হিন্দু ধর্মের মুল ধর্মগ্রন্থ : বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা
হিন্দু ধর্মের মুল ধর্মগ্রন্থ : বেদ, উপনিষদ,
পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা
হিন্দু ধর্মের মুল ধর্মগ্রন্থ সমূহ বর্ণনা দিন।
হিন্দু
ধর্মগ্রন্থের মূল বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মীয় কথার মাধ্যমে ভক্তকে নানান উপদেশনা প্রদান
। যেমন- ঈশ্বরের কথা, দেব-দেবীর উপাখ্যান, সমাজ ও জীবন
সম্পর্কে নানা উপদেশ। হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ বা বেদ সংহিতা। এ ছাড়াও
রয়েছে উপনিষদ, পুরাণ, তন্ত্রশাস্ত্র,
রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, চন্ডী প্রভৃতি।
হিন্দুধর্মে
দুই শ্রেণির গ্রন্থ আছে। যথা:শ্রুতি ও স্মৃতি। এই দুটি গ্রন্থকে ঐশীগ্রন্থ হিসেবে
বিবেচনা করা হয়।
শ্রুতি: ‘শ্রুতি’ শব্দের অর্থ যা শ্রবণ করা যায় এবং
যা উপলব্ধি করা যায়। শ্রুতি হিন্দুদের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ। শ্রুতিকে দুই
ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ১. বেদ এবং ২. উপনিষদ।
স্মৃতি: ‘স্মৃতি’ শব্দের অর্থ যা মনে রাখা হয়।
শ্রুতির মত স্মৃতি খুব বেশি প্রাচীন গ্রন্থ নয়। ‘স্মৃতি’কে ঐশীগ্রন্থ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়
না। তবুও আজ হিন্দুদের মধ্যে ‘স্মৃতি’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। ‘স্মৃতি’ মানুষের লেখা।
স্মৃতির মধ্যে হিন্দুর জীবনবিধান ও ধর্মাচরণের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ আছে। স্মৃতি তাই ধর্মশাস্ত্র
রূপে পরিচিত। স্মৃতিকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ক. পুরাণ ও খ. মহাকাব্য।
বেদ কী?
‘বেদ’ শব্দটি এসেছে
সংস্কৃত ‘বিদ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ জানা। তাই ‘বেদ’ শব্দটির অর্থ
‘সর্বোত্তম
জ্ঞান’।
বেদকে চারভাগে ভাগ করা হয়; যথা- ঋক্, সাম, যজুঃ,
অথর্বপতঞ্জলির মহাবৈশ্যের মতে, ঋগ্বেদের
২১টি শাখা আছে, অথর্ববেদের ৯টি শাখা আছে, যজুর্বেদের ১০১টি শাখা আছে, সামবেদের ১০০০টি
শাখা আছে। অর্থাৎ বেদের সর্ব মট শাখা ১১৩১টি। এর মধ্যে মাত্র এক ডজন সহজলভ্য।
ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ এবং সামবেদ অধিকতর
প্রাচীন গ্রন্থ। এদের ‘বিদ্যাত্রয়ী’ বা ‘বিজ্ঞানত্রয়ী’ বলা হয়। এদের
মধ্যে ঋগ্বেদ প্রাচীনতম। ঋগ্বেদ লিপিবদ্ধ করা হয় তিনটি দীর্ঘকালের ব্যবধানে। চতুর্থ
বেদ হল অথর্ববেদ যা অপেক্ষাকৃত নবীন। ঋগ্বেদে আছে স্তুতি গান। যজুর্বেদে আছে আত্মত্যাগের
নিয়মনীতি। সামবেদ সঙ্গীতমুখর। অথর্ববেদে আছে রোগ নিরাময়ের ম্যাজিক ফরমুলা।
উপনিষদ কী?
‘উপনিষদ’ শব্দটি বিভাজন
করলে পাওয়া যায় ‘উপ-নি-ষদ। উপ-এর অর্থ ‘কাছে। নি’-র অর্থ ‘নিচে’, ‘ষদ’-এর অর্থ ‘বসা। একসঙ্গে করলে ‘উপনিষদের অর্থ
দাঁড়ায় ‘নিচে কাছে বসা। প্রাচীনকালে শিষ্যরা গুরুদেবের পায়ের কাছে বসে যে পবিত্র
ধর্মজ্ঞান লাভ করতেন তা-ই উপনিষদ।
বেদ
গ্রন্থের দুটো ভাগ। যথা: কর্মকান্ড ও জ্ঞানকান্ড। কর্মকান্ডে কর্মবিষয়ক এবং
জ্ঞানকান্ডে জ্ঞানবিষয়ক উপদেশ বিদ্যমান। এই জ্ঞানকান্ডই হচ্ছে উপনিষদ। উপনিষদকে
ব্রহ্মবিদ্যা এবং গূঢ় বিদ্যাও বলা হয়ে থাকে। এতে আছে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উপদেশ।
যে তত্ত্ব জ্ঞানের দ্বারা পরমেশ্বরের নিকট বাস করা যায় তাকেই উপনিষদ বলা হয়।
বেদের ‘অন্ত’ বলে একে বেদান্তও
বলা হয়।
উপনিষদের
সংখ্যা শতাধিক। তাদের মধ্যে প্রধান ১২ খানার নাম-ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুন্ডক, মান্ডুক্য,
তৈত্তিরীয়, ঐতরেয়, শ্বেতাশ্বতর, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক ও কৌষীতকি উপনিষদ।
পুরাণ কী?
