মূল্যবোধ কী? শিশুদের মূল্যবোধের ক্ষেত্র ও মূল্যবোধের বিকাশের পদ্ধতি

মূল্যবোধ কী? প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের মূল্যবোধের ক্ষেত্র ও বিকাশের পদ্ধতি

Children Values

মূল্যবোধ কী?

মূল্যবোধ হল এমন কিছু মৌলিক বিশ্বাস যা শিশুরা সমাজ বা পরিবার থেকে পেয়ে থাকে এবং যার সাহায্যে শিশুরা ভাল বা মন্দ এবং সমাজের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য আচরণগুলো রপ্ত করতে শেখে। মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য হল নৈতিকতা সার্বজনীন কিন্তু মূল্যবোধ সমাজ বা স্থানভেদে বিভিন্ন হতে পারে। যেমন- সত্য কথা বলা বা ঘুষ বর্জন করা সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ভাল কাজ। তাই এগুলো নৈতিকতার পর্যায়ে পড়ে। আবার, আমাদের সমাজে ধুমপান/মদপান ঘৃণিত বিষয় হলেও কোনো কোনো সমাজে ধুমপান/মদপান সামাজিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাই এটি মূল্যবোধ।

প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের মূল্যবোধের ক্ষেত্র

শিশুদের চরিত্র গঠনে মূল্যবোধ নৈতিকতার মতই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা কিভাবে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হবে তা শিশুরা শিখতে পারে। উন্নত শিক্ষা, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে মূল্যবোধ আরো সমৃদ্ধ হয় এবং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিস্তৃত হয়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়া খুবই প্রয়োজনীয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের মূল্যবোধ শেখানোর গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হল-

চরিত্র গঠন

প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে শিশুদের যেসব মূল্যবোধ শেখানো হয় তা বহুদিন পর্যন্ত শিশুর স্মৃতিতে থেকে যায়। তাই এই সময়ে শেখানো মূল্যবোধ শিশুর মনে এবং চরিত্রগঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। এই সময়ে মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে শিশুরা সত্যবাদিতা, সম্মান প্রদর্শন, দানশীলতা, পরিশ্রম প্রভৃতি গুণাবলী অর্জন করতে পারে। এর ফলে শিশুরা ভাল-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে এবং কোন ঘটনাকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে, বস্তুনিষ্ঠভাবে চিন্তা করতে বিশ্লেষণ করতে শেখে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় মূল্যবোধ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করলে সুনাগরিক এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠিত হয়।

ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়

শিশুরা অনেকটা কাদা-মাটির মত। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের যেসব মূল্যবোধ শেখানো হবে সেই মূল্যবোধ প্রয়োগ করেই শিশু ভাল এবং মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে শিখবে। শিশুরা ভাল এবং মন্দের পার্থক্য সহজে বুঝতে পারে না। তারা তাদের চোখের সামনে যা হতে দেখে সাধারণত সেসব আচরণকেই তারা অনুকরণ করে থাকে। ফলে অনেক সময়েই তারা এমন আচরণ করতে পারে যা সমাজে গ্রহণযোগ্য না। এই বয়সে মূল্যবোধ শিক্ষা না দিলে সেসব আচরণ তাদের চরিত্রে স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে। তাই প্রাথমিক পর্যায় শিশুদের মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার সক্ষমতা অর্জনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তবে এই শিক্ষা সামাজিক নিয়ম-নীতি শিশুদের উপর চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দেয়া যাবে না। বরং আনন্দদায়ক শিখনের মাধ্যমে, পরিবার এবং বিদ্যালয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টায় শিশুকে মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে।

আবেগিক বুদ্ধিমত্তা

আবেগিক বুদ্ধিমত্তা হল কখন কি ধরণের আবেগ কি মাত্রায় প্রকাশ করতে হবে তা অনুধাবন করতে পারার সক্ষমতা। শিশুদের মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে তাদের আবেগিক বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হয়। শিশুরা ভাল-মন্দ নির্ণয় এবং উত্তম চরিত্র গঠনের মাধ্যমে বুঝতে পারে যেকোন প্রতিকল পরিস্থিতিতে কিভাবে ধৈর্য্য এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এতে শিশুদের মানসিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর মাধ্যমে শিশুরা আত্মসচেতন হয় এবং সমাজে যেসব কাজ বা আচরণ গ্রহণযোগ্য তাই তারা করতে চায়। আবেগিক বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে শিশুদের মানসিক পরিপক্কতা অর্জিত হয়, তারা আত্মবিশ্বাসী হয় এবং তাদের সুস্থ মানসিক বিকাশ ঘটে।

শুদ্ধাচার শেখা

মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে শুদ্ধাচারের ধারণা তৈরি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুরা বাইরের জগতকে চিনতে শুরু করে। সমাজ এবং সমাজের মানুষ সম্পর্কে তার মনে নানা রকম ধারণা তৈরি হয়। সহপাঠীদের মাধ্যমে বা পরিবারের বাইরে অন্যান্য মানুষের সংস্পর্শে এসে শিশুরা নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। এসব সাহচর্য শিশুদের রুচি, সিদ্ধান্ত নিতে পারার সক্ষমতা এবং জীবন-যাত্রাকে প্রভাবিত করে। শিশুদের মধ্যে মূল্যবোধ শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভক্ত থাকলে তারা নানা সাহচর্যের প্রভাবেও মূল্যবোধের প্রয়োগের মাধ্যমে সে তার চরিত্রে শুদ্ধাচার বজায় রাখে। সে হঠাৎ কোনো বদভ্যাস গ্রহণ করে ফেলে না বরং যেখানে কোন অগ্রহণযোগ্য কাজের চর্চা হয় সেখান থেকে সে দূরে থাকতে চেষ্টা করে।   

মূল্যবোধ বিকাশের পদ্ধতি

১। রোল মডেল পদ্ধতি

শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা যতটা না পাঠ করার মাধ্যমে শেখে তার থেকে অনেক বেশি তারা দেখার মাধ্যমে শেখে। তাই মূল্যবোধ শিক্ষণের ক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষককে সেই মূল্যবোধ শ্রেণিকক্ষে চর্চা করতে হবে। যেমন-সবসময় সত্য কথা বলা, সবার প্রতি ভালবাসা, সহানুভূতি এবং সমানুভূতি প্রদর্শন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। শিক্ষকের ইতিবাচক আচরণ শিক্ষার্থীরা উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করে এবং তা তারা তাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে।

২। মনীষীদের গল্প বলা

যেসব মনীষী তাদের জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা ও প্রচার করে গেছেন তাঁদের জীবন-কথা শিশুদের অনুপ্রাণিত করে। শিশুরা এ ধরণের গল্প থেকে কিভাবে সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং বন্ধুসুলভ হতে হয় তার কিছু বাস্তব উদাহরণ পেয়ে থাকে। এ ধরণের গল্প শিশুদের বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকে এবং পরবর্তিতে এই শিশুরা ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সাহিত্য চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠে।

৩। শিশুতোষ সাহিত্য চর্চা

শ্রেণিকক্ষকে আনন্দময় করার লক্ষ্যে সাধারণত শিশুতোষ সাহিত্য চর্চা করা হয়। এসব ছড়া, গল্প ও কবিতার মাধ্যমে শিশুরা অনেক মূল্যবোধ শিখতে পারে। তাই শ্রেণিকক্ষে চর্চার ক্ষেত্রে সাধারণত সেসব সাহিত্য উপকরণকেই বেছে নেয়া উচিত যেন তা চর্চার মাধ্যমে আনন্দ লাভের পাশাপাশি শিশুরা নৈতিক শিক্ষাও অর্জন করে।

৪। প্রায়োগিক শিক্ষা

শিশুরা যেন মূল্যবোধ তাদের জীবনে প্রয়োগ করে সেজন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিশুরা যা শিখছে তা একক কাজ ও দলীয় কাজ প্রদানের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে বা সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমে প্রয়োগ করতে বলা হবে।

৫। ইতিবাচক আচরণকে মূল্যায়ন

যেসব শিশু ইতিবাচক আচরণ করবে তাদেরকে প্রশংসা করতে হবে বা তাদের জন্য পুরষ্কারের আয়োজন করা যেতে পারে। এতে অন্যান্য শিশুরাও ইতিবাচক আচরণ করতে উৎসাহিত হবে। যেসব শিশু কোনো নেতিবাচক আচরণ করবে তাকেও কোনো শাস্তি বা তিরস্কার করা যাবে না। তাকে ভালবাসা প্রদর্শনপূর্বক বোঝাতে হবে কেন নেতিবাচক আচরণ করা তার উচিত হয়নি এবং তার আসলে কি ধরণের আচরণ করা উচিত।

৬। সহজবোধ্য ও কার্যকর যোগাযোগ পদ্ধতি

শিক্ষকগণ অবশ্যই শিশুদের সাথে সহজবোধ্য ভাষায় কথা বলবেন। কঠিন শব্দ, অস্পষ্ট বাক্য এবং রুঢ় স্বরে কথা বলবেন না। আন্তরিক মনোভাব নিয়ে, শ্রæতিমধুর স্বরে এবং স্পষ্টভাবে কথা বলতে হবে। কোন কিছু শেখানোর সময় শিশুদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে উদাহরণ দেয়া উচিত যা শিশুরা সহজেই বুঝতে পারে। শ্রেণিকক্ষের সবশিশু যেন শিক্ষকের কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পায় এবং শিক্ষকের নির্দেশনা অনুসরণ করতে পারে সেদিকে শিক্ষক খেয়াল রাখবেন।

৭। গণমাধ্যমের উপযুক্ত ব্যবহার

বর্তমানে বেশিরভাগ শিশুই গণমাধ্যমে নানা ধরণের অনুষ্ঠান দেখছে। অনেকে ইন্টারনেটও ব্যবহার করছে। গণমাধ্যমে শিশুরা যেন এমন অনুষ্ঠান দেখে যেন তা একইসাথে শিক্ষামূলক ও বিনোদনমূলক তা নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার করলে অবশ্যই যেন তা পিতা-মাতার নির্দেশনা অনুযায়ী হয় তা খেয়াল রাখতে হবে।

মতামত দিন

নিউজলেটার

থাকার জন্য আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন।