শিশুবান্ধব বিদ্যালয় পরিবেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব

শিশুবান্ধব বিদ্যালয় পরিবেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব (Leadership in creating a child friendly school environment)

নিরাপদ বিদ্যালয় কী?

প্রতিদিন স্কুলে এবং স্কুলের আশেপাশে নানা ধরণের বিপদ শিশুদের শিক্ষা ও সুরক্ষার অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলে। নিরাপদ স্কুল হলো সহিংসতা, প্রাকৃতিক ও দৈনন্দিন বিপদ ও সংঘাত থেকে স্কুলে এবং স্কুলের আশেপাশে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ। অর্থাৎ নিরাপদ বিদ্যালয় হলো যে কোন ধরনের সহিংসতা ও বিপদ মুক্ত বিদ্যালয়। যেমন: ধমক, বুলিং, যৌন হয়রানি, শারীরিক শাস্তি, মানসিক শাস্তি এবং সহিংসতা মুক্ত।

 শিশুবান্ধব বিদ্যালয় কী?

একটি শিশু-বান্ধব স্কুল হলো এমন একটি বিদ্যালয় যা শিশুদের মৌলিক অধিকার অর্জনকে স্বীকৃতি দেয় এবং লালন করে। তখনই একটি স্কুল শিশুবান্ধব বলে বিবেচিত হয় যখন এটি শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ, পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর এবং সুরক্ষামূলক পরিবেশ প্রদান করে। শিশুবান্ধব বিদ্যালয়ে শিশু অধিকার এবং সমস্ত শিশুকে সম্মান করা হয়।

নিরাপদ ও শিশুবান্ধব বিদ্যালয়ের গুরুত্ব

শিশুদের শিক্ষা ও বিকাশে বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই অবশ্যই শিশুর বিকাশের জন্য নিরাপদ ও শিশুবান্ধব পরিবেশের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

একটি শিশুবান্ধব বিদ্যালয় এমন একটি বিদ্যালয় যেখানে শিশুদের চাহিদা মেটাতে এবং তাদের শেখার জন্য একটি নিরাপদ এবং সহায়ক পরিবেশ প্রদান করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। একটি স্কুল শিশুবান্ধব কি না তা মূল্যায়ন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন অনেকগুলি মান এবং সূচক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শারীরিক পরিবেশ, পাঠ্যক্রম, শিক্ষাদান ও শেখার পদ্ধতি এবং উপলব্ধি সহায়তা পরিষেবার মতো বিষয়গুলি। একটি শিশু-বান্ধব স্কুল হলো এমন একটি স্কুল যেটি সমস্ত শিশুর পটভূমি বা ক্ষমতা নির্বিশেষে স্বাগত জানায় এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত করে। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে প্রতিটি শিশু নিরাপদ, মূল্যবান এবং সম্মানিত বোধ করে। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে শিশুরা শিখতে এবং বেড়ে উঠতে পারে এবং যেখানে তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছানোর সুযোগ দেওয়া হয়।

 একটি নিরাপদ বিদ্যালয় বিনির্মাণের ক্ষেত্রসমূহ

  • v  কার্যকর শিখন শেখানো: দক্ষ শিক্ষক, উপকরণ ব্যবহার, সকল শিশুর প্রতি সমান আচরণ, বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার ইত্যাদি;
  • v  কার্যকর নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা: শিক্ষক ব্যবস্থাপনা, সহযোগিতামূলক সম্পর্ক, স্কুলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা, যাবতীয় কাগজপত্র সংরক্ষণ করা ইত্যাদি;
  • v  কার্যকর পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন: বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বিদ্যালয়ের অবস্থা ও বিদ্যালয়ে কী ঘটছে সেসম্বন্ধে অবহিত থাকা;
  • v  কার্যকর অংশগ্রহণ: এলাকাবাসীর সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, বিদ্যালয়ের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত থাকা, শিশুদের অগ্রগতি নিয়ে অভিভাবকদের সাথে মত বিনিময় করা;
  • v  বিদ্যালয়ের ভৌত পরিবেশ: বিদ্যালয় ভবন যথাযথভাবে মেরামত করা, খেলাধুলার জন্য সুপরিসর মাঠ থাকা, খেলার মাঠ নিরাপদ, পরিষ্কার এবং আকর্ষণীয় থাকা, বিদ্যালয়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থা আনন্দময় ও নিরাপদ রাখা যাতে শিশুরা শিখতে আগ্রহী হয়;
  • v  সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলি: বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা;
  • v  সমতা: সকল পরিসংখ্যানে ছেলে মেয়ে উভয়কেই সমান গুরুত্ব দেওয়া, ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার থাকা, স্কুল ম্যনেজিং কমিটিতে মহিলা সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে পদক্ষেপ নেওয়া;
  • v  বিদ্যালয় উন্নয়ন: বিদ্যালয়ের চাহিদা নিরূপণে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠির সঙ্গে আলোচনাপূর্বক পরিকল্পনা করা, সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠির সঙ্গে খসড়া পরিকল্পনা সম্পর্কে মতবিনিময় করা, বিদ্যালয় উন্নয়নের জন্য গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা;
  • v  যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন: প্রধান শিক্ষক কর্তৃক বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা, যথাসময়ে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভা আয়োজন করা, প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কীয় সরকারের নীতি এসএমসি, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করা, বিদ্যালয় এলাকার ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক ক্রীড়ানুষ্ঠান এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করা;
  • v  শিখন শেখানো কার্যক্রম: শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের জন্য সহজলভ্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা থাকা, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকগণ জাতীয় শিক্ষাক্রম বুঝতে পারা, সময়মত বিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু ও শেষ হওয়া, নিয়মিত শিক্ষাক্রম সংক্রান্ত সভা করা, শ্রেণিভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতার আলোকে শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি বলতে পারা, এসএমসি কর্তৃক শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি পরিবীক্ষণ করা ও শিশুদের উপস্থিতি বৃদ্ধিতে সাহায্য করা। শিক্ষা উন্নয়নে লাগসই শিক্ষা সহায়ক শিক্ষক সংস্করণ, শিক্ষক সহায়িকা, প্রশ্নপুস্তিকা, নির্দেশিকা ব্যবহার করা, সরকার প্রদত্ত উপকরণ, সম্পূরক পঠন সামগ্রী ও পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করা হয়;
  • v  শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন: প্রধান শিক্ষক কর্তৃক একাডেমিক তত্ত¡াবধান করা, সহকারী শিক্ষকদের সবলদিক এবং উন্নয়নের ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে পারা, আর্থিক বিষয়ে রেকর্ডপত্র স্বচ্ছভাবে সংরক্ষণ করা ও ব্যবস্থাপনা করা;
  • v  শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থা: শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকা, এক শ্রেণিকক্ষের পাঠদানের শব্দ অন্য শ্রেণিকক্ষের পাঠদানকে ব্যহত না করা, শিক্ষক ও শিশুদের হাঁটাচলার যথেষ্ট জায়গা থাকা, শিশুর কাজ করার জন্যে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকা, শিশুদের কাজ করার জন্যে প্রতি বেঞ্চে যথেষ্ট জায়গা থাকা, বিভিন্ন ধরনের কাজ করার উপযোগী করে শ্রেণিকক্ষ সজ্জিত, সকল শ্রেণিতে চকবোর্ডের লেখা শিশুরা দেখতে পারা, শ্রেণিকক্ষ পরিচ্ছন্ন রাখা;
  • v  পাঠ পরিকল্পনা: শ্রেণিতে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার পূর্বে শিক্ষক সহায়িকা/সংস্করণ/নির্দেশিকা পড়ে থাকেন, শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার পূর্বে প্রাসঙ্গিক শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ/তৈরি করে থাকেন, শিক্ষকগণ পাঠের শিখনফল জানেন, শিক্ষকের লিখিত পাঠ পরিকল্পনা থাকা, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু সহজবোধ্য করার জন্য শ্রেণিতে শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করা, শিক্ষকগণ বিভিন্ন ধরনের শিখন  শেখানো কৌশল প্রয়োগ করা, শিশুদের অনুশীলন করার জন্য পর্যাপ্ত কাজ দেওয়াশিশুরা শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে, শিশুরা পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করে, শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ঘুরে ঘুরে শিশুদের কাজ দেখেন, শিক্ষক প্রতিটি শিশুকে প্রশ্ন করেন, প্রত্যেক শিশুর প্রতি শিক্ষক সমান মনোযোগ দেন, অপারগ অথবা পিছিয়ে পড়া শিশুদের শিখন চাহিদা নিরূপণ করেন;
  • v  শিশুর কাজ: শিশুদের কাজ প্রদর্শন করা হয়, সকল শিশুর খাতা আছে, শিশুদের কাজ মূল্যায়ন হয়, শিশুদের খাতার কাজ সুসংগঠিত, শিশুদের খাতায় বিভিন্ন ধরনের কাজ রয়েছে, শিশুরা অধিকাংশ সময় কাজে থাকে, উচ্চতর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাড়ীর কাজ দেওয়া হয়;
  • v   শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি ও তাদের প্রতিক্রিয়া: শিশুদের প্রতি শিক্ষকগণ বন্ধুভাবাপন্ন, সকল শিশুর প্রতি শিক্ষকগণ সমান দৃষ্টি দিয়ে থাকেন, শিক্ষক শিশুদের প্রশংসা করেন, শিক্ষক ফলাবর্তন দেন, শিক্ষক ছেলে-মেয়ের প্রতি সমান আচরণ করেন, শিশুদের দোষ-ত্রুটি শিক্ষক সহানুভূতির সাথে দেখেন।

