বাওবি (এসকে) Archives - Proshikkhon

Category "বাওবি (এসকে)"

9Oct2020

অধ্যায়-১৫: জনসংখ্যা সচেতনতা

১. বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমূহ এবং জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে আপনার সুপারিশসমূহ আলােচনা করুন।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ :

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে নিচেরগুলাে অন্যতম- 

১। অসচেতনতা :

বাংলাদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হলো গণ অসচেতনতা। এদেশের অধিকাংশ মানুষ অসচেতন। বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে শিক্ষার আলাে পৌছায়নি। ফলে তারা অসচেতন অবস্থায় থেকে জীবনাবসান ঘটাচ্ছে । আর জীবদ্দশায় অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে চলছে। এতে করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। 

২.সামাজিক কারণ :

শিক্ষার অভাব, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, নারী শিক্ষার ও নারীর ক্ষমতায়নের অভাব, পুত্র সন্তানের প্রত্যাশা ত্যাদি সামাজিক কারণ গুলো আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

৩. অর্থনৈতিক কারণ :

দারিদ্র ও নিম্ন জীবনমানের কারণে মানসম্পন্ন জীবন সম্পর্কে অসচেতনতা, কৃষি নির্ভরশীলতা প্রভৃতি আমাদের দেশে বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৪. চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি :

চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি, সংক্রামক ও মহামারী রোগের প্রতিরােধ, প্রতিষেধক আবিষ্কার, পুষ্টিকর খাবার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং নিরাপদ পানির ব্যবহার ইত্যাদি কারণে জনগণের আযু বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শিশু মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৫. কুসংস্কার:

আমাদের দেশে শিক্ষার হার কম হওয়ার কারণে মানুষ সহজেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ফলে তারা কি সন্তানকে আশীর্বাদ মনে করে। অনেক পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়ায় বাধা দেওয়া হয় এবং তাদের মতামত মূল্যায়ন করা হয় না। এই অসচেতন ও অনুন্নত জীবনযাপন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ।

সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সমাধানের উপায়ঃ

জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন উপায় আছে। এর মধ্যে প্রধান হলাে :

১. সচেতনতা সৃষ্টি

২. জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে রূপান্তর

৩. জন্ম নিয়ন্ত্রণ।

১. সচেতনতা সৃষ্টি:

দেশের মানুষকে সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। প্রাথমিক স্তরের শিশুরা যেহেতু অল্পবয়সী সেহেতু তাদের মধ্যে সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা অধিকতর জররি। এভাবে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ জীবন পরিবার গঠনে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মনােভাব তৈরি করতে হবে। 

২.জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে রূপান্তর :

কোন দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মানব সম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ। অতিরিক্ত এই জনসংখ্যাকে কেবল সমস্যা হিসেবে দেখলে হবে না, বরং তাদের সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। এতে একদিকে দেশের উন্নয়নে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে। অন্যদিকে জনসংখ্যা সমস্যারও কিছুটা সমাধান হবে। অতএব কেবল সরকার নয়, আমাদের সবার এ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

৩. জন্মনিয়ন্ত্রণ :

জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সফল করার জন্য নিচের বিষয়গুলাের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যথা: 

১. নিয়মিত পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান এবং এ সেবা তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের দুয়ারে পৌছানাে।

২. মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয়।

৩, প্রশাসনিক এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ।

৪.উচ্চ জন্মহার রােধে বিবিধ ব্যবস্থাদি গ্রহন । 

৫. বাধ্যতামূলক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সার্থক বাস্তবায়ন।

৬, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির বাস্তবায়নে জোরালাে রাজনৈতিক সমর্থন। 

৭. শিশু মৃত্যুর হার কমানো উদ্দেশ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন। 

৮, বাল্যবিবাহ রােধ সংশ্লিষ্ট সকল আইনের সঠিক ও কঠোর বাস্তবায়ন।

৯, নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করা। 

১০, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য মসজিদের ইমামদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে ধর্মীয় ও সামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগানাে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে শুধুমাত্র পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কখনাে সম্ভবপর নয়। জনসংখ্যা রােধে তাই কতিপয় বিষয় পরিবার-পরিকল্পনার পাশাপাশি সুবিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন : অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমােচন কর্মসূচি,খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশ সংরক্ষণে, শিক্ষা ও কর্মের সুযোগ সৃষ্টি। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মণ্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার মনােভার গঠনে একটি বহুমুখী কৌশল অবলম্বন করে তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়ােজন।

২. বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব আলােচনা করুন।

অথবা, জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে আপনার পরামর্শগুলো লিখুন। 

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব: বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এক মারাতক সমস্যা ।এ সমস্যার প্রভাব আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং চিত্ত বিনােদনের উপর পড়ছে। এতে আমাদের বসবাসের জন্য নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নিম্নে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবগুলাে আলােচনা করা হলো:

 ১. দারিদ্র্য সমস্যা :

অপরিকল্পিত ও অপরিমিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি দারিদ্রের প্রধান কারণ। বাংলাদেশে সম্পদের তুলনায় দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের মাথাপিছু আয় দিন দিন কমে যাচ্ছে। মানুষকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিবারের বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে। জনগনের মৌলিক চাহিদা মেটানাের জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ পিছনে পড়ে যাচ্ছে। ফলশ্রতিতে সামাজিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দিন দিন দারিদ্র সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। এভাবে জনসংখ্যার  অধিক চাপ আমাদের অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে।

২.খাদ্য ঘাটতি :

অধিক জনসংখ্যার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ বিপুল খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির চেয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অধিক হওয়ায় ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে বার্ষিক ১৫৬-২০০লক্ষ টন খাদ্যশস্য ঘাটতি দেখা যায়। এছাড়া জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু খাদ্যের পরিমাণও অনেক কমে যাচ্ছে।

৩.শিক্ষায় অনগ্রসরতা:

দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার হার আশানুরুপ বাড়ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার ৬৫%। তাছাড়া শিক্ষাখাতে প্রয়ােজনের তুলনায় অর্থ বরাদ্দের অভাবে বাড়তি জনসংখ্যার শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়ােজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষক সংকট পূরণ করা কষ্টসাধ্য হচ্ছে।  

৪. কৃষি জমি কমে যাওয়া ও ভূমিহীনদের সংখ্যা বৃদ্ধি :

অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে জমিগুলাে ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হচ্ছে, যা উন্নয়নের জন্য বাধা। আবার বাড়তি জনসংখ্যার বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি তৈরির কারণে আবাদি জমিতে তােলা হচ্ছে নতুন নতুন বসত বাড়ি, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে ভূমিহীনদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা প্রায় ৬০%।

৫. বেকারত্ব:

জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মক্ষেত্র না বাড়ায় দেশে দিন দিন বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে ।পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালে দেশে কর্মক্ষম জনশক্তির মােট ৩৮% বেকার ছিল। ১৯৮২ সালে চাকরির দরখাস্ত পড়ে একটি পদের বিপরীতে ২০ জন। সেখানে ১৯৮৮ সালে এ সংখ্যা দাড়িয়েছে ১২৬ জনে। এ বর্ধিঞ্চু জনশক্তির প্রায় সাড়ে ছয় পক্ষ কাজের সংস্থান প্রয়ােজন, সেটি বাংলাদেশের জন্য প্রায় অসম্ভব।

৬. স্বাস্থ্যহীনতা ও পুষ্টিহীনতা :

পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থসেবা বাড়ানাে সম্ভব হচ্ছে না। অপরদিকে স্বাস্থ্যাহীনতা, নিরক্ষরতার সাথে খাদ্যাভাবের দারুণ অভাব পড়েছে। যার ফলে পুষ্টিহীনতা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।

৭.বাসস্থান সমস্যা:

বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে তাতে প্রতিবছর এ বাড়তি জনসংখ্যার জন্য প্রায় ৩ লক্ষ নতুন গৃহের প্রয়ােজন। বাংলাদেশের পক্ষে কোনােভাবেই এ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই বস্তি ও গৃহহীনদের সংখ্যা বাড়ছে ।জাতিসংঘের সূত্রমতে, এদেশে প্রায় ১০ লক্ষ লােক গৃহহীন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। জনসংখ্যার অত্যধিক চাপের ফলে উপযুক্ত বাসস্থানের অভাবে মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয়। 

৮.প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট ও পরিবেশ দূষণ:

পৃখিবীতে মানুষের বসবাসের উপযােগী প্রকৃতির নিজস্ব যে পরিবেশ রয়েছে জনসংখ্য বৃদ্ধির কারণে তা আজ নানা কারণে দৃষিত, ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যন্ত। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে জমি সংকট, গাছপালা কর্তনসহ নানা সমস্যার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

 ৯.সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধপ্রবণতা:

বাংলাদেশের পক্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কোনাে বিশেষ ব্যবস্থা বা জনসংখ্যার ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সমাজে হতাশা, ক্ষোভ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। 

জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন :

জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে আমার পরামর্শগুলো নিম্নরূপ :

১.নিয়মিত পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান এবং এ সেবা জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌছানাে।

২. মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয়।

৩.পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির বাস্তবায়নে জোরালো রাজনৈতিক সমর্থন।

৪.বাল্যবিবাহের হার কমানাের জন্য কার্যকর আইন বাস্তবায়ন। 

৫. নারী শিক্ষা ও নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি।৬.বিভিন্ন কুসংস্কার দূরীকরণের লক্ষ্যে মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে ধর্মীয় ও সামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগানাে। 

৭.অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমােচন কর্মসূচি, খাদ্য উৎপাদন, যুগোপযোগী শিক্ষা সুযােগ সৃষ্টি করা। 

৮.উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করলে জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান অনেকাংশেই সম্ভব বলে আমি মনে করি

৩. জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের পাঁচটি উপায় লিখুন।

বাংলাদেশে যথেষ্ট মূলধন না থাকলেও আছে পর্যাপ্ত জনসংখ্যা। এই জনসংখ্যার দক্ষতা বাড়ানাের মাধ্যমে তাদের জনসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। দক্ষ জনসম্পদ গঠনের কয়েকটি উপায় হলাে:

১. শিক্ষা:

মানব সম্পদ উন্নয়নের মূল উপাদান হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে জনসম্পদকে দক্ষ করে তোলা যায়। 

২. দক্ষতা বৃদ্ধি :

