মূল্যবোধ কী? মূল্যবোধের গুরুত্ব ও উৎস
মূল্যবোধ কী? মূল্যবোধের গুরুত্ব
ও উৎস
আলোচ্য বিষয়:
Ø মূল্যবোধ বলতে আপনি কী বুঝেন? মূল্যবোধের প্রধান কয়েকটি উৎস আলোচনা করুন।
Ø
শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ গঠনের উৎসগুলোর নাম
লিখুন।
Ø পেশাগত ক্ষেত্রে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুরুত্ব আলোচনা করুন।
Ø
নৈতিক মূল্যবোধের কয়েকটি উৎসের লিখুন।
Ø
শিশুর মূল্যবোধ বিকাশে পরিবার, সহপাঠী ও
বিদ্যালয়ের ভূমিকা বর্ণনা করুন।
মূল্যবোধ বলতে আপনি কী বুঝেন? মূল্যবোধের প্রধান কয়েকটি উৎস আলোচনা করুন।
মূল্যবোধ হলো মানুষর এমন ধরণের কিছু মৌলিক বিশ্বাস যা তার মনোভাব ও কাজকর্মকে অনুপ্রাণিত করে। অর্থাৎ কোন ধরণের কাজ আমাদের করা উচিত বা উচিত নয় তা মূল্যবোধের দ্বারা প্রভাবিত হয়। শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে গঠিত হয়। মূল্যবোধের প্রধান কয়েকটি উৎস সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো:
ধর্ম:
মূল্যবোধের অন্যতম প্রধান উৎস হলো ধর্ম। ধর্ম মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধ তথা সত্যবাদিতা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হতে শিক্ষা দেয়। ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। শৈশবকাল থেকে যে ব্যক্তি যে ধর্মে বিশ্বাসী সে ব্যক্তি সেই ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে লালিত হয় এবং সেই ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তীকালে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে প্রতিফলিত হয়। এককথায়, ধর্মীয় আচর-অনুষ্ঠান ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
পরিবার:
বর্তমান সময়ে শিশুর মূল্যবোধ বিকাশের অন্যতম প্রধান উৎস হলো পরিবার। পরিবারের প্রত্যক্ষ পরিচর্চায় শিশুর ভবিষ্যৎ অর্থবহ জীবন গঠনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। পরিবারের কাছের মানুষগুলোর সান্নিধ্যে ও প্রভাবে তাদের মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। যার ফলে শিশুর মধ্যে বিভিন্ন ইতিবাচক মূল্যবোধ যেমন সততা, বিনয়, নম্রতা-ভদ্রতা, সহযোগিতা, আতিথেয়তা, শ্রদ্ধা বা সম্মান করা, মান্য করা, পারস্পরিক সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া, শ্রমের মর্যাদা দেওয়া, সেবা করা, ভালবাসা ইত্যাদি বহুবিধ মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে সঠিক পরিচালনা ও তত্ত্ববধানের অভাবে শিশুর মধ্যে নানা ধরনের নেতিবাচক বা বিপরীত মূল্যবোধ যেমন অসততা, অন্যায়, মিথ্যাচার, উচ্ছৃঙ্খলতা, হিংসা, ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ইত্যাদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান:
জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা মূল্যবোধের আরেকটি উৎস। এর মাধ্যমে প্রাপ্ত শিক্ষণীয় বস্তু শিশুর মূল্যবোধ গঠনে অন্যতম ভূমিকা রাখে। একজন ব্যক্তি অন্য কোন উৎস থেকে প্রাপ্ত মূল্যবোধ সত্যি সত্যিই তার জীবনের বা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিনা তা যাচাই করার জন্য বিজ্ঞানের জ্ঞান ও প্রক্রিয়া ব্যবহার করে থাকে। যেমন- অনেক সমাজেরই একসময় ছেলে মেয়ের অল্পবয়সেই বিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলি মানুষের কাছে পরিষ্কার হওয়ায় এখন মানুষ সেই রীতি থেকে সরে এসেছে।
সাহিত্য-সংস্কৃতি:
যে জাতি বা গোষ্ঠীর জীবনে সাহিত্য-সংকৃতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়। বলা যায় সাহিত্য-সংস্কৃতি হলো বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর তাদের নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, ভাষা, প্রথা ও রীতিনীতি, জীবন-প্রনালী, শিল্পচর্চার একটি সামগ্রিক ও দৃশ্যমান রূপ। সুতরাং মূল্যবোধ গঠনে এর প্রভাব গুরুত্ববহ। যেমন- ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নাচ ও গান জীবনযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাই দেখা যায় ভারতীয়দের মধ্যে অনেকে গান ও নাচ জানেন; ভারতের বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রসমূহে গান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পারিবারিক অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নাচ ও গানের ব্যবস্থা থাকে।
শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান:
মূল্যবোধের আরেকটি অন্যতম প্রধান উৎস হলো শিক্ষ প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী নানান ধরণের অনেক মূল্যবোধ অর্জন করতে পারে। পাঠ্যবইয়ের গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ গঠিত হয়। বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাক্রমিক ও সহশিক্ষাক্রমিক কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ বিকাশে সহায়তা করা যায়। আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ বিকাশে গুরুত্ব দিয়ে তার যথাযথ পরিকল্পনা করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও বেশকিছু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো ব্যক্তি মানুষ ও শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ গঠনের উৎস হিসাবে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, প্রধান সারির পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।পেশাগত ক্ষেত্রে
মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুরুত্ব আলোচনা করুন।
পেশাগত
মূল্যবোধ বলতে পেশাজীবীর দায়িত্ব-কর্তব্য ও কজের আচরণ নির্দেশনাদানকারী
নীতিমালাকে বোঝায়। এধরনের মূল্যবোধ কোন পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য কতকগুলো
কেন্দ্রীয় আদর্শাবলি। ক্রিসি সিভিকের
মতে, “পেশাগত
মূল্যবোধ হলো সেসব নীতিমালা বা আদর্শ যেগুলোর আলোকে পেশাগত সিধান্ত গ্রহণ ও
কার্যক্রম পরিচালিত হয়।”
উদাহরণস্বরূপ,
শিক্ষকতা পেশা সম্পর্কিত একটি মূল্যবোধ হচ্ছে সকল শিক্ষার্থীকে
সমান চোখে দেখা। আশা করা হয় শিক্ষক শিখন-শেখানো কার্যাবলি পরিচালনার সময় সকল
শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবেন। পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সাধারণত
কোন পেশাজীবী সদস্যদের দ্বারাই নির্ধারণ হয়।
সদস্যরাই নির্ধারণ করেন কোন কাজটি করতে হবে, কোনটি করা
উচিত, কোনটি অনুচিত বলে বিবেচিত হবে। যদিও কতকগুলো
মূল্যবোধ নির্দিষ্ট কতকগুলো পেশার অনান্য মূল্যবোধের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ
বিবেচিত হয়, তথাপি এমন কিছু মুখ্য মূল্যবোধ আছে যেগুলো
সচরাচর সকল পেশায় ধারণ ও চর্চা করা বাঞ্ছনীয়। যেমন-দায়বদ্ধতা, চারিত্রিক সত্যশীলতা, সমবেদনা, উৎকর্ষ, সততা, পেশাগত
দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য, ইত্যাদি।
শিক্ষার্থীদের
মূল্যবোধ গঠনের উৎসগুলোর নাম লিখুন।
মূল্যবোধ
গঠনের নানা ধরণের উৎস রয়েছে। যেমন –
v
পরিবার,
v
বন্ধু-বান্ধব
ও সমদল,
v
শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান,
v
ধর্ম
ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,
v
আর্থ-সামাজিক
অবস্থা,
v
সাহিত্য-সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্য,
v
লোকাচার
ও সামাজিক রীতি-নীতি
এছাড়া
আইন, বিধি-বিধান
ও প্রথা, পেশা, বই, সঙ্গীত, গণমাধ্যম, নিয়োগদাতা
প্রতিষ্ঠান, সহকর্মী ও দেশের বিশেষ বিশেষ অঞ্চল থেকে আমরা
নানা ধরনের মূল্যবোধ লাভ করতে পারি।
নৈতিক মূল্যবোধের
কয়েকটি উৎসের লিখুন।
