শিক্ষার্থী উন্নয়নের ধারণা

শিক্ষার্থী উন্নয়নের ধারণা

Concept of student development

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক পরিসরে শিক্ষার্থীকে অভিযোজিত করতে হলে শুধুমাত্র একমুখী চিন্তায় পারদর্শী করে গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষাসেবায় তথ্যপ্রযুক্তির লাগসই সংযোজনের মতো পদক্ষেপগুলো শিক্ষা কাঠামোয় ইতিবাচক রূপান্তর এনে দিয়েছে।

তবে আমরা আজ উন্নয়নের যাত্রাপথে যে যুগসন্ধিক্ষণে উপণীত, সেইক্ষণে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে দক্ষ জনশক্তির বিকাশকে নির্বিঘ্ন ও সাবলীল রাখতে সক্ষমতার সর্বোত্তম স্তরে পৌঁছে দেওয়া সময়ের চ্যালেঞ্জ।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে একটি আধুনিক, মানবিক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীর উন্নয়নকে বিবেচনায় নেওয়া। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষককে প্রস্তুত করে তোলা।

  শিক্ষার্থী উন্নয়নের জন্য কতিপয় দক্ষতা

  • Ø  সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা (Critical Thinking Skill)
  • Ø  সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা (Creative Thinking Skill)
  • Ø  সমস্যা সমাধান দক্ষতা (Problem Solving Skill)
  • Ø  সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা (Decision Making Skill)
  • Ø  যোগাযোগ দক্ষতা (Communication Skill)
  • Ø  স্ব-বিশ্লেষণ দক্ষতা (Self-analysis Skill)
  • Ø  ব্যবস্থাপনা দক্ষতা (Self-management Skill)
  • Ø  সহযোগিতামূলক দক্ষতা (Collaboration Skill)
  • Ø  বিশ্ব নাগরিকত্ব দক্ষতা (Global Citizenship Skill)
  • Ø  জীবিকায়ন দক্ষতা (Employability Sk)

 ১। সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা (Critical Thinking Skill)

কোনো বিমূর্ত ও তাত্তি¡ক বিষয় বা বাস্তব জীবনের সমস্যা অনুপুঙ্খভাবে অনুধাবন বা সমাধান করার জন্য তথ্য- উপাত্ত অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করার বিশেষ ধরনের পদ্ধতিগত চিন্তন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারাকে সূক্ষ চিন্তন দক্ষতা (ঈৎরঃরপধষ ঞযরহশরহম) নামে অভিহিত করা হয় । অধিকাংশ সময়েই মানুষ সচেতনভাবে উপলব্ধি করতে না পারলেও সূক্ষ্ম চিন্তন করার সময় সে আসলে চিন্তনের কতগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ ধাপ অনুসরণ করে কোনো একটি সমাধান বা সিদ্ধান্তে পৌছায়। এমন দক্ষতায় পারদর্শী শিক্ষার্থীরা যে কোনো জটিল বিষয় নিয়ে কাজ করার সময় অনুসন্ধানী দৃষ্টিকোণ থেকে একাধিক সূক্ষ্ম দক্ষতাকে সমন্বয় করে কাজ করেন, যেমন বিষয়টির ধরন অনুযায়ী চিন্তার কৌশল নিয়ে চিন্তা করা, অনুসন্ধানী প্রশ্ন করার কৌশল অনুসরণ, বিশ্লেষণ, সংযোজন ও যৌক্তিকতা নির্ধারণ ইত্যাদি। এর ফলে জটিল বিষয় নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।

 ২। সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা (Critical thinking skills)

গতানুগতিক চিন্তাভাবনার বাইরে নিজস্ব মতামতের মাধ্যমে নতুন ধারণা সৃষ্টি ও বাস্তবায়নের দক্ষতাই সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা। এমন দক্ষতায় পারদর্শী শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করার সময় গতানুগতিক চিন্তা ধারার পরিবর্তে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করে; এর মাধ্যমে যেমন নতুন কৌশল ও উপায় বেরিয়ে আসে, তেমনি নতুন পথের এবং সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। পরিবর্তনশীল বিশ্বে এমন দক্ষতাই ব্যক্তি ও সমাজকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।

 ৩। সমস্যা সমাধান দক্ষতা (Problem Solving Skill)

সমস্যা চিহ্নিত করে পদ্ধতিগতভাবে সে সমস্যার সহজ সমাধানে উপনীত হওয়ার দক্ষতাই সমস্যা সমাধান দক্ষতা। সমস্যা সমাধানের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চর্চা করার মধ্য দিয়ে এই দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে তা বিশ্লেষণ করা, সে অনুযায়ী সমাধানের সম্ভাব্য উপায়সমূহ যাচাই বাছাই করে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

 ৪। সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা (Decision Making Skill)

পরিস্থিতি অনুধাবন করে কোনো সমস্যার তথ্যভিত্তিক একাধিক সমাধানে উপনীত হওয়া এবং যৌক্তিকভাবে একটি সমাধান বাছাই করাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা। অনেকেই যৌক্তিক চিন্তা না করেই সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে যারা পারদর্শী তারা সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়েটিকে চিহ্নিত করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেন, এরপর সম্ভাবনা ও ঝুঁকি বিবেচনা করে সম্ভাব্য উপায়সমূহ যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।

 ৫। যোগাযোগ দক্ষতা (Communication Skill)

কার্যকর এবং সহজবোধ্যভাবে তথ্য বা মতামত প্রকাশ করার দক্ষতাই যোগাযোগ দক্ষতা। আমরা মৌখিক, অভিব্যক্তি এবং লিখিত বার্তা ব্যবহার করে তথ্য, মতামত, অনুভতি ইত্যাদি প্রকাশ করি। এক্ষেত্রে সক্রিয় শ্রবণ, উপস্থাপন শৈলী, আগ্রহের সাথে বার্তা দেয়া-নেয়ার দক্ষতার সমন্বিত প্রয়োগ যোগাযোগ দক্ষতাকে বৃদ্ধি করে।

 ৬। স্ব-বিশ্লেষণ দক্ষতা (Self-analysis Skill)

কোনো বিষয়ের তথ্য, সংশ্লিষ্ট কাজ অনুপূঙ্খভাবে খুঁজে দেখে সমস্যার সঠিক সমাধান করতে পারাই হলো স্ব- বিশ্লেষণ দক্ষতা। স্ব-বিশ্লেষণ দক্ষতা হল নিজের শক্তি, দুর্বলতা, চিন্তাভাবনা, অনুভতি এবং আচরণ সম্পর্কে সচেতন থাকার এবং বোঝার ক্ষমতা। এটি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ দক্ষতা।

শিক্ষার্থী যদি বিশেষ দিনে বিশেষ কোন অনুষ্ঠানে যেতে চায় সে জন্য কি পোষাক পরবে তা নির্ধারণ করতে ও বিশ্লেষণ করতে হয়।

শিক্ষার্থী নিজেকে প্রশ্ন করতে পারে:

v  আমি এখানে কি তথ্য বিবেচনা করছি?
v  আমি কি বিশ্লেষণ করব?
v  আমি কি কারো কাছে পরামর্শ চাইব?
v  কার কাছে পরামর্শ চাইতে হবে?
v  কি ধরণের অনুষ্ঠান?
v  কোন ধরণের লোকের সমাগম হবে?
v  কেমন রঙের পোষাক পরতে হবে?
ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিবে যে কোন পোষাক পরতে হবে।

 ৭। স্ব-ব্যবস্থাপনা দক্ষতা (Self-management Skill)

সমৃদ্ধ জীবন ও উন্নত সমাজ গঠনে ব্যক্তির বিভিন্ন দক্ষতার পাশাপাশি প্রয়োজন স্ব-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কার্যকরভাবে আত্ম-পরিচর্যা বা নিজেকে ইতিবাচকভাবে পরিচালিত করার সক্ষমতা অর্জন করে ভালো থাকা। এজন্যে বিশেষ কিছু দক্ষতার সমন্বয় প্রয়োজন, যেমন আত্ম সচেতনতা ও আত্ম-বিশ্লেষণ করার দক্ষতা, আবেগিক বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক বুদ্ধিমত্তা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ, পারষ্পরিক সম্পর্কের ফলপ্রসূ ব্যবহার, প্রাত্যহিক জীবন যাপন দক্ষতা এবং সর্বোপরি সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা।

 ৮। সহযোগিতামূলক দক্ষতা (Collaboration Skill)

কোন কাজ সম্পাদনে ও উৎকর্ষতা অর্জনে পারষ্পরিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্যে প্রয়োজন সম-মনোভাব ও দলগত চেতনা সৃষ্টি করা। বৈচিত্রকে মূল্য দিয়ে বিভেদ কমিয়ে আনা, সহযোগিতার ক্ষেত্র ও কার্যক্রম সুনির্দিষ্ট করা এবং কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে সহযোগিতার পরিধি প্রসারিত করা মুলত এই দক্ষতার অন্তর্গত।

৯। বিশ্ব নাগরিকত্ব দক্ষতা (Global Citizenship Skill)

বিশ্ব নাগরিকত্ব হল এমন একটি ধারণা যা মানুষকে বৈশি^ক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট উপলব্ধি করে সেখানে তার অবস্থান সুনির্দিষ্ট করতে সহায়তা করে। বিশ্ব নাগরিকত্বের দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার নিজ পরিসর, সমাজ, সংস্কৃতি তথা দেশে সক্রিয় ভুমিকা পালন করে একটি যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন করেন যা বৈষম্যহীন বিশ্ব তৈরিতে এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে। বিশ্ব নাগরিকত্বের দক্ষতাসম্পন্ন প্রজন্ম দেশ তথা বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত উন্নয়নে সক্রিয় ভুমিকা পালন করে। বৈশ্বিক নাগরিকত্ব মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে সকলের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, সহনশীল, একীভ, সুরক্ষিত এবং টেকসই বিশ্ব গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে।

১০। জীবিকায়ন দক্ষতা (Employability Skill)

কর্মজগতের জন্য প্রস্তুত হতে এবং নিজেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে যে দক্ষতাসমুহ প্রয়োজন তাই হচ্ছে জীবিকায়ন দক্ষতা। কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার পাশাপাশি নিজের কাজ নিজে করতে পারার দক্ষতা, আর্থিক সাক্ষরতা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দক্ষতা, ব্যবসায়িক যোগাযোগ ও উদ্যোক্তা হওয়ার দক্ষতা, কর্মক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতা, নিরাপত্তা ও চাকুরি অনুসন্ধানের দক্ষতা, ভবিষ্যত কর্মদক্ষতা সুনির্দিষ্ট পেশায় নিয়োগের যোগ্যতা বৃদ্ধি করে। এসকল দক্ষতাসমূহের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের সাথে সাথে নতুন কর্মে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। 

শিক্ষার্থী উন্নয়নে শিক্ষাক্রমে প্রদত্ত দক্ষতাসমূহ অর্জনের গুরুত্ব

  • v  অন্যের মতামত ও অবস্থানকে সম্মান ও অনুধাবণ করা;
  • v  প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিজের ভাব ও মতামত যথাযথ মাধ্যমে সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করা;
  • v  সূক্ষ্মচিন্তনের মাধ্যমের সামগ্রিক বিষয়সমূহ বিবেচনা করে সকলের জন্য যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে পারা;
  • v  ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে সম্মান করে নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা প্রদর্শনপূর্বক বিশ্ব নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন করা;
  • v  সমস্যার প্রক্ষেপণ, দ্রæত অনুধাবন, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ তাৎপর্য বিবেচনা করে সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে ও সমাধান করতে পারা;
  • v  পার¯পরিক সহযোগিতা, সম্মান ও স¤পীতি বজায় রেখে শান্তিপর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারা এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরিতে ভমিকা রাখতে পারা;
  • v  নতুন দৃষ্টিকোণ, ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের মাধ্যমে নতুনপথ, কৌশল ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করে শৈল্পিকভাবে তা উপস্থাপন এবং জাতীয় ও বিশ্বকল্যাণে ভমিকা রাখতে পারা;
  • v  নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে নিজ অবস্থান ও ভমিকা জেনে ঝুঁকিহীন নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক স¤পর্ক ও যোগাযোগ তৈরি করতে ও বজায় রাখতে পারা;
  • v  প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পৃথীবিতে ঝুঁকি মোকাবেলা এবং মানবিক মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন ও জীবিকার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারা;
  • v  পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে দৈনন্দিন উদ্ভুত সমস্যা গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে সমাধান করতে পারা;
  • v  ধর্মীয় অনুশাসন, সততা ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন এবং শুদ্ধাচার অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকৃতি ও মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারা।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।