শ্রমশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলাে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মাধ্যমে তাদের কর্মক্ষমতা ও গুণগত মান বৃদ্ধি করা যায়।

৩.জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান :

অতিরিক্ত দক্ষতা বাড়াতে গেলে অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়ােজন হয়। বর্তমান জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান করার জন্য প্রয়ােজন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৪.জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি:

উপযুক্ত বাসস্থান, পরিবেশ ও মানসম্মত জীবন-যাপন, সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা পাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ ইত্যাদি বিষয় জীবনযাত্রার মানের মূল উপাদান। এগুলাে নিশ্চিত করার মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তর করা যায়।

৫.জনশক্তি পরিকল্পনা:

বাংলাদেশের জনসম্পদকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়ােজন সুষ্ঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ।এ লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যেতে হবে। 

৪. জীবনযাত্রার মানের উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব সংক্ষেপে লিখুন।

অথবা, বাংলাদেশে অধিক জনসংখ্যার কারণে কী কী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে? 

একটি দেশ কতটা উন্নত তা বুঝা যায় দেশটির নাগরিকগণের জীবনযাত্রার মান থেকে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় নিম্ন পর্যায়ের। জীবনযাত্রার মানের উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব আমরা নিম্মলিখিত বিষয়গুলোর মাধ্যমে লক্ষ করি।

১. খাদ্য :

খাদ্যের উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি হয়ে থাকে। এ ফলে অনেক লোক দারিদ্র ও অপুষ্টির শিকার হয়।

২.বস্ত্র :

পরিবারে লােকসংখ্যা  বেশি হলে অনেকক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের প্রয়ােজনীয় কাপড়-চোপড়, বিদ্যালয়ের চ্রেস ইত্যাদি কিনে দেওয়া সম্ভব হয় না। 

৩. বাসস্থান:

বর্তমানে দেশে যে হারে লােকসংখ্যা বাড়ছে তাতে প্রতিবছর আড়াই লক্ষের মতো অতিরিক্ত গৃহের প্রয়ােজন। এ প্রয়ােজন মেটাতে গিয়ে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গাছপালা ও বনজঙ্গল উজাড় হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে পরিবেশ সমস্যা।

৪. শিক্ষা :

সম্পদ সীমিত হওয়ার কারণে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সরকার ও পরিবার উভয়ই ব্যর্থ।ফলে অনেক শিশু শিক্ষা লাত থেকে বঞ্চিত হয়।৫. চিকিৎসা :জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি বাংলাদেশের সকল নাগরিককে চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রধান প্রতিবন্ধক। উপরিউক্ত আলােচনা থেকে বােঝা যায় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে ।

৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ কী? জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি কিভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে?

জনসংখ্যা যেকোনাে দেশের তথা পৃথিবীর মূল সম্পদ। তবে এ জনসংখ্যা যদি কোনাে দেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয় তবে দেখা দেয়া বহবিধ সমস্যা । বর্তমান পৃথিবীতে জনসংখ্যা সমস্যা একটি বিশাল সমস্যা। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলােতে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে আছে। কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলােতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের এক হিসেব অনুযায়ী ৫০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটির মধ্যে ছিল। পৃথিবী বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৬,৯৩৫,৩০০ বিলিয়ন (ইউ এস. সেনসাস ব্যুরাে’স ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ক্লক , ৪ আগস্ট, ২০১১)। এ বিপল জনস্ফীতিকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুধের মৌলিক অধিকার খাদ্য,  বস্ত্র,  বাসস্থান ও চিকিৎসার উপর যেমন প্রভাব পড়ছে তেমনিভাবে নষ্ট করছে পরিবেশের ভারসাম্য। নিচে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি কীভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে তা উল্লেখ করা হলাে:

১) জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে যানবাহনের সংখ্যা। আর ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন যানবাহনের নির্গত কালাে ধোয়ার ফলে পরিবেশের অন্যতম উপাদান বায়ু বা বাতাস দূষিত হচ্ছে।
২) বিভিন্ন যানবাহনে ব্যবহৃত হর্ন শব্দ দূষণ করছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট  হয়ে যাচ্ছে।

৩) জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে দেশের সকল নাগরিকের সার্বিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য মহামারি আকারে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত ক্ষতিকর।

৪) জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গাছপালা সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। 

9Oct2020

অধ্যায়-১৪: আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থা

১.জাতিসংঘ কি? এর মৌলিক উদ্দেশ্য ও নীতিমালা ব্যাখ্যা করুন।

অথবা, জাতিসংঘ কীভাবে এবং কেন গঠিত হয়েছে ব্যাখ্যা করুন ।

অথবা, জাতিসংঘের মৌলিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সংসদে গৃহীত নীতিমালা গুলো উল্লেখ করুন।

বর্তমান বিশ্বে ১৯৬ টি দেশ রয়েছে। এসকল দেশগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম হলেও নানামুখী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং নিজেদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি দেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অন্যের সহযোগিতা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সকলের সহযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, একটি শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা । এসব আঞ্চলিক সংস্থাসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘ:

জাতিতে জাতিতে সংঘাত, স্বার্থের দ্বন্দ্ব মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে ।বিশেষ করে গত শতাব্দীতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতা ,ধ্বংসের ব্যাপকতা এবং ভয়াবহ পরিণতি দেখে বিশ্বের মানুষ যুদ্ধের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বিশ্ববাসীকে ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছিল। বিশ্বনেতৃবৃন্দ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা এবং সকলের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি লীগ অফ নেশনস গঠন করেন ।বিভিন্ন কারণে এই সংস্থাটি অকার্যকর হয়ে পড়লে পুনরায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধের ভয়াবহতা মানুষের বিবেককে নাড়া দেয় এবং মানব সভ্যতার স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৫সালের ২৪ অক্টোবর ৫১ টি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে এক সনদ বা চার্টার স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতিসংঘ গঠিত হয় ।জাতিসংঘের বর্তমান সদস্য সংখ্যা১৯৩। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তর অবস্থিত। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের১৩৭ তম সদস্য।

জাতিসংঘের মৌলিক উদ্দেশ্য:

জাতিসংঘ সনদে উল্লেখিত জাতিসংঘের প্রধান চারটি মৌলিক উদ্দেশ্য রয়েছে। সেগুলো হলো:

১.সারা বিশ্বের শান্তি বজায় রাখা।
২.সকল জাতির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করা ।
৩.দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, ক্ষুধা,রোগ-ব্যাধি ও অশিক্ষা দূরীকরণ এবং পরস্পরের স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়ে প্রত্যেক জাতিকে একত্রে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা এবং
৪. লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিসংঘ বিভিন্ন জাতির কার্যকলাপের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করা।

উপরিউক্ত উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য সনদ অনুযায়ী জাতিসংঘের কতগুলো নীতি রয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ:

  • সকল সদস্যকে জাতীয় মর্যাদা দিতে হবে।
  • সনদ অনুযায়ী সকল সদস্য রাষ্ট্র‌ই গৃহীত দায়িত্ব পালন করবে।
  • আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসম্বাদসমূহ সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্র মিলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের জন্য প্রস্তুত থাকবে।
  • কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করবে না। *আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্র‌ই বল প্রয়োগ করবে না ।
    *বর্তমান সনদ অনুযায়ী জাতিসংঘ যেকোন দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলে সকল রাষ্ট্র‌ই যথারীতি সাহায্য করবে এবং *জাতিসংঘের সদস্য নয় এমন সকল রাষ্ট্র‌ও যাতে জাতিসংঘের নির্দেশ মেনে চলে তা লক্ষ্য রাখতে হবে।

২. জাতিসংঘ কয়টি বিভাগ নিয়ে গঠিত? সেগুলোর বিবরণ দিন।

অথবা, জাতিসংঘ কয়টি সংস্থা বা বিভাগ নিয়ে গঠিত? যেকোনো দুটি সংস্থার বিবরণ দিন।

উত্তর জাতিসংঘ প্রধানত ৬টি সংস্থা বা বিভাগ নিয়ে গঠিত। সেগুলো নিম্নরূপ:

১. সাধারণ পরিষদ
২.নিরাপত্তা পরিষদ
৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ
৪. অছি পরিষদ
৫.আন্তর্জাতিক আদালত
৬.জাতিসংঘ সচিবালয়

জাতিসংঘের অঙ্গীভূত সংস্থাসমূহের গঠন, কাজ এবং বিশ্ব মানবতার কল্যাণে সংস্থাসমূহের ভূমিকা সম্পর্কে নিচে বিবরণ দেওয়া হলো :

১.সাধারণ পরিষদ:

জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র‌ই সাধারণ পরিষদের সদস্য। সকল সদস্য রাষ্ট্র কোন ইস্যুতে মাত্র একটি করে ভোটদানের অধিকার রাখে। সাধারণ পরিষদের নিয়মিত সভা সাধারণত প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।এছাড়াও বিশেষ প্রয়োজন অনুসারে একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হতে পারে। প্রতি অধিবেশনের শুরুতেই সদস্যদের মধ্য থেকে একজন সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সভার কাজ পরিচালনা করেন। যে কোনো প্রস্তাব পাসের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়। এ পরিষদ প্রধানত মহাসচিব নিয়োগ, জাতিসংঘের বাজেট পাস ,বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে সহায়তা করা ,সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদেয় চাঁদা নির্ধারণ, নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচন, অন্যান্য সংস্থার বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনা ,নতুন সদস্য গ্রহণ এবং শর্ত ভঙ্গের কারণে কোনো সদস্যকে বহিষ্কার ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সদস্য নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো এ পরিষদ করে থাকে।

২.নিরাপত্তা পরিষদ:

নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এই বিভাগ ৫ টি স্থায়ী সদস্য এবং দশটি অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত ।অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র সাধারণ পরিষদের সদস্যদের ভোটে প্রতি দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হয়।৫টি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ,যুক্তরাজ্য ,রাশিয়া, ফ্রান্স ও গণচীন। নিরাপত্তা পরিষদে ওঠার মত যে কোন প্রস্তাবের সাথে এই পাঁচটি রাষ্ট্র দ্বিমত পোষণ করলে সেটি আর অনুমোদিত হয় না, এ ক্ষমতাকে বলা হয় ভেটো।
বিশ্বশান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব এই পরিষদের ওপর । এই পরিষদ দ্বন্দ্বেরত দেশগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা, মধ্যস্থতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করে। কোনো বিরোধ নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হলে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ:

