বি.এড

বহুমুখী বুদ্ধিমত্তা তত্ত্ব

Multiple Intelligences

বহুমুখী বুদ্ধিমত্তা তত্ত্ব

হাওয়ার্ড গার্ডনার অ্যামেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতনামা শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী। বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে তার তত্ত্ব সাম্প্রতিক কালে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে এ তত্তে¡র প্রয়োগ করা হচ্ছে। গার্ডনার তাঁর বিখ্যাত বই “Frames of Mind: The Theory of Multiple Intelligences” তে শিখনের ক্ষেত্রে ৮ ধরনের বুদ্ধিমত্তা কাজ করে বলে উল্লেখ করেছেন, বুদ্ধিমত্তাগুলো হলো-

১। মৌখিক ও ভাষাবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা;

২। যৌক্তিক ও গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা;

৩। দৃষ্টি ও অবস্থানমূলক বুদ্ধিমত্তা;

৪। ছন্দ ও সংগীত বুদ্ধিমত্তা;

৫। অনুভূতি ও শরীরবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা;

৬। অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা;

৭। আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা;

৮। প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা।

বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ ও শিখন প্রক্রিয়া

বুদ্ধিমত্তা লক্ষণ বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ের শিখন শেখানো ক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষে বহুমুখী বুদ্ধিমত্তা তত্ত্বের প্রয়োগ যেভাবে করবেন- মৌখিক ও ভাষাবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা: এ বুদ্ধিমত্তা যাদের প্রবল তারা শোনা, বলা ও পড়ার মাধ্যমে সহজে শেখে।

মৌখিক ও ভাষাবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ:

  • শুনতে পছন্দ করে।
  • বলতে পছন্দ করে।
  • পড়তে পছন্দ করে।
  • লিখতে পছন্দ করে।
  • সহজে বানান করে।
  • গল্প বলে, গল্প লেখে।
  • সাবলীল ভাষায় বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে।
  • শব্দভান্ডার বেশি ও তা যথাযথ ব্যবহার করে।
  • গুছিয়ে কথা বলে।
  • স্মরণ শক্তি বেশি হয়।
  • ভালো বক্তৃতা দেয় ।      

মৌখিক ও ভাষাবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তার শিখন প্রক্রিয়া:

  • বিভিন্ন ধরনের পড়ার উপকরণ যেমন বইপত্র, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, লেখার বিভিন্ন উপকরণ, শ্রবণমূলক উপকরণ যেমন অডিও টেপ, শ্রবণ-দর্শনমূলক যেমন টেলিভিশন ইত্যাদি শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের সুবিধা নিশ্চিত করবেন।
  • মৌখিকভাবে ভাব প্রকাশে শিশুকে উৎসাহিত করবেন।
  • ভাষা সম্বন্ধীয় বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শিশুকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করানোর জন্য বিভিন্ন কৌশলে প্রশ্ন করবেন (যেমন, তোমার মধ্যে কী কী সামাজিক গুণাবলি রয়েছে?)
  • ব্যক্তি, স্থান বা বস্তুর নাম স্মরণ করে বলার প্রতিযোগিতা করা
  • দেয়াল পত্রিকা সম্পাদনা করা।
  • জীবনের দৈনন্দিন ঘটনা লিখে রাখা।
  • সমস্যা বা ঘটনা বর্ণনা করা।
  • কোন বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করা।
  • কারো সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা।

যৌক্তিক ও গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা:

এ বুদ্ধিমত্তা যাদের প্রবল তারা সংখ্যা ও নকশার সাহায্যে সহজে শেখে। যৌক্তিক ও গাণিতিক বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ নিম্নরূপ:

  • গুনতে আনন্দ পায়।
  • বস্তুর সাহায্য ছাড়াই কোন বিষয়ে সহজে ধারণা লাভ করে।
  • সংক্ষিপ্ততা পছন্দ করে।
  • যুক্তি দিয়ে বিচার-বিবেচনা করে।
  • ধাঁ ধাঁ ও অঙ্কের খেলা পছন্দ করে।
  • সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে।
  • সমস্যা সমাধানে আনন্দ পায়।

যৌক্তিক ও গাণিতিক বুদ্ধিমত্তার শিখন প্রক্রিয়া:

  • শ্রেণিতে নানা ধরনের ব্লক, বিভিন্ন আকৃতির, রংয়ের, আদলের, গঠন বিন্যাসের বস্তু থাকবে।
  • শিক্ষক এমন কিছু কাজ পরিকল্পনা করবেন যাতে শিক্ষার্থীরা পরিমাপ ও হিসাব নিকাশ কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য মানচিত্র, গ্রাফ পেপার, কম্পাস, থার্মোমিটার ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারে। যেমন চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব’ অধ্যায়ের জন্য বিগত চল্লিশ বছরে জনসংখ্যার বৃদ্ধি দেখাতে বলবেন।
  • তথ্য বর্ণনা করার সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য চার্ট ব্যবহার করবেন।
  • শিক্ষার্থীর সহায়তায় কোন কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা।
  • শিক্ষার্থীর সহায়তায় সমস্যা সমাধান করা।
  • একাধিক বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য খুঁজে বের করা।
  • জীবজন্তু ও গাছপালা শ্রেণিকরণ করা।

দৃষ্টি ও অবস্থানমূলক বুদ্ধিমত্তা: এ বুদ্ধিমত্তা যাদের প্রবল তারা ছবি, রেখাচিত্র ও রূপরেখার সাহায্যে সহজে শেখে।

দৃষ্টি ও অবস্থানমূলক বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ:

  • ছবির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে চিন্তা করে।
  • ছবির সাহায্যে মনে রাখে।
  • ছবি আঁকতে ও রং করতে ভালবাসে।
  • প্রতিকৃতি বানাতে পছন্দ করে।
  • মানচিত্র, চার্ট এবং নকশা সহজে বুঝতে পারে।
  • কোন কিছুর চিত্র সহজে কল্পনা করে।
  • রূপক শব্দ ও বাক্য বেশি ব্যবহার করে।     

দৃষ্টি ও অবস্থানমূলক বুদ্ধিমত্তার শিখন প্রক্রিয়া:

  • তথ্য উপস্থাপনের সময় তথ্যগুলোকে দর্শনমূলকভাবে বা ছবির মাধ্যমে উপস্থাপন করবেন। যেমন পঞ্চম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশ’ অধ্যায়টি আপনি বাংলাদেশের সাহায়্যে উপস্থাপন করলে সবচেয়ে সফল হবেন। পাওয়ারপয়েন্ট, মানচিত্র, চার্ট, গ্রাফ, মডেল, কার্টুন, ভিডিও, স্লাইড ইত্যাদি ব্যবহার করুন।
  • শিক্ষার্থীদের একক বা দলগত কাজ দর্শনমূলকভাবে উপস্থাপনা করা। যেমন: পোস্টার, সময় রেখা, মডেল, মানচিত্র, চার্ট, ধারণা মানচিত্র ও ব্যাখ্যামূলক ছবি ব্যবহার করার মতো উপযুক্ত কাজ দলগতভাবে করতে দিবেন।
  • পাঠ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকার ছবির ব্যবহার করা।

ছন্দ বা সংগীতমূলক বুদ্ধিমত্তা :

এ বুদ্ধিমত্তা যাদের প্রবল তারা ছড়া, ছন্দ ও ধ্বনির তালে তালে সহজে শেখে।

ছন্দ বা সংগীতমূলক বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ:

  • তাল ও লয়ের প্রতি বেশি আকর্ষণ থাকে।
  • সুর ও ছন্দ সহজে মনে প্রভাব বিস্তার করে।
  • গান পছন্দ করে। কবিতা ও ছড়া তালে তালে আবৃত্তি করতে পছন্দ করে।
  • প্রকৃতির বিভিন্ন শব্দ শুনে সহজে আকৃষ্ট হয়।

ছন্দ বা সংগীতমূলক বুদ্ধিমত্তার শিখন প্রক্রিয়া:

  • শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তু মনে রাখার জন্য ছন্দময় ছড়া তৈরি ও ব্যবহার করা।
  • বিষয়বস্তু দিয়ে কোনছড়া, ছন্দ, গান বা সুর তৈরি করা যাতে প্রয়োজনে সহজে স্মরণ করা যায়।

অনুভুতি ও শরীরবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা :

এ বুদ্ধিমত্তা যাদের প্রবল তারা শারীরিক কলাকৌশল ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাহায্যে সহজে শেখে।         

অনুভুতি ও শরীরবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ:

  • খেলাধুলা পছন্দ করে।
  • কোন কিছু সহজে স্পর্শ করতে চায়।
  • হাতে কলমে কাজ করতে পছন্দ করে।
  • হস্ত শিল্পে দক্ষ হয়।
  • শরীর ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপর নিজের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ থাকে।
  • অংশগ্রহণ করে সহজে শেখে।
  • বস্তু সহজে নিয়ন্ত্রণ করে।
  • শুনে দেখে শেখার চেয়ে নিজে করে শেখে ও বেশি মনে রাখে।         

বুদ্ধিমত্তার শিখন প্রক্রিয়া

  • তাই শ্রেণিকক্ষে শারীরিক সঞ্চালনমূলক কিছু কাজের পরিকল্পনা করবেন যাতে এরা উপকৃত হয়। যেমন দলগত কাজ উপস্থাপন, নাচ, গান, ছবি আঁকা, পাজল, ব্লক, কাঠের ও মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার করতে দিন।
  • ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে উৎসাহিত করুন। পরিকল্পনা করে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শ্রেণীকক্ষের বাইরে নিয়ে যান।
  • অভিনয়ের মাধ্যমে শেখান যেমন: ‘বিদ্যালয়ে আমাদের কাজ’।

আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা

এ বুদ্ধিমত্তা যাদের প্রবল তারা অন্যের সঙ্গে ও দলে কাজ করে সহজে শেখে। অন্যের মনের কথা সহজে বুঝতে পারে।

আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ:

  • অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে।
  • অনেক বন্ধু বান্ধব থাকে।
  • ঝগড়া মেটাতে পছন্দ করে।
  • অন্যের কাজে সাহায্য করে।
  • দলে কাজ করতে পছন্দ করে।
  • সামাজিক পরিস্থিতি সহজে বুঝতে পারে।  

আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তার শিখন প্রক্রিয়া

  • এ ধরনের শিক্ষার্থীদের জন্য সহযোগিতামূলক শিখন কার্যক্রম পরিকল্পনা করবেন।
  • শ্রেণীতে এমন কিছু কাজ দিবেন যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে, সবাই মতামত দিতে পারে এবং যুক্তি দিতে পারে।
  • শিক্ষার্থীদেরকে ভালো কাজের জন্য উৎসাহিত (জবরহভড়ৎপব) করুন। যাতে একে অপরের মতামতকে শ্রদ্ধা করতে শিখে।
  • সহযোগিতামূলক খেলার ব্যবস্থা করা

অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা

এ বুদ্ধিমত্তা যাদের প্রবল তারা একাকী চিন্তা ও কাজ করে সহজে শেখে।        

অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ:

  • একাকী থাকতে পছন্দ করে।
  • কম কথা বলে।
  • অধিক চিন্তা করে।
  • নিজে নিজে শিখতে চায়।
  • নিজের সম্বন্ধে সচেতন থাকে।
  • কোন ঘটনার পূর্বাভাস সহজে অনুমান করতে পারে।
  • একাকী কাজে উৎসাহী হয়।
  • নিজের সবলতা ও দূর্বলতা সহজে বুঝতে পারে।
  • সামাজিক কর্মকান্ড থেকে নিজেকে দূরে রাখে।      

অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তার শিখন প্রক্রিয়া

  • নিজ নিজ কাজ পরিকল্পনা করতে দিন। কাজের পর আত্ম প্রতিফলনের সুযোগ করে দিন।
  • লেখার ভিতর দিয়ে তাদের অভিব্যক্তির ইতিবাচক প্রকাশকে উৎসাহিত করুন।
  • ব্যক্তিগত ডায়রি ব্যবহারে উৎসাহিত করুন। নিজের জীবন কথা বা ঘটনা, নিজের শিখন অভিজ্ঞতা ইত্যাদি ডায়রিতে লিখতে উৎসাহিত করুন।
  • পাঠ শেষে কী শিখতে অসুবিধা হয়েছে জিজ্ঞেস করুন।

প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা

এ বুদ্ধিমত্তা যাদের প্রবল তারা প্রকৃতির গাছপালা, পশুপাখি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে সহজে শেখে।

প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তার লক্ষণসমূহ:

  • গাছপালা ও পশুপাখি পর্যবেক্ষণ করতে পছন্দ করে।
  • পশুপাখি ও গাছপালার বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করতে পছন্দ করে।
  • গাছপালা ও পশুপাখি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পছন্দ করে।
  • গাছ লাগাতে এবং যত্ন করতে ভালবাসে।
  • জীব জগতের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করে।
  • প্রাণী ও উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করতে পছন্দ করে।    

প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তার শিখন প্রক্রিয়া:

  • শিখন শেখানোর সময় শিক্ষার্থীদেরকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিয়ে যান যাতে শিশুরা পাঠগ্রহণের পাশাপাশি প্রকৃতিকে উপভোগ করতে পারে।
  • প্রকৃতিতে যা কিছু বৈচিত্র্য আছে (যেমন : গাছপালা, আবহাওয়া ইত্যাদি) তার সাথে বিষয়বস্তুর সম্পর্ক স্থাপন করতে সহায়তা দিন।
  • ফিল্ড ট্রিপ এর ব্যবস্থা করুন।
  • এ্যাকুরিয়ামে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সংগ্রহ রাখুন।

বহুমুখী বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা হয় আকর্ষণীয়, এতে শিশুর সুপ্ত প্রতিভার স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং প্রতিটি শিশুর মধ্যে জোরালো বুদ্ধিমত্তাকে শিখনের কাজে ব্যবহার করা যায়। ফলে শিখন প্রক্রিয়া আনন্দদায়ক হয়। অন্যদিকে কোনো শিশুর যেসব বুদ্ধিমত্তা কম, অন্যদের জোরালো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় সেগুলোও শক্তিশালী হয়।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।