হিন্দু ধর্মাবম্বীদের মধ্যে
বহুল পঠিত শাস্ত্র হলো ‘পুরাণ’। ‘পুরাণ’ শব্দটির অর্থ হলো ‘প্রাচীন’। এই গ্রন্থে
সৃষ্টির ইতিহাস ছাড়াও আর্য ধর্মের ইতিহাস,
স্বর্গীয় আত্মাদের গল্প ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। পুরাণ ধর্ম
গ্রন্থটির আবির্ভাব ঠিক বেদের পরেই।
মহর্ষি
বৈশ্য পুরাণ গ্রন্থটিকে আঠার খন্ডে ভাগ করেন। এই খন্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ খন্ডটি হলো ভবিষ্যপুরাণ। ভবিষ্যপুরাণ নামকরণের অন্যতম কারণ হলো এত
ভবিষ্যৎ বাণী করার হয়েছে অর্থাৎ আগাম ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। হিন্দুরা একে স্বয়ং
ঈশ্বরের বাণী মনে করে।
রামায়ণ কী? রামায়ণে কয়টি কান্ড রয়েছে এবং কী কী?
হিন্দুদের
উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় গ্রন্থ হলো রামায়ণ। রামায়ণ আদিকাব্য নামেও পরিচিত। পৃথিবীর
অন্যতম শ্রেষ্ট চারটি মহাকাব্যের মধ্যে রামায়ণও অন্যতম একটি মহাকাব্য। রামায়ণ
সংস্কৃত ভাষায় রচিত যার রচয়িতা হলেন মহর্ষি বাল্মীকি।
রামায়ণের উপাখ্যানসমূহের মধ্যে রয়েছে ধর্মের দর্শন
ও সুমহান আদর্শের পরিচয়। সমগ্র রামায়ণ সাতটি ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগকে কান্ড
বলে। এই সাতটি কান্ড হচ্ছে:
১) আদি কান্ড ,
২) অযোধ্যা কান্ড ,
৩) অরণ্য কান্ড ,
৪) সুন্দর কান্ড ,
৫) কিষ্কিন্ধ্যা কান্ড ,
৬) লঙ্কা কান্ড এবং
৭) উত্তর কান্ড ।
মহাভারত কী? মহাভারতে কয়টি পর্ব আছে এবং কী কী?
মহাভারত
হলো স্মৃতি গ্রন্থ। এটিও রামায়ণের মতো ধর্মীয় শাস্ত্র হিসাবে মান্য করা হয়। এটি
সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেছেন ব্যাসদেব। তাঁর মূল নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। কাশীরাম দাস, কালীপ্রসন্ন সিংহ ছাড়াও আরও
অনেকেই মহাভারত রচনা করেন। তবে এঁদের মধ্যে কাশিরাম দাসের অনবাদ করা মহাভারত
রচনাটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়।
মহাভারত-এর মূল উপজীব্য
বিষয় হলো কৌরব ও পান্ডবদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি।
মহাভারতে মোট আঠারোটি পর্ব আছে। পর্বগুলো হলো:
১
) আদি পর্ব, ২)
সভা পর্ব, ৩) বন পর্ব, ৪) বিরাট
পর্ব, ৫) উদ্যোগ পর্ব, ৬) ভীষ্ম
পর্ব, ৭) দ্রোণ পর্ব, ৮) কর্ণ
পর্ব, ৯) শল্য পর্ব, ১০) সৌপ্তিক
পর্ব, ১১) স্ত্রী পর্ব, ১২)
শান্তি পর্ব, ১৩) অনুশাসন পর্ব, ১৪)
আশ্বমেধিক পর্ব, ১৫) আশ্রমবাসিক পর্ব, ১৬) মৌসল পর্ব, ১৭) মহাপ্রস্থানিক পর্ব এবং
১৮) স্বর্গারোহণ পর্ব।
গীতা কী?
গীতার
পুরো নাম শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। গীতা হিন্দুদের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে পরিচিত
ধর্মগ্রন্থ। এটি মহাভারত মহাকাব্যের অংশ। এটি মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের একটি অংশ।
এতে
১৮টি অধ্যায় আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে বিপক্ষে আত্মীয়স্বজনদের দেখে
অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইলেন না। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অনেক উপদেশ দেন।
শ্রীকৃষ্ণের
মুখনিঃসৃত উপদেশই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। হিন্দু ধর্মে অর্জুনের উপদেশনার গুরুত্ব অধিক
বিবেচনায় এটিকে পৃথক একটি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়।
মতামত দিন