এই পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৫৪ জন ।প্রতি ৩ বছর অন্তর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করেন। প্রত্যেক সদস্যের একটি করে ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে । সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে যেকোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বছরে কমপক্ষে ২ বার নিউইয়র্ক কিংবা জেনেভায় এই পরিষদের অধিবেশন বসে। পরিষদের প্রধান কাজ হল সদস্য দেশগুলোর মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বেকার সমস্যার সমাধান, শিক্ষার প্রসার ঘটানো, মানবাধিকার কার্যকর করার মাধ্যমে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন। এছাড়াও বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক বিষয়ে সাধারণ পরিষদের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করাও এই পরিষদের অন্যতম দায়িত্ব।

৪.অছি পরিষদ:

নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং নির্বাচিত অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে এই পরিষদ গঠিত। এই পরিষদের মাধ্যমে জাতিসংঘ বিশ্বের অনুন্নত অঞ্চল‌ শাসনকার্যে দিক থেকে বিশৃংখল দেশের উন্নয়নের দায়িত্ব নেয়। অছিভুক্ত অঞ্চলের উন্নতি এবং এলাকার অধিবাসীদের দেশ শাসনের উপযোগী করে গড়ে তোলাই হচ্ছে অছি পরিষদের কাজ ।

৫. আন্তর্জাতিক আদালত :

১৫ জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক আদালত হল জাতিসংঘের বিচারালয়। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দি হেগ‌ শহরে এটি অবস্থিত। জাতিসংঘের যে কোন সদস্য রাষ্ট্র যেকোনো আন্তর্জাতিক বিরোধ মীমাংসার জন্য এই আদালতে বিচার প্রার্থী হতে পারে। এই আদালতের রায় নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক কার্যকরী করা হয় ।

৬.জাতিসংঘ সচিবালয়

জাতিসংঘ সচিবালয় হল জাতিসংঘের প্রশাসনিক বিভাগ। মহাসচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে এটি গঠিত। মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ৫ বছরের জন্য নিযুক্ত হন। জাতিসংঘ সচিবালয় তার অন্তর্ভুক্ত ৯ টি বিভাগের মাধ্যমে সকল প্রশাসনিক কাজগুলো পরিচালনা করে থাকে।

৩. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা আলোচনা করুন।

মূলত বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল । প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্বে বিরাজমান নানা সমস্যার সমাধানে এ প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এসব সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে জাতিসংঘের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্ববাসীকে যুদ্ধভয় থেকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা, বিবাদমান দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ,অকার্যকর চুক্তির পরিবর্তন, বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আইনের পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উন্নতি, প্রগতি এবং সংহতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জাতিসংঘ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীর সদস্যগণ জাতিসংঘের বিশ্বশান্তি‌ রক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসেবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বীরত্ব ও প্রশংসার সাথে কাজ করে যাচ্ছে ।জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বার্থ, শিক্ষা ,শ্রম, মানবাধিকার সংরক্ষণ প্রবৃত্তি ক্ষেত্রে নিরলস কাজ করে আসছে যা প্রশংসার দাবিদার ।ক্ষুধা-দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ,মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ দূষণ জনিত সমস্যা মোকাবেলা, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ, নারী ও শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে জাতিসংঘ মানবকল্যাণে শক্তিশালী ভূমিকা রেখে চলেছে।

মোটকথা বিশ্বব্যাপী সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধন করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র এবং দুর্বল দেশগুলোর জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। জাতিসংঘ তার অঙ্গীভূত বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের শিশু কল্যাণ ,নারী কল্যাণ, জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, মানবাধিকার বাস্তবায়ন ,শিক্ষা,স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বিবাদ সমস্যার সমাধান ইত্যাদি ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।

৪. জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শিশু তহবিল কি ? এর কাজ কি?

অথবা, ইউনিসেফ শিশুদের জন্য কি কি কাজ করে?

এই সংস্থাটি শিশুদের জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় আবাস হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন দেশের সরকার, সম্প্রদায় ও পরিবারকে সাহায্য করে। ১৯৪৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের একমাত্র সংস্থা ইউনিসেফ যা শিশু ও নারী অধিকার নিশ্চিত করতে কঠোরভাবে নিবেদিত । ইউনিসেফের শিশু অধিকার কনভেনশন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়স্ক সকলেই শিশু হিসেবে বিবেচিত। ইউনিসেফ ১৬১ টি দেশে কাজ করে ।সুন্দর জীবন যাপনে উৎসাহিত করা, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ও মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে সহায়তা ,গর্ভধারণ ও শিশু জন্ম নিরাপদ করা, লিঙ্গবৈষম্য প্রতিহত করা ,মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সমাজকে সচেতন করা, কিশোর-কিশোরীদের সমাজের যোগ্য নাগরিক হিসেবে টিকে থাকার জন্য দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা ও তাদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। জরুরি অবস্থায় সাড়া প্রদান যেমন দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহায্য নিয়ে শিক্ষায়তন পুনরায় চালু করা ও শিশুদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল নিশ্চিত করাও ইউনিসেফের কাজ। ইউনিসেফ মানব সেবা মূলক কাজের জন্য১৯৬৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।

৫.ইউনেস্কো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উন্নয়নে কি কি ভূমিকা পালন করে তা ব্যাখ্যা করুন?

