Inclusive education
একীভূত শিক্ষা কী?
সকল শিশুর শিখন চাহিদা পূরনের একটি টেকসই মাধ্যম হল একীভূত শিক্ষা। একীভূত শিক্ষাকে শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রীক উন্নয়নের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেকেই একীভূত শিক্ষাকে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের একটি পদ্ধতি বা উপায় মনে করে থাকেন। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে একীভূত শিক্ষা এমন একটি শিক্ষা দর্শন যার নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যদল নেই, যে কোনো শিশুই শিক্ষাব্যবস্থার যে কোনো প্রেক্ষিতে (যেমন: ভর্তি, অংশগ্রহণ, অর্জন ইত্যাদি) বৈষম্যের স্বীকার হলেই তারা একীভূত শিক্ষার লক্ষ্যদল হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইউনেস্কোর (২০০৯) নির্দেশনা অনুযায়ী একীভূত শিক্ষা হলো :
একটি প্রক্রিয়া যার লক্ষ্য হলো সকল বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে সকলের জন্য মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেখানে বৈচিত্র্য/ভিন্নতা, ভিন্ন চাহিদা ও সামর্থ্য এবং শিক্ষার্থী ও সমাজের শিখন প্রত্যাশাকে সম্মান দেখানো হয়।
একীভূত শিক্ষার অর্থ হলো সকল শিশুকে তাদের সমাজের মধ্যে রেখেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া৷ একীভূত শিক্ষা হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া যা প্রত্যেক শিশুর চাহিদা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী শিখন ও জ্ঞান অর্জনের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের মাধ্যমে ’সবার জন্য শিক্ষা’ এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা৷
একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগ-অনুভুতি, বিশ্বাস, ধর্ম, ভাষা বা অন্য কোন বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও একই বিদ্যালয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করা৷ একই বিদ্যালয়ে যাতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, শ্রমজীবি শিশু, পথ শিশু, যাযাবর সম্প্রদায়ের শিশু, উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার শিশু এবং সুবিধা বঞ্চিত বিভিন্ন প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা শিক্ষা অর্জন করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে৷
বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে পিইডিপি-২-এর আওতায় সারা দেশে একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে৷ ২০১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী ১০০% শিশু ভর্তি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশে একীভূত শিক্ষার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।
সবার জন্য একই মানের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করাই একীভূত শিক্ষা। সকল শিশু তার বাড়ির কাছের বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে, বিদ্যালয়ের প্রতিটি কার্যক্রমে সবাই সক্রিয় এবং সমভাবে অংশগ্রহণ করবে।
Organization for Economic Co-operation and Development (OECD, 2012) -এর বিবেচনায় একীভূত শিক্ষা হলো,
“সকল শিক্ষার্থীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাস্তর পর্যন্ত বিদ্যালয়ে অবস্থান করা এবং শিক্ষা শেষে একটি গ্রহণযোগ্য কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করা।”
একীভূত শিক্ষার দার্শনিক ভিত্তি
(ক) প্রতিটি শিশুর শিক্ষা অর্জনের অধিকার আছে। শিক্ষা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। এ অধিকার সংরক্ষণে রাষ্ট্র ও তার সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন/প্রতিষ্ঠান আন্তর্জতিকভাবে অঙ্গিকারাবদ্ধ।
(খ) প্রতিটি শিশুই আলাদা। জন্মগতভাবেই একটি শিশু অন্যটি হতে কোনো না কোনোভাবে আলাদা হবেই। ফলে তাদের চাহিদা, পছন্দ- অপছন্দ, আগ্রহ, আবেগ-অনুভূতি, প্রত্যক্ষণ, শিখন প্রভৃতিতে ভিন্নতা বিরাজমান। এই ভিন্নতা কোন সমস্যা নয়; এটি মানবজাতির সৌন্দর্য্য।
(গ) সকল শিশুই শিখতে পারে। শিশুদের শিখন কৌশলে ভিন্নতা রয়েছে তবে কোন শিশুই শিখন ক্ষমতার বাইরে নয়। কেউ দ্রুত শেখে, কারো শিখন হয় কিছুটা মন্থর। শিশুরা শেখে তাদের চাহিদা অনুযায়ী। শিশুর শিখন ক্ষমতার পরিবর্তন নয়; বরং শেখানোর ব্যবস্থা পরিবর্তন মূখ্য।
(ঘ) প্রতিটি শিশুর নিকটস্থ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অধিকার আছে। শিশুদের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পৃথক পৃথক বিদ্যালয় নির্ধারণ করা সার্বজনীন মানবাধিকার লংঘনের শামিল। এক্ষেত্রে প্রতিটি বিদ্যালয়কে এমনভাবে প্রস্তুত হতে হবে যেন ক্সবচিত্রকে স্বাগত জানিয়ে সকল শিশুর চাহিদা পুরন করতে পারে।
একীভূত শিক্ষার মূল ভিত্তি
১। প্রতিটি শিশুই আলাদা,
২। প্রতিটি শিশুরই শিক্ষা অর্জনের অধিকার আছে,
৩। সকল শিশুই শিখতে পারে, এবং
৪। প্রতিটি শিশুরই নিকটস্থ বিদ্যালয়ে ভর্তি অধিকার আছে।
একীভূত শিক্ষায় শিক্ষক শিখন শেখানো পরিকল্পনায় কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যদল নেই। শিক্ষকের সকল পরিকল্পনায় এবং কৌশলে সকল শিক্ষার্থীকে বিবেচনায় রাখবে।
একীভূত শিক্ষা কেন?