বিদ্যালয়কে নিরাপদ, নান্দনিক ও আনন্দময় করতে করণীয়

প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে সহকারী শিক্ষকের মাধ্যমে পরিস্থিতি বিশ্লেষণপূর্বক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক তা নিয়ে বিদ্যালয় পর্যায়ে কাজ করবেন। উদাহরণ স্বরূপ:

শিখন পরিবেশ: বিদ্যালয়ের মাঠ ও অঙ্গন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, শ্রেণিকক্ষসমূহে পরিষ্কার ও পর্যাপ্ত আলো বাতাস ব্যবস্থা, শ্রেণিকক্ষ দর্শন ও শ্রবনের জন্য উপযুক্ত, শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পানির সরবরাহ, অন্তত দুইটি পরিষ্কার ওয়াশব্ল, যার মধ্যে মেয়েদের জন্য একটি।

শিক্ষাক্রম: জাতীয় শিক্ষাক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সমাবেশ, জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রকাশিত শিখন সামগ্রী, স্টাফরুমে অন্যান্য শিখন সহায়ক সামগ্রী, শ্রেণিতে পাঠদানের সময় শিখন সামগ্রী ব্যবহার ইত্যাদি।

শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা: বিদ্যালয়ে নিরাপদ পরিবেশ বিরাজ, শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্পষ্ট আচরণ বিধি অনুসরণ করা, বিদ্যালয়ের শৃংখলা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ, শ্রেণীকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধান করা।

ন্যায়সঙ্গতা এবং সমতা: ছেলে-মেয়ে, লম্বা-খাট, ধনী-গরীব, পারগ-অপারগ শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে শিখনে সমতা আনয়ন।

 সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম: নানা ধরনের সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা, যাতে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, এ সকল কার্যক্রমের মধ্যে জাতীয় ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা, এ সকল কার্যক্রম প্রায়ই আয়োজন করা, এ সকল কার্যক্রম আয়োজনে অভিভাবক ও পিতামাতার সক্রিয় অংশগ্রহণ।

শ্রেণিকক্ষ: শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আসন রাখা, শ্রেণির মধ্যে হাঁটাচলার জন্য জায়গা রাখা, শ্রেণির দেওয়াল ও বেঞ্চসমূহ পরিষ্কার রাখা, দেওয়ালে দর্শনযোগ্য সামগ্রী প্রদর্শন করার ব্যবস্থা রাখা, শ্রেণির চকবোর্ডটি ভালো ও ব্যবহারযোগ্য রাখা এবং চকবোর্ডটি সকল শিক্ষার্থী ভালোভাবে দেখতে পারা ইত্যাদি।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।