মানবজাতির মানবতা ,বিচার বুদ্ধি, চিন্তা ও নৈতিক সংহতির ওপর ভিত্তি করে বিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির গড়ে তোলার জন্য ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘ শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এর সদর দপ্তর অবস্থিত। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৮৯। এই সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ,বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন এ ৪টি ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে।
ইউনেস্কো কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো শান্তি ও মানব সংস্কৃতির বিকাশ সাধন এবং উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করা। সকলের জন্য শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন, আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক কর্মসূচির মাধ্যমে পরিবেশ -গবেষণার উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য লালনে সহায়তা, বিশ্বের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসার, তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষের যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দুই বছর পর পর ইউনেস্কোর পরিচালনা সভায় সকল সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে গৃহীত কর্মসূচিগুলোর অগ্রগতি তদারকি করেন ।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর এ সংস্থায় যোগদান করে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশন গঠন করে।এটি বাংলাদেশ ইউনেস্কোর কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করে থাকে। ইউনেস্কো বাংলাদেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণসহ, বয়স্ক শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়ন , যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ইউনেস্কোর উদ্যোগেই বাংলাদেশের ভাষা শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুন্দরবন সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (যেমন বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ ও পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার) সংরক্ষণেও ইউনেস্কো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

৬. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান কাজ কি?

১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গঠিত হয় ।জেনেভা শহরে এ সংস্থাটির সদর দপ্তর অবস্থিত। ১৯১ মন্তব্য রাষ্ট্র এ সংস্থার সদস্য। বছরে একবারের সভা বসে। এর প্রধানকে বলা হয় মহাপরিচালক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান কাজ: এ সংস্থাটি বিশ্বের বিভিন্ন জাতিসমূহের স্বাস্থ্য- সুরক্ষায় কারিগরি সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করে রোগ প্রতিরোধ ,নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের বিভিন্ন রকম কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নত করার চেষ্টা চালায় ।বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য- সুবিধা নিশ্চিত করাই এ সংস্থাটির প্রধান লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্য কার্যকরী করার জন্য WHO নিম্নলিখিত কাজগুলো করে থাকে:

  • দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে অতিরিক্ত মৃত্যুহার,স্বাস্থ্যহীনতা ,প্রতিবন্ধিত্ব হ্রাস করা ।
  • *সুস্থ জীবন বিকাশের পথে স্বাস্থ্যের ওপর পরিবেশগত,অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আচরণগত যে হুমকি সৃষ্টি হয় তা কমিয়ে আনা।
  • এমন স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকাশ ঘটানো যা সুসময ও কার্যকর ।আর্থিক বিবেচনায় ন্যায্য ও সহজপ্রাপ্য ।
  • যথাযথ স্বাস্থ্য নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশ তৈরী এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ,পরিবেশগত ও উন্নয়ন নীতিতে স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব প্রদান।

WHO বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যেমন-

  • এদেশ থেকে সংক্রামক ব্যাধি দূরীকরণে সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে
  • এদেশের শিশুদের ৬ টি মূল রোগ যথা: ডিফথেরিয়া, হাম, টিটেনাস, যক্ষ্মা, পোলিও হুপিং কাশি দূরীকরণ ও প্রতিরোধে WHO বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।
  • এছাড়াও এদেশ থেকে ম্যালেরিয়া দূরীকরণ, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, পয়নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য সংস্থাটি কাজ করছে।

৭. জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি এর কাজ কি?

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা এবং জাতিসংঘের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকে। সংস্থাটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নয়নের জন্য বছরে মোট ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ দিয়ে থাকে। এটি জাতিসংঘের সবচেয়ে বৃহৎ উন্নয়ন সংস্থা। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই সংস্থা সম্পদ ও সহযোগিতার সর্বোত্তম সদ্ব্যবহারের জন্য সকল অংশীদারদের নিয়ে একযোগে কাজ করে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনায় জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে এই সংস্থা বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ইউএনডিপি সদর দপ্তর অবস্থিত।

৮ .আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা ILO কি? এর কাজ কি?

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা যা সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকার উত্তরণের প্রচেষ্টায় কাজ করে । আইএলও আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি ও কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে একটি আন্তর্জাতিক শ্রমমান গড়ে তুলে, যা এসব নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। এসব নীতিকে কার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সরকারকে কারিগরি সহযোগিতা, বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের সহায়তা এবং এসব কর্মসূচির সার্থক বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, গবেষণা প্রভৃতি কাজে আইএলও সহায়তা করে। আইএলও শ্রম প্রসঙ্গে যেকোনো নীতিনির্ধারণ ও সরকারের শ্রমিক-কর্মচারী প্রতিনিধিদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর সদর দপ্তর জেনেভায় অবস্থিত।

৯. বিশ্ব ব্যাংক কি বা WB কি?

বিশ্ব ব্যাংক :বিশ্ব ব্যাংক হচ্ছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি গোষ্ঠী। দরিদ্র দেশসমূহের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য হ্রাস করাই হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের সাধারণ লক্ষ্য । এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সহায়তাদান। প্রত্যেক সদস্য দেশের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত একটি পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক বিশ্বব্যাংক পরিচালিত হয়। এর প্রধানকে বলা হয় প্রেসিডেন্ট এবং সদর দপ্তর ওয়াশিংটনে অবস্থিত।

১০. সার্কের মূল নীতিগুলো উল্লেখ করুন।

সার্কের মূলনীতি:সার্কের মূলনীতি সমূহ নিম্নরূপ:

  • এ সংস্থার যেকোন সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হবে।
  • দুটি দেশের মধ্যকার বিরোধ সংক্রান্ত কোন সমস্যা এ সংস্থায় আলোচনা করা যাবে না।
  • সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর আঞ্চলিকতা, সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং পারস্পরিক কল্যাণকে সহযোগিতার ভিত্তি হিসেবে দেখা হবে এবং
  • এ অঞ্চলের দেশগুলোর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি লক্ষ্য রেখে সার্ক ভূমিকা গ্রহণ করবে।

১১. সার্ক গঠনের উদ্দেশ্য কি?

সার্ক গঠনের উদ্দেশ্য:

১. সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা;
২. এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন ও সংস্কৃতির বিকাশ নিশ্চিত করা;
৩. দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে জাতীয়ভাবে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
৪. এ অঞ্চলের রাষ্ট্র গুলোর সাধারণ স্বার্থে সহানুভূতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা;
৫. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন ;
৬. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া;
৭. সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিরাজমান সমস্যা দূর করে পারস্পরিক সমঝোতা সৃষ্টি করা;
৮. দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অখণ্ডতার নীতি মেনে চলা; এবং
৯. অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।

১২. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংগঠন হিসেবে সার্ক এর উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব উল্লেখ করুন।

আঞ্চলিক সহযোগিতা সংগঠন হিসেবে সার্ক এর উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব :সার্ক বিভিন্নভাবে অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। বিভিন্ন সার্কভুক্ত দেশগুলো একে অপরের উন্নয়নে কাজ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সার্ক অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো অভিন্ন স্বার্থ নিয়ে কাজ করছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর বেশকিছু অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। যেমন: নিরক্ষরতা ,পরিবেশ দূষণ, সন্ত্রাস, শিশু ও নারী পাচার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অভিন্ন নদীর পানি বন্টন, বিদ্যুৎ শক্তির সংকট ,খাদ্য সমস্যা ইত্যাদি।

সার্ক এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে এটাই সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনগণের প্রত্যাশা।

এছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে মানব পাচার রোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের যৌথ উদ্যোগ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সার্কভুক্ত দেশগুলো অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।

সর্বোপরি অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে অর্থনৈতিক ,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সার্ক এক মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।

8Oct2020

অধ্যায়-১৩: অধিকার, দায়িত্ব ও মানবাধিকার

১. মানবাধিকার সংরক্ষণে নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য লিখুন।

অথবা, মানবাধিকার কী? প্রধান প্রধান মানবাধিকার গুলোর বর্ণনা। একজন নাগরিক হিসেবে মানবাধিকার সংরক্ষণের আপনি কী ভূমিকা পালন করবেন ?

অথবা, “মানবাধিকার সংরক্ষণ রাস্ট্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে” -এর যথার্থতা ব্যাখ্যা করুন ।

মানবাধিকার :

মানুষ হিসেবে আমাদের সবার সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এ জন্য আমাদের কিছু সুযােগসুবিধা দরকার হয়। যেমন-শিক্ষা গ্রহণের সুবিধা, স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযােগ। মানুষের ভালােভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়ােজনীয় এসব সুযােগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারগুলােকে বলা হয় মানবাধিকার। মানবাধিকার হলাে সেইসব অধিকার যা নিয়ে মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে এবং যা অর্জিত হলে সে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে পারে । একজন মানুষকে যেকোনাে সমাজে-রাষ্ট্রে-পরিবারে-শ্রেণিতে-লিঙ্গে সম্প্রদায়ে-ধর্মে-জাতিগােষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করে না কেন, এই অধিকারগুলাে তার ন্যায্য পাওনা। কেউ এগুলাে থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারে না। এগুলাে পাওয়ার ব্যাপারে কারাে উপর কোনাে শর্ত আরােপ করা চলবে। , কারাে বেলায় এগুলাে কমানাে-বাড়ানােরও অবকাশ নেই।

বিশ্বের মানুষের কতগুলাে অভিন্ন অধিকার আছে, যাকে মৌলিক মানবাধিকার বলে । যেমন-সব মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার, শিক্ষা গ্রহণের অধিকার, বিচার পাওয়ার অধিকার, নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, নিরাপত্তা লাভের অধিকার, নিজের মত প্রকাশের অধিকার, সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি। মানবাধিকার একটি সর্বজনীন অধিকার। এটি মানুষের এমন কিছু সহজাত অধিকার যা ছাড়া মানুষের সত্যিকার বিকাশ সাধন হয় না। মানবাধিকারকে মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, অঞ্চল নির্বিশেষে মানবাধিকার সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষের শারীরিক, মানসিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি অধিকার মানবাধিকারের অন্তর্গত। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘােষিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় (The Universal Declaration of Human Rights) বর্ণিত অধিকার গুলি বর্তমানে মানবাধিকার হিসেবে খ্যাত। ৩০টি অনুচ্ছেদে সংবলিত এই ঘােষণায় মােট ২৫টি মানবাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তার মধ্যে ১৯টি নাগরিক ও রাজনৈতিক এবং অন্য ৬টি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কিত অধিকার। এর মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭টি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (মণ্ডল ও মণ্ডল, ১৯৯৯)।