একীভূত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
- সকল তথা প্রত্যেক শিশুর মূলধারার শিক্ষার অংশগ্রহণের অধিকার আছে;
- ঝরে পড়তে পারে এমন ধরণের সকল বাধা চিহ্নিত করে তা অপসারন করা;
- স্কুলে ভর্তি করার পাশাপাশি প্রত্যেক শিশুর পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা সুনিশ্চিত করা;
- শিশুর ভিন্নতা, বৈচিত্রতা এবং পার্থক্যসমূহের প্রতি ইতিবাচকভাবে সাড়া প্রদান করা;
- পাঠের গুণগতমান উন্নয়ন করার মাধ্যমে প্রত্যেক শিশুর শিক্ষার চাহিদা পূরণ করা।
একীভূত শিক্ষার লক্ষ্যদল কারা?
- ঝুঁকিগ্রস্থ শিশু;
- নৃ-তাত্ত্বিক শিশু;
- অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর শিশু;
- শারীরিক ও বিকাশজনিত প্রতিবন্ধী শিশু;
- শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু;
- বাক প্রতিবন্ধী শিশু;
- দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু;
- শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু;
- বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশু;
- অতি মেধাবী শিশু।
একীভূত শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা;
- প্রত্যেক শিশুর নিজস্ব চাহিদা ও সম্ভাবনা অনুসারে শিক্ষালাভের সকল বাধা দূর করা;
- শিশুর ভিন্নতা ও সতন্ত্রতাকে মেনে নিয়ে অবাধ শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
একীভূত শিক্ষার সুফল
শিশুর সুফল:
- প্রত্যেক শিশু স্বাধীনভাবে লেখাপড়ায় অংশ নিতে পারে;
- প্রত্যেক শিশু সাতন্ত্র্যতাবোধ ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারে;
- সকল শিশু অন্যদের ভিন্নতা/সতন্ত্রতাকে সম্মান করতে শেখে;
- প্রত্যেকেরই ভিন্নতা ও ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা রয়েছে- সব শিশু তা বুঝতে পারে;
- সকল শিশুর মধ্যে একে অপরকে সহায়তা করতে পারে;
- সকল শিশুই মানসম্মত শিক্ষালাভ করতে পারে।
শিক্ষকের সুফল:
- শ্রেণি পাঠনার ক্ষেত্রে অধিক সৃজনশীল, ফলপ্রসূ ও শিশুকেন্দ্রিক হয়;
- রাস্ট্র, সমাজ ও বিভিন্ন জায়গা থেকে শিক্ষক অধিক সহযোগিতা পায়;
- আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারেন।
অভিভাবকের সুফল:
- বিদ্যালয় ও পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ফলে অভিভাবকগণ শিশুর সাথে অধিক সম্পৃক্ত হতে পারেন;
- বিদ্যালয় থেকে শিশু শিক্ষার বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করতে পারেন যা তাদের অভিভাবক হিসেবে আরও দক্ষ করে তোলে;
- নিজ নিজ শিশু/সন্তান সম্পর্কে ধারণা বৃদ্ধি পায় ফলে তাদের সার্বিক সচেতনা বৃদ্ধি পায়।
সমাজের সুফল:
- অধিক শিশু বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে সামাজিক কর্মকান্ডগুলো অধিক কার্যকর হয়;
- আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি পায়;
- সামাজিক সমস্যা ও অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পায়;
- বিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় ফলে সামাজিক সম্পর্কে উন্নয়ন ঘটে।
জাতি তথা রাষ্ট্রের সুফল:
- একীভূত সমাজ গঠিত হয়;
- সকলের জন্য শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হয়৷
একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা
- একীভূত শিক্ষা বিয়য়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের স্বল্পতা;
- প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব বা স্বল্পতা;
- বাস্তবভিত্তিক একীভূত শিক্ষা উপযোগী শিক্ষাক্রম;
- একীভূত শিক্ষা উপযোগী অবকাঠামোযুক্ত বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা;
- একীভূত শিক্ষা বিষয়ে সার্বিক সচেতনতার অভাব;
- সমাজের সকল স্তরের জনগোষ্ঠীর শিশুর বিশেষ করে সুবিধা বঞ্চিত ও প্রান্তিক শিশুদের শিক্ষার বিষয়ে সচেতনতার অভাব৷
একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জসমূহ
- একীভূত শিক্ষা সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের পরিবর্তন করা;
- নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সচেতনতাবোধ তৈরি করা;
- একীভূত শিক্ষা উপযোগী প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিদ্যালয় অবকাঠামো তৈরি করা;
- সকল পর্যায়ের শিক্ষক, প্রশিক্ষক/তত্ত্বাবধায়কগণের মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রদান করা;
- সত্যিকারভাবে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের জন্য একীভূত শিক্ষা উপযোগী শিক্ষোপকরণ ও শিখন-শেখানো সামগ্রী সরবরাহ এবং তার যথাযথ ব্যবহার করা;
- বর্তমান কাঠামোর মাঝে থেকে সঠিক এবং উপযোগী শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা;
- সকল শিশুর শিখনের প্রতি লক্ষ্য রেখে নমনীয় কারিকুলাম, সময়সূচি এবং মূল্যায়ণ পদ্ধতি প্রণয়ন;
- প্রত্যেক শিশুর শিখন চাহিদার উপর ভিত্তি করে তার উপযোগী প্রতিবন্ধকতাবিহীন এবং শিশু-কেন্দ্রিক শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা৷
শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে একীভূত শিক্ষার আলোকে অভিযোজন
শিখন-শেখানো কাজের সময় বেশিরভাগ শিক্ষকের মধ্যে দু’ধরণের আচরণ লক্ষ্য করা যায়। কিছু শিক্ষকে আছেন একীভূত শিক্ষায় সুবিধা বঞ্চিত বা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বেশি প্রধান্য দেন। আরেক ধরনের শিক্ষক রয়েছেন যারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে সুবিধা বঞ্চিত বা প্রতিবন্ধী শিশুরা কখনোই সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়ার কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে তাল মেলাতে পারবে না ফলে তাদের পাঠদান শুধুমাত্র সাধারণ শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে উভয় প্রকার দৃষ্টিভঙ্গিই একীভূত শিক্ষা দর্শনের পরিপন্থী।
শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষার্থীর চাহিদাভিত্তিক ও শিখনবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে
হয়। শিখনকে ফলপ্রসূ করতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের ক্ষেত্রেই শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনার (শৃঙ্খলা) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু শ্রেণিকাজ পরিচালনার জন্য সময় ৩০-৪০ মিনিট থাকে, তাই শ্রেণিকক্ষে দলীয় কাজ পরিচালনায় সময়টা মাথায় রাখা জরুরি। এমনভাবে কাজ নির্ধারণ করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনাতেই বেশি সময় চলে না যায়।
একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নের যে কৌশলগুলো প্রয়োগ করতে পারেন তা হলো :
১. আসন বিন্যাস : একীভূত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আসন বিন্যাস খুবই জরুরি বিষয়। বিভিন্ন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের (যেমন: পথ শিশু,পরিবারবিচ্ছিন্ন শিশু) মাঝে অনেক সময় আচরণগত সমস্যা দেখা যেতে পারে এজন্য এদেরকে শিক্ষকের চোখের সামনে অর্থাৎ সামনের সারিগুলোতে বসানোর অভ্যাস করলে তারা অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রবণ বা দৃষ্টি ইন্দ্রীয়ের একটি ব্যবহার করতে পারে বিধায় অনেক সময় তারা শিক্ষকের পাঠ উপস্থাপনা বুঝতে সমস্যায় পরে। এক্ষেত্রে তাদেরকে সামনের সারিতে বসালে অধিক কার্যকরি হয়।
২. শিক্ষকের অবস্থান : শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা শ্রেণিতে শিক্ষকের কথা বোঝার জন্য তার মুখমন্ডলের বিভিন্ন অভিব্যপ্তি এবং ঠোঁটের ওঠানামা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকে। সে কারণে যতটা সম্ভব শ্রেণিতে তাদের সাথে মুখোমুখি যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করা ভালো। তবে শ্রেণিকে স্বরব রাখার জন্য শিক্ষক অবশ্যই কক্ষের বিভিন্ন অবস্থানে হাটা-চলা করবেন এটাই স্বাভাবিক।
৩. শিক্ষোপকরণের ব্যবহার : একীভূত শিক্ষার প্রাণ হলো একটি ভালো শিক্ষাপোকরণ যা থেকে সকল শিক্ষার্থী লাভবান হয়। ধরা যাক, পাঠের বিষয় বাংলাদেশের মানচিত্র। শিক্ষক একটি পোস্টার পেপারে বাংলাদেশের মানচিত্র একে নিয়ে এসেছেন। সাধারণ শিক্ষার্থী ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপোকরণটি দেখে মুগ্ধ। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য যদি শিক্ষাপোকরণটি যদি বিশেষভাবে তৈরি করা যায় যেমন মানচিত্রের বর্ডারগুলোতে আঠা দিয়ে ডালের দানা বসিয়ে দেওয়া যার ফলে শিক্ষার্থীর নিকট উপকরণটির দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় শিখন চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
৪. প্রশ্নপত্র তৈরি : একটি ক্রটিপুর্ণ প্রশ্নপত্র অনেক সময় একীভূত শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের বাঁধা হয়ে দাড়ায়। ধরা যাক, বিজ্ঞানের একটি প্রশ্নপত্রে ১০ টি প্রশ্নের মধ্যে ৭ টির উত্তর দিতে বলা হলো যেখানে ৫টিতে বলা হয়েছে চিত্র আবশ্যক। এক্ষেত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা প্রথমেই খুঁজতে থাকে যেগুলোতে চিত্র চাওয়া হয়নি। তারপরও তাদেরকে ২টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে যেখানে চিত্র আবশ্যক। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দেয়। ফলে তাদের পক্ষে চিত্র আঁকা সম্ভব নয়।
এখন প্রশ্ন ওঠতে পারে যে, তাহলে কি প্রশ্নে চিত্র আবশ্যক করা যাবে না- অবশ্যই যাবে। বিশেষ করে বিজ্ঞানের মতো একটি বিষয়েতো অবশ্যই এমন কিছু অধ্যায় আছে যেখানে চিত্রসহ বিষয়গুলো আলোচনা করাটাই মূখ্য। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে যেখানে চিত্র অপরিহার্য নয় সেখানে যেন অযথা তা আবশ্যক না করা হয়। প্রয়োজনবোধে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ‘অথবা’র মাধ্যমে চিত্রহীন প্রশ্ন সংযোজন করা যেতে পারে।
৫. উত্তরপত্র মূল্যায়ন : মূল্যায়নের জন্য একেকটি প্রশ্নের উত্তরকে ৩টি ভাগে ভাগ করে নম্বর প্রদান করা হয়। যেমন: একটি গ্রুপ পায় সর্বোচ্চ নম্বর (যেমন: ৮/১০), আরেকটি গ্রুপ মাঝা মাঝি নম্বর ( যেমন: ৬-৭/১০) এবং অন্য আরেকটি গ্রুপ থাকে যারা পেয়ে থাকে পাশ নম্বর (যেমন: ৫/১০) অথবা তারা ফেল করে। তৃতীয় গ্রুপেরর মধ্যে প্রায়ই দেখা শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষাথীরা পড়ে যায়। কারণ একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী উত্তর লিখার সময় খুব ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করে থাকে। যেমন: ৫ম শ্রেণীর সাধারন শিক্ষাথীরা ব্যাখ্যা লিখন শুরু করে… “আলোচ্য অংশটুকু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (…) কবিতা থেকে চয়ন করা হয়েছে”, যা পরীক্ষকগণ সানন্দে গ্রহণ করেন।
কিন্তু একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এই বাক্যটিকে যেভাবে প্রকাশ করে তা হলো: “এ অংশটি (…) কবিতার। এ কবিতার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”, যা পরীক্ষকগণ কিছুতেই গ্রহণ করতে পারেন না এবং শিক্ষাথীকে ফেল নম্বর প্রদান করেন। কিন্তু আলোচনার বিষয় হলো বাক্য দুটি দিয়ে কি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে, নাকি এদের মধ্যে অর্থগত কোন পার্থক্য নেই। প্রকৃতপক্ষে বাক্য দুটি দিয়ে একই অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে। যদি একই অর্থ প্রকাশ পায় তাহলে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীটিকে ফেল নম্বর প্রদান করা অন্যায়। সে নিশ্চয় সর্বোচ্চ নম্বর পাবে না; তবে তাকে পাশ নম্বর তো দেয়াই যায়।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, একীভূত শিক্ষার বাস্তবায়ন কোনো একক ব্যক্তির প্রচেষ্টা নয়, বরং বিদ্যালয়ের সাথে সকল অংশীজন যেমন: শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজপতিসহ বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের একটি সমন্বিত প্রয়াশের ফল হলো একীভূত শিক্ষা।