পেশাগত শিক্ষা (২য় খন্ড)
২য় অধ্যায়: শিখন শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল
ক্লাস-১৮: প্রশ্নকরণ কৌশল, বড় ও ছোট শ্রেণিকক্ষে শ্রেণি পরিচালনার কৌশল
ক্লাসের আলোচিত বিষয়:
· প্রশ্ন কাকে বলে?
· প্রশ্ন করার ৫টি উদ্দেশ্য লিখুন।
· শিখন-শেখানো কার্যক্রমে কখন কী প্রশ্ন করা যেতে পারে তা উদাহরণসহ বর্ণনা দিন।
· শ্রেণিকক্ষে প্রশ্নকরণের শ্রেণিবিভাগ লিখুন।
· শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করার ধারাবাহিকতার একটি চার্ট তৈরি করুন।
· বড় শ্রেণিকক্ষ কাকে বলে? বড় শ্রেণিকক্ষে শ্রেণি পরিচালনার কৌশল ব্যাখ্যা করুন।
· ছোট শ্রেণিকক্ষে শ্রেণি পরিচালনার কৌশল ব্যাখ্যা করুন।
· একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য অনুসরণীয় চার্ট কেমন হতে পারে তা লিখুন।
প্রশ্ন কাকে বলে?
যখন কেউ কোন কিছু বা কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয় এবং সেই বিষয় সম্পর্কে অন্যের কাছে মৌখিক বা লিখিতভাবে জিজ্ঞেস করে তখন তাকে ‘প্রশ্ন’ বলা হয়। এক কথায়, প্রশ্ন বলতে কোন জিজ্ঞাসু বাক্যকেই বুঝায়।
শ্রেণিকক্ষে যোগাযোগের একটা বড় উপায় হলো প্রশ্ন করা। প্রশ্ন করার মাধ্যমে শিখন-শেখানো কাজকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জটিল চিন্তন দক্ষতা ও অনুসন্ধানী মানসিকতা বৃদ্ধি করা যায়। শিক্ষার্থী কী জানে বা জানেনা, তা জানার জন্য কিংবা মনোযোগী করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করা যায়।
প্রশ্ন করার ৫টি উদ্দেশ্য লিখুন।
শ্রেণিকক্ষে আমরা বিভিন্ন উদ্দেশ্য প্রশ্ন করি। যেসব উদ্দেশ্যে শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করা হয় তা হলো:
· শিক্ষার্থীদের পূর্বজ্ঞান যাচাই করা।
· প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে শিখন-শেখানো কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।
· শিক্ষার্থীদের জটিল চিন্তন দক্ষতা বাড়ানো যাতে শিক্ষার্থী নিজে নিজে কোন বিষয় সম্পর্কে শিখতে আগ্রহী হয়।
· প্রশ্ন করণের মাধ্যমে পাঠের অগ্রগতি যাচাই করা।
· শ্রেণি শৃঙ্খলা ধরে রাখা। যেমন- অমনোযোগী শিক্ষার্থীকে আলোচিত বিষয়ে প্রশ্নের মাধ্যমে মনোযোগ বাড়ানো।
শিখন-শেখানো কার্যক্রমে কখন কী প্রশ্ন করা যেতে পারে তা উদাহরণসহ বর্ণনা দিন।
পাঠদান কার্যক্রম সাধারণত ৩টি পর্যায়ে হয়ে থাকে। যেমন- ক্লাসের শুরু, পাঠ চলাকালীন এবং ক্লাসের শেষাংশ। নিম্নে এই ৩টি পর্যায়ে কখন কী প্রশ্ন করা যেতে পারে তা বর্ণনা করা হলো:
১. ক্লাশের শুরুতে প্রশ্ন:
· শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। যেমন- শুভ সকাল, কেমন আছো তোমরা?
· নিরাপদ বা শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে। যেমন- এসো আমরা একটি গাই গাই, তোমরা কী গান শুনতে চাও?
