরে ৩,২ বা ১টি আঙ্গুলের ব্যবহার করতে শেখে;

৭. বিকাশের ধারা প্রথমে বিচ্ছিন্ন ও ক্রমে সমন্বিত হয়: একটি একক ডিম্ব কোষের বিভক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন

অঙ্গের অধিকারী মানব শিশুর রূপ ধারন করে। একই ভাবে মানসিক বিকাশ-বুদ্ধির সাথে আগ্রহ, মনোযোগ,

আবেগ, ইচ্ছা সবই স্বতন্ত্রভাবে পরিবর্তিত হয়। এগুলো পরবর্তীতে একটি অন্যটি দ্বারা প্রভাবিত হয়;

৮. প্রতিটি শিশু অনন্য বা স্বতন্ত্র্য ভিন্ন বংশগতি ও ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে এই স্বাতন্ত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়;

৯. পরিপক্কতা ও শিখন বিকাশকে প্রভাবিত করে;

১০. বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে সংকটকাল বা বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে, শিশুর জন্মের পর ২৮ দিন, প্রথম ২ বৎসর, বয়ঃসন্ধিকাল; এছাড়াও প্রতিটি পর্যায়ই সঠিকভাবে বিকাশ না হলেই সংকট দেখা দিতে পারে। বিকাশের নীতিগুলো পিতামাতা, অভিভাবক ও শিক্ষক সকলের জানা থাকলে বিকাশের কোথাও অনিয়ম হলে সেটি সুনির্দিষ্ট করে যত দ্রুত সম্ভব চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞের দ্বারা প্রারম্ভিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিশু, তার পিতামাতা, অভিভাবক, সমাজ সবাই উপকৃত হতে পারে। শিশুকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে শিশুর সাথে সম্পর্কিত সকলের শিশু সম্পর্কে সুগভীর ও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।

সেফালোকডাল ও প্রক্সিমোডিস্টাল এর মধ্যে পার্থক্য কী?

সেফালোকডাল প্রক্সিমোডিস্টাল
সেফালোকডাল বিকাশ হলো মাথা নীচ থেকে শুরু হওয়া বৃদ্ধি এবং বিকাশকে বোঝায়। প্রক্সিমোডিস্টাল বিকাশ হলো শরীরের কেন্দ্র বা কোর থেকে বাইরের দিকে ঘটে।
প্রথমে ঘাড়ের পেশীগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে যা তাদের মাথা স্থির রাখতে সহায়তা করে।   এই বিকাশকালিন প্রথমে মেরুদণ্ড বিকশিত হয়।
মাথা সরাতে পারে ও শিশুর ঘাড় শক্ত হয়। ধীরে ধীরে বাহু, হাত ও হাতের আঙ্গুলগুলি বিকশিত হয়।
সবশেষে মাথা উপরে ধরে রাখতে পারে। সবশেষে পা ও পায়ের আঙ্গুল বৃদ্ধি পায়।

পরিণমন কি?

পরিণমন একটি নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ ব্যক্তিজীবনে একটি নির্দিষ্ট সময় বা বয়স পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলে। তারপর এই প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। পরিণমনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতন ও সক্রিয় থাকে না। ইহা একটি স্বাভাবিক এবং জৈবিক প্রক্রিয়া। এর জন্যে ব্যক্তির অতীত অভিজ্ঞতা অথবা অনুশীলনের প্রয়োজন হয় না।


মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।