ব্যক্তির
সার্বিক মূল্যবোধ গঠনের জন্য নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। নৈতিক মূল্যবোধ
সৃষ্টির জন্য বেশকিছু উল্লেখযোগ্য উৎস রয়েছে যেগুলোর প্রতি শ্রেণিকক্ষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব রয়েছে। সেগুলো হলো:
v
বিশ্বস্ততা
(trustworthiness),
v
শ্রদ্ধা
(respect),
v
দায়িত্ব
(responsibility),
v
ন্যায্যতা
(fairness),
v
যত্নশীল
(caring) ইত্যাদি।
শিশুর মূল্যবোধ বিকাশে
পরিবার,
সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের ভূমিকা বর্ণনা করুন।
দেশ
ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির
বিকাশ ঘটানো খুবই জরুরি। শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ বিকাশের
বিষয়টি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের ত্রিভুজ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
শিক্ষার্থীদের একটি ‘চারাগাছ’ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, যার সুন্দর ও যথাযথভাবে
বেড়ে উঠা নির্ভর করে পরিচর্যার উপর। পরিচর্যা যেমন হবে তার বেড়ে উঠাও তেমন হবে।
শিশুর
মূল্যবোধ বিকাশে পরিবারের ভূমিকা সর্বাধিক। এরপর আসে সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের ভূমিকা।
শিশুর মূল্যবোধ বিকাশে পরিবার, সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের ভূমিকা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
v
শিশুর
দৈহিক, মানসিক,
পার্থিব ও অপার্থিক যাবতীয় প্রয়োজন মেটায় পরিবার। কীভাবে কথা
বলতে হবে, নিজের আবেগ কীভাবে প্রকাশ করা যায়, তা শিশু পরিবার থেকে শিক্ষালাভ করে।
v
পারিবারিক
মূল্যবোধ সাধারণত এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী পরজন্মে সঞ্চালিত হয়। পরিবার শিশুদের
একটি কাঠামো ও পরিসীমা দেয় যেখানে তারা কাজ করবে ও জীবনযাপন অতএব পরিবারের কাজ
হবে শিশুদের পারিবারিক মূল্যবোধ বিকাশে পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করা। যেমন-
পরিবারের সবাই মিলে একত্রে খাবার খাওয়া,
দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনে বিনোদন ও বিশ্রামের সময়সূচিও সবাই
মিলে করা একসাথে উৎযাপন করা, আদব-কায়দা অনুশীলন করা
ইত্যাদি।
v
শিশুর
উপর সবচেয়ে বেশি পড়ে প্রভাব থাকে তার সহপাঠীদের। শিশুর মূল্যবোধ সৃষ্টিতে তার
সঙ্গী বা খেলার সঙ্গীরা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। শিশু তার খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে
মেলামেশা করলে তার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি পরিস্ফুট হয়। সে স্বাবলম্বী হতে
শেখে। শিশু তার পরিবার থেকে যে মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠেছে সেই ধরনের
মূল্যবোধসম্পন্ন সহপাঠীদের সাথেই সাধারণত সে বন্ধুত্ব করে। সেক্ষেত্রে শিশুর
মূল্যবোধ একটি মজবুত ভিত্তি পায়। কিন্তু মূল্যবোধের সাথে সমন্বয় না হলে শিশু
অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিধাহীনতায় ভুগে। তখনই মূল্যবোধের অবক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা
থাকে।
v
মূল্যবোধের
ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সভ্যরা যাতে
সামাজিক মূল্য, সামাজিক
আদর্শ, সামাজিক অভ্যাসগুলো আয়ত্ত করতে পারে সেজন্য
প্রত্যেক সমাজ প্রতিটি সভ্যকে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের শিক্ষাদান করে। সমাজ তার
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানদান করে।
v
পরিবার
ও বিদ্যালয় বন্ধু নির্বাচনে সঠিক মনিটরিং ও দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে শিশুর
মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
মতামত দিন