· পূর্বজ্ঞান যাচাই করতে।
· শিখন-শেখানো কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে।
২. পাঠ চলাকালীন প্রশ্ন:
· নতুন কাজে যাওয়ার আগে পূর্ববর্তী বিষয়ে শিক্ষার্থীর শিখন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। যেমন- এ পর্যন্ত যা আলোচনা হয়েছে বুঝতে পেরেছে? অথবা, সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করা।
· শিক্ষার্থীরা কাজের নির্দেশনা বুঝতে পেরেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে।
· শিক্ষার্থীর শিখনকে সহায়তা করতে।
· শিক্ষার্থীর ধারণা পরিস্কার করতে। যেমন- এই বিষয় সম্পর্কে তোমাদের কোন প্রশ্ন আছে কী?
৩. পাঠের শেষাংশে প্রশ্ন:
· পাঠের শিখন অভিজ্ঞতার সংশ্লেষ ও সার-সংক্ষেপ করতে। যেমন- আজকের পাঠ থেকে তোমরা কি কি বুঝলে?
· শিক্ষার্থীর শিখনকে মূল্যায়ন করতে ও স্বীকৃতি দিতে।
· শিক্ষার্থীর শিখনকে স্বীকৃতি দিতে ও তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে।
· পাঠের শিখনকে বিস্তৃত পাঠ্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে।
· শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আত্ম-মূল্যায়নকে সহায়তা করতে।
শ্রেণিকক্ষে প্রশ্নকরণের শ্রেণিবিভাগ লিখুন।
শ্রেণিকক্ষে প্রশ্নকে নানাভাবে শ্রেণি বিভক্ত করা যায়। যেমন-
· বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন:
শিক্ষার্থীর অনুধাবন যাচাইকরণে প্রশ্ন করা। যেমন: পানিচক্র কী?
· পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যভিত্তিক প্রশ্ন:
শিক্ষারথীদের ইন্দ্রিয় দ্বারা পর্যবেক্ষণকৃত প্রমাণের ওপর নির্ভর করে প্রশ্ন করা। যেমন: এক টুকরো বরফকে রোদে রেখে দিলে বরফের তামপাত্রা বাড়বে কি?
· মূল্যবোধ সম্পর্কিত প্রশ্ন:
শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ-এর ওপর ভিত্তি করে কোন কিছুর প্রশংসা করে বা সমালোচনা করে বা মূল্য আরোপ করে প্রশ্ন করা। যেমন: শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কীটনাশক পরিবেশ দূষণ করে, অতএব এটি কি বন্ধ করা উচিত?
চূড়ান্ত পরীক্ষা, ধারাবাহিক মূল্যায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেঞ্জামিন ব্লুম প্রদত্ত ট্যাক্সোনোমি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। যেমন- প্রশ্নসমূহকে জ্ঞানমূলক বা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রের ট্যাক্সোনোমির ভিত্তিতেও শ্রেণিবিভাগ করা যায়। সেগুলো হলো:
· জ্ঞানমূলক,
· অনুধাবন,
· প্রয়োগ,
· বিশ্লেষণ,
· মূল্যায়ন ও
· সংশ্লেষণ।
শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করার ধারাবাহিকতার একটি চার্ট তৈরি করুন।
শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করার ধারাবাহিকতার চার্ট:

বড় শ্রেণিকক্ষ কাকে বলে? বড় শ্রেণিকক্ষে শ্রেণি পরিচালনার কৌশল ব্যাখ্যা করুন।
সাধারণত একটি শ্রেনিতে শিক্ষক ছাত্র অনুপাত ১:২৫ বা ১:৩০ থাকলে তাকে আমরা আদর্শ বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে একটি শ্রেণিতে ৫০-৬০ বা তারও বেশি ছাত্র থাকে। শ্রেণিতে শিশু সংখ্যা ৪০-এর অধিক হলেই আমরা ঐ ধরনের শ্রেণিকে অধিক শিশুসংবলিত শ্রেণি বলে থাকি। বড় শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষকের পক্ষে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য। ফলে এ ধরনের শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষককে বিশেষ দক্ষতা ও বিভিন্ন ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বড় শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের কৌশলগুলো নিম্নরূপ হতে পারে:
১. বসার ব্যবস্থা বিন্যস্ত করা: যেমন- ইউ শেপ, আই শেপ বিন্যস্ত করার মাধ্যমে এমন হবে যাতে শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছাকাছি সহজে যেতে পারেন এবং কার্যক্রম তদারকি করতে পারেন।
২. শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন প্রান্তে চলাচল করার সুবিধা রাখা। যেমন- বোর্ডের ব্যবহার, ডান, বাম ও পেছনে চলাচলের ব্যবস্থা রাখা।
৩. ‘আই কন্ট্যাক্ট’ বজায় রাখা মাধ্যমে সকল শিশুর প্রতি লক্ষ রাখা।
৪. জোড়ায় ও দলীয় কাজের মাধ্যম সকলের জন্য একই অথবা ভিন্ন ভিন্ন কাজ (Activity) দেয়া। এক ঘেঁয়েমী দূর করার জন্য প্রতি সপ্তাহে দলে নাম ও স্থান পরিবর্তন করা।
৫. বৈচিত্র্যময় প্রশ্নকরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো ও উৎসাহ প্রদান করা।
৬. শিশুদের মাধ্যমে এক অন্যের সমস্যার সমাধান:
৭. সঠিক উত্তর বোর্ডে লিখে দেওয়ার মাধ্যমে সময় বাঁচানো।
৮. একাধিক শ্রেণিনেতা নির্বাচন করা যা প্রতিমাসেই পরিবর্তন করে দেওয়ালে টাঙিয়ে দেয়া।
৯. শ্রেণিকক্ষে অনুসরণীয় চার্ট স্থাপন করা।
১০. একাধিক উপকরণ ব্যবহার করা। যেমন- ১টি গ্লোবের জায়গায় ৫টি গ্লোব।
ছোট শ্রেণিকক্ষে শ্রেণি পরিচালনার কৌশল ব্যাখ্যা করুন।
বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকলেও কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনেক কমও লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২০ এর কম হলেই তাকে ছোট শ্রেণিকক্ষ বলা যায়।
এ ধরনের শ্রেণিকক্ষে শ্রেণি পরিচালনার কৌশল কী হতে পারে তা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. শিক্ষার্থীরা যেন সহজে শিক্ষককে শুনতে ও দেখতে পায় সেজন্য উপযোগী আসন বিন্যাস করা।
২. সকলের প্রতি সমান মনোযোগ প্রদান করা।
৩. প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রত্যক্ষভাবে অনুশীলন করানো সুযোগ রাখা।
৪. শিক্ষার্থীদের দিয়ে কাজ তদারক করা।
৫. শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেয়া।
৬. চিন্তণ ক্ষমতা বাড়ানো ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা।
৭. সরাসরি প্রশ্ন করা এবং ফিডব্যাক প্রদান করা।
৮. মাঝে মধ্যেই বসার জায়গা পরিবর্তন করা।
একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য অনুসরণীয় চার্ট কেমন হতে পারে তা লিখুন।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য অনুসরণীয় (ক্লাসরুম রুলস) নিম্নরূপ হতে পারে:
১। শিক্ষকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনব।
২। দলে কাজের সময় সবার মতামত শুনব। অন্যের মতের সাথে একমত না হলে ভদ্রভাবে যুক্তি দিয়ে তার মত খন্ডন করব।
৩। দলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করব।
৪। কিছু বলার আগে হাত তুলব।
৫। সবার সাথে ভালো ব্যবহার করব এবং সদ্ভাব বজায় রাখব।
৬। আমার খাতায় আমার কথা বা চিন্তা নিজেই লিখব।
৭। সবাই একসাথে কথা বলব না, একজন বলার পর অন্যজন বলব।
৮। সবাইকে দলের কাজ উপস্থাপন করার এবং অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেব।
৯। শান্তি বজায় রাখব, যাতে সবাই সবার কথা শুনতে পায়।
১০। দলের কাজ পরিচালনায় একে অন্যকে সহযোগিতা করব।