শিক্ষাক্রম ও এর উপাদান

শিক্ষাক্রম বলতে কী বুঝায়?

শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলবার শক্তিশালী ও কার্যকর এবং প্রয়োগযোগ্য সুষ্ঠু সবল শিক্ষা সম্বদ্ধীয় পরিকল্পনা হল শিক্ষাক্রম। ইংরেজিতে ‘Curriculum’ শব্দটির ল্যাটিন শব্দ উৎপত্তি হয়েছে Currer থেকে। ‘Currer’ এর অর্থ হলো ‘Course of study’। আবার কেউ কেউ মনে করে ‘Currer’ এর অর্থ হলো ‘ঘোড় দৌড়ের পথ’।এখানে দৌড়ের মাধ্যমে নিদিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর ধারণা প্রকাশ করা হয়। শিক্ষাকে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পাথেয় হিসেবে ব্যবহার করে বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার হল শিক্ষাক্রম।

শিক্ষাক্রমে কোন শিক্ষা পর্যায়ের কয়েক বছরের কর্মসূচি বা কাজের ইঙ্গিত থাকে। এটি গোটা বৃক্ষের মত। এটি শিক্ষার্থীর পঠিতব্য বিষয়াদির সম্মিলিত রূপ। শিক্ষার্থীর সঠিক বিকাশের লক্ষ্যে কখন, কোথায়, কিভাবে, কতটুকু শেখাতে হবে এবং কোন কোন দিক হাতে কলমে শিখবে তারই রূপরেখা হল শিক্ষা ক্রম। এক কথায় শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিখন অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়ে তাদের আচার-আচরণ ও মনোভাবে এমন পরিবর্তন আনে যা তাকে একজন দক্ষ নাগরিক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

শিক্ষাক্রম সম্পর্কিত সংজ্ঞা

হিলডা তাবার মতে- ‘যুগের চিন্তাভাবনার অবয়বহীন ফসলই হলো শিক্ষাক্রম (The amorphous product of generations of thinking)।'

Wheeler এর মতে-‘ শিক্ষাক্রম বলতে শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিখন অভিজ্ঞতা নির্বাচন, বিষয়বস্তু শনাক্তকরণ, বিষয়বস্তু সংগঠন, মূল্যায়ন ইত্যাদির একটি বৃত্তাকার প্রক্রিয়া।’

পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির মধ্যে পার্থক্য কি?

পাঠ্যক্রম পাঠ্যসূচি
১. শিক্ষাক্রম একটি ব্যাপক ধারণা। ১. পাঠ্যসুচি শিক্ষাক্রমের একটি অংশমাত্র।
২. শিক্ষাক্রম হলো শিখন শেখানো কাজের কেন্দ্রিয় রূপরেখা। ২. পাঠ্যসুচি হলো নির্দিষ্ট শ্রেণির নির্দিষ্ট বিষয়াবলির সূচি।
৩. কেন্দ্রিয়ভাবে প্রণীত। ৩. শ্রেণিভিত্তিক প্রণীত।
৪. বৃহৎ বৃক্ষ সরূপ। ৪. বৃহৎ বৃক্ষের শাখা স্বরূপ।
৫. অসংখ্য পাঠ্যসূচির সমন্বয়। ৫. অসংখ্য পাঠের সমন্বয়।
৬. নির্দেশনামূলক ৬. বর্ণনামূলক।
৭. শিক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য। ৭. শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য
৮. প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ৮. এটি স্বল্পমেয়াদী।

শিক্ষাক্রমের শ্রেণিবিন্যাস

 সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষাক্রম প্রবর্তিত হয়ে থাকে। কাজেই এর শ্রেণিবিন্যাস করা খুব কঠিন।

শিক্ষাক্রমের শ্রেণিবিন্যাস:

শিক্ষাধারাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ৩ প্রকার। যথা:

১. সাধারণ শিক্ষার শিক্ষাক্রম,

২. কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্রম এবং

৩. পেশাগত শিক্ষার শিক্ষাক্রম ।

সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণভিত্তিক শিক্ষাক্রম ৩ প্রকার। যথা:

১. কেন্দ্রিভূত শিক্ষাক্রম,

২. আধা-কেন্দ্রিভূত শিক্ষাক্রম এবং

৩. বিকেন্দ্রিভূত শিক্ষাক্রম।

প্যাটার্নভিত্তিক শিক্ষাক্রম বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন-

১. বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম: বাংলা, ইংরেজি, গণিত ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম।

২. মৌলিক শিক্ষাক্রম: নিরক্ষরতা দূরীকরণ, পরিবেশ সচেতনা বৃদ্ধির শিক্ষাক্রম ইত্যাদি।

৩. সমন্বিত শিক্ষাক্রম: কেন্দ্রিভূত, বিকেন্দ্রিভূত শিক্ষাক্রম।

৪. কর্মতৎপরতামূলক শিক্ষাক্রম: সবুজ বিপ্লব শিক্ষাক্রম, শিল্প বিপ্লব শিক্ষাক্রম ইত্যাদি।

৫. ভাববস্তুভিত্তিক শিক্ষাক্রম: মূল্যবোধভিত্তিক, নৈতিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম।

৬. যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম: বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের শিক্ষাক্রম।

প্রাথমিক শিক্ষাক্রম কোন ধরণের শিক্ষাক্রম? প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের বৈশিষ্ট্য লিখুন।

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমটি যোগ্যতাভিত্তিক প্যাটার্নে প্রণয়ন করা হয়েছে অর্থাৎ এটি একটি যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। যোগ্যতা বলতে সুনির্দিষ্ট আচরণকে বোঝানো হয়। যে শিক্ষাক্রমে শিক্ষা শেষে প্রত্যেক বিষয় ও শ্রেণির নির্ধারিত অর্জন উপযোগি যোগ্যতাগুলো ক্রমানুসারে অর্জন করার লক্ষ্যে বিন্যস্ত করা হয়েছে তাকে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বলে। 

প্রাথমিক/যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের বৈশিষ্ট্য:

১. যোগ্যতাগুলো সুনির্দিষ্ট করা থাকে।

২. প্রতিটি যোগ্যতার পরিসর অনুসারে পাঠদান করা হয়।

৩. যোগ্যতাসমূহের নির্বাচনে শিক্ষার্থীর বয়স ও গ্রহণ ক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি আরোপ করা হয়।

৪. যোগ্যতার কাঠিন্য অনুসারে শ্রেণিভিত্তিক বিন্যাস করা থাকে।

৫. যোগ্যতাসমূহ নির্বাচনে জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতার সংমিশ্রণ ঘটানো হয়।

৬. বৈচিত্র্যময় শিখন শেখানো পদ্ধতিতে পাঠদানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

৭. শিখন অগ্রগতি যাচাই ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যবস্থা করা।

শিক্ষাক্রমের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা

শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষাক্রমের গুরত্ব সর্বাধিক। কারণ শিক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে শিক্ষাক্রমের গতি প্রকৃতি অনুসারে। বস্তুত শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষাব্যবস্থাকে উদ্দেশ্যমূখী, সময়োপযোগী, কার্যকরি ও গতিশীল করার একটি পূর্বপরিকল্পিত নীল নকশা। বস্তুত শিক্ষার প্রতি স্তরে শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তা বহুবিধ। নিম্নে শিক্ষাক্রমের গুরত্ব বা প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হলো:

  • কোন কোন বিষয়গুলো বেশি কাজে লাগে তার অগ্রাধিকার সনাক্তকরণ।
  • সামাজিক ও শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুসারে বিষয়বস্তুর বিন্যাসকরণ।
  • শিক্ষার্থীদের গ্রহণ ক্ষমতা অনুসারে বিষয়বস্ত নির্বাচন।
  • শিক্ষার্থীদের মেধা, বয়স, রূচি ও সামর্থ্য অনুসারে কাজের মাত্রা নিরূপণ।
  • সহজ থেকে কঠিন বিষয়বস্তু বিন্যাসকরণ।
  • শিক্ষার্থীর প্রকৃতি অনুসারে কর্মমূখী ও বৃত্তিমূলক বিষয়াদি অন্তর্ভূক্তকরণ।
  • বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সমন্বয়করণ।
  • শিক্ষাদান পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।