চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণ কী? চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণের গুরুত্ব

চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণ কী?  চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণের গুরুত্ব

Pre-service training and its importance

চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণ কাকে বলে?

চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণ হল পেশার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নূন্যতম স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। প্রত্যেক পেশার মানুষের কিছু পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে যা তাাঁর পেশাগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। একইভাবে যাঁরা শিক্ষক, তাঁদের কিছু পেশাগত বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন। যেমন, যিনি যে বিষয়ের শিক্ষক তার সে বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। আবার শুধু জ্ঞান থাকলেই হবে না, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। যে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চাই, তার থেকেও তা কীভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে সেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আবার জ্ঞান ছড়িয়ে দিলেই হবে না, যে বা যারা তা গ্রহণ করছে তারা আদৌ গ্রহণ করতে পারছে কিনা, পারলেও কতটা গ্রহণ করতে পারছে ইত্যাদিও দেখার বিষয়। আর তা সার্থকভাবে সম্পন্ন করতে হলে প্রয়োজন দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রায়োগিক জ্ঞান।

শিক্ষকদের সে সকল দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন এবং শিক্ষকগণের মধ্যে শিক্ষক সুলভ আচরণ তৈরি করার জন্য প্রয়োজন চাকুরি-পূর্ব প্রশিক্ষণ। অর্থাৎ দক্ষ শিক্ষক তৈরির জন্য উন্নতমানের শিক্ষক ও শিক্ষা কারিকুলাম, প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সুবিধাদি, শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কলাকৌশল, প্রযুক্তির ব্যবহার ও কারিকুলামের সঙ্গে মেলবন্ধন, তত্ত্বের কার্যকর প্রয়োগ তথা অনুশীলন, মূল্যায়ন এবং সর্বোপরি শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করার লক্ষ্যে মনোজগৎ তৈরির জন্য কাঠামোবদ্ধ বলয়ের মধ্যে প্রস্তুতির পূর্ব ধাপই হলো চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণ।

চাকুরিপূর্ব প্রশিক্ষণের গুরুত্ব

শিক্ষকতাকে যারা পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্যই চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক দক্ষতাসমূহ অর্জন করতে পারেন।

চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণের গুরুত্বসহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

শিক্ষকসুলভ আচরণ তৈরি: চাকরিপূর্র্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকসুলভ আচরণ তৈরি হয়। শিক্ষার্থীদের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক কেমন হবে, অভিভাবকদের সাথে কীভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে, কী ধরনের পোশক পরিধান করতে হবে, সমাজে কী ধরনের আচরণ করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে ভবিষ্যৎ শিক্ষকগণ পূর্ব ধারণা লাভ করেন চাকুরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।

শিক্ষকতার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ: যারা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী তাদের শিক্ষকতা পেশার বিভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য, বিদ্যালয় ও শ্রেণিকাজে শিক্ষকের ভমিকা তথা শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয়ের উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ সম্পন্ন হয় চাকুরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জন: শিক্ষকের সাফল্য ও জনপ্রিয়তা নির্ভর করে শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে কতটুকু বুঝতে পারছেন, তাদের আচরণ কতটুকু ইতিবাচকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন, তাদের কতটুকু উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন, তাদের মনোজগতকে কতটুকু উপলব্ধি করতে পারছেন ইত্যাদির ওপর। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকালীন আচরণ অনুশীলন করা এবং শিখন প্রক্রিয়াকে সেইভাবে চালিত করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা মনোবিজ্ঞান। শিক্ষা মনোবিজ্ঞান প্রয়োগমূলক বিজ্ঞান যেখানে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু শিখন-শেখানোর গতি-প্রকৃতি উপলব্ধি ও পুনর্গঠনের ধারণা, তত্ত¡, সূত্র ও তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু হচ্ছে- শিশু, প্রেষণা, আবেগ, বুদ্ধিমত্তা, মিথষ্ক্রিয়া ইত্যাদি। শিক্ষকতাকে যারা ভবিষ্যৎ পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী তারা চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার সাথে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।

শিক্ষা ব্যবস্থার উপাদানগুলোর পারস্পরিক যোগসূত্র স্থাপন: শিক্ষা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। কতগুলো উপাদানের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। উপাদানগুলো হলো- শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাক্রম, বিদ্যালয়, পরিবেশ, পরিবার ইত্যাদি। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সঠিকভাবে অর্জনের জন্য প্রয়োজন এগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন। শুধু একটি বা দুটি উপাদান দিয়ে কাঙ্খিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী, শিক্ষার্থী কোন ধরনের পরিবার ও পরিবেশ থেকে এসেছে, বিদ্যালয়ের চারপাশের পরিবেশ কী রকম ইত্যাদি সবকিছুর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর প্রতি আচরণ করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি। চাকুরি-পূর্ব প্রশিক্ষণকালীন তত্ত¡গত জ্ঞান অর্জন ও অনুশীলনের মাধ্যমে এই প্রস্তুতি নেওয়া যায়।

শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার দক্ষতা অর্জন: চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাকুরিতে যোগদানের পূর্বেই শিক্ষকতা পেশায় যোগদানে আগ্রহী ব্যক্তিগণ শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার দক্ষতাসমূহ অর্জন করতে পারেন। যা পরবর্তীতে তার পেশার ক্ষেত্রে আত্মবিশ^াস বৃদ্ধি করবে। শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পাঠ পরিচালনা সংক্রান্ত দক্ষতা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশিক্ষণ সম্পন্নকারী একজন নবীন শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের অনাকাঙ্খিত পরিবেশ সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। পূর্ব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব সহজেই বিভিন্ন মেধার শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। শিক্ষার্থীদেরকে শ্রেণিপাঠে মনোযেগী রাখার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে পাঠকে আনন্দদায়ক করতে পারেন। পাঠের কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজন সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতি। পূর্ব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে খুব অল্প সময়ে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে শিখনফল অর্জন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন।

নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন: শিক্ষকগণকে নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা এই দুটি গুণ খুব ভালোভাবে আয়ত্তে রাখতে হয়। এজন্য যারা শিক্ষকতাকে ভবিষ্যৎ পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী তাদের পূর্ব থেকেই নিয়মানুবর্তী ও সময়ানুবর্তী হতে হবে। চাকরিপূর্র্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীগণ নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন এবং চাকরিকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে পারেন।

বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যাবলি ও জাতীয় দিবস উদযাপনে পারদর্শিতা অর্জন: বিদ্যালয়ের যেসব রুটিনমাফিক বা দৈনন্দিন কার্যাবলি রয়েছে সেগুলো পূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন অংশগ্রহণকারী অর্জন করেন যা একজন নবীন শিক্ষক হিসেবে তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা করে। বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবস (যেমন- বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখ) উদ্যাপন করতে হয়। জাতীয় দিবস ও অন্যান্য দিবস উদযাপন সম্পর্কে ভবিষ্যৎ শিক্ষকগণ চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।

বিদ্যালয়ের অনাকাঙ্খিত পরিবেশ মোকাবিলার প্রস্তুতি: শিক্ষকগণকে যে কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে চলার দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। তা নাহলে বিদ্যালয়ে সৃষ্ট বিভিন্ন রকম অনাকাঙ্খিত পরিবেশ মোকাবিলা করতে পারবেন না, ফলে বিভিন্নরকম বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষকগণকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। শিক্ষক এই প্রস্তুতি শুরু করতে পারেন চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। চাকরিপূর্ব প্রশিক্ষণের পাঠদান অনুশীলন- এ সিমুলেশনের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন যা তার পরবর্তী কর্মজীবনে সহায়তা করে।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।