 নিচে প্রধান প্রধান মানবাধিকার বর্ণনা করা হলাে :

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার :

বিভিন্ন মানবাধিকার সনদে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে মানবাধিকারের অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের মূল বক্তব্য হলাে- জাতি, গােত্র, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের বেশ কিছু নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রয়েছে। মানুষের 

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে উল্লেখযােগ্য বিভিন্ন অধিকার হলাে : জীবন রক্ষার অধিকার, নির্যাতন ও মানবিক আচরণ হতে মুক্তি, দাসত্ব ও বাধ্যতামূলক শ্রম হতে মুক্তি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার, আটক ব্যক্তির মানবিক আচরণ পাবার অধিকার, ক্ণের দায়ে কারাবাস না থাকার স্বাধীনতা, চালাচল (বা স্থানান্তর) এবং নিবাস পছন্দের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রে অবস্থানরত বিদেশিদের খামখেয়ালিভাবে বহিস্কৃত না হবার স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ বিচার পাবার স্বাধীনতা, পূর্ব থেকে কার্যকর বলে পরে ঘােষিত কোনাে অপরাধ আইন থেকে রক্ষা পাবার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাবার অধিকার, গােপনীয়তা রক্ষার অধিকার, চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, মতামত দান ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যুদ্ধের প্রচারণা ও জাতিগত, গােষ্ঠীগত বা ধর্মীয় ঘৃণা উদ্রেককারী প্রচারণার উপর বিধি নিষেধ, সমবেত সংগঠন করার অধিকার, সংগঠন করার স্বাধীনতা, বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার, শিশুদের অধিকার, রাজনীতি করার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমান, সংখ্যালঘুদের অধিকার। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারঃ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার মূলত মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মর্যাদার জন্য অপরিহার্য । সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা পাবার অধিকার রয়েছে। প্রতিটি রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলাে তার নাগরিকের মর্যাদা রক্ষায় দায়িত্ব নেয়া। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে সর্বজনীন মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই মানবাধিকারের মধ্যে বিভিন্ন অধিকার অন্তর্ভুক্ত। সেগুলাে হল: কাজের অধিকার, কাজের যথার্থ ও অনুকূল পরিবেশ পাওয়ার অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও এতে অংশগ্রহণের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার, পরিবার সংরক্ষণ এবং মা ও শিশুর সাহায্য-সহযােগিতা পাওয়ার অধিকার, জীবনযাত্রার যথাযথ মান উপভােগের অধিকার, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রাপ্য সর্বোচ্চ মান উপভােগের অধিকার, শিক্ষালাভের অধিকার এবং এই অধিকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের এবং বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের সুযােগলাভের অধিকার। দলীয় অধিকারঃ বিভিন্ন দলীয় অধিকারসমূহ মানবাধিকারের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সমস্ত দলীয় অধিকারের মধ্যে নারীর অধিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকার, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার, সংখ্যালঘু ভাষিকের অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, অভিবাসন শ্রমিকের অধিকার, প্রতিবন্ধীর অধিকার, সংখ্যালঘু যৌনকর্মীর অধিকার এবং বন্দির অধিকার উল্লেখযােগ্য। মূলত মানবাধিকারের মাধ্যমে এই সমস্ত দলের একদিকে যেমন মানুষ হিসেবে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে মানুষ হিসেবে সমাজে তাদের মর্যাদা অক্ষুন্ন ও সমস্ত বৈষম্য নিরসনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংরক্ষণে নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্যঃ যদিও মানবাধিকার সংরক্ষণে রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করে থাকে, তবুও মানবাধিকার যাতে সুরক্ষিত থাকে সেজন্য নাগরিক একদিকে যেমন রাষ্ট্র ও সরকারকে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপ প্রয়ােগ, কৌশল প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে, অন্যদিকে অন্যের মানবাধিকার সংরক্ষণে ব্যক্তি নিজে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না সে ব্যাপারে সচেতন থেকে মানবাধিকার সংরক্ষণে সার্বিক ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদসমূহ অনুমােদন ও স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে মানবাধিকার সংরক্ষণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানেও মানবাধিকারের বিভিন্ন অধিকারসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও ইউএন প্যারিস নীতিসমূহের ওপর ভিত্তি করে ২০০৯ সালে সরকার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করেন। বর্তমানে এই কমিশন মানবাধিকার সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলছে। তবে মানবাধিকার সংরক্ষণে নাগরিক সমাজের কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য । যদি প্রতিটি নাগরিক অন্যের প্রতি ও রাষ্ট্রের প্রতি যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করে তাহলে প্রতিটি নাগরিকের যে মানবাধিকার রয়েছে তা পূরণের নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব।

 নিচে মানবাধিকার সংরক্ষণে নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য আলােচনা করা হল :

১) মানবাধিকার সংস্কৃতি উন্নয়নে সহায়তা করাঃ 

নাগরিকের মানবাধিকার সংরক্ষণে মানবাধিকার বানধৰ সমাজ গঠন করা প্রয়ােজন ।সমাজে হদি মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠে তাহলে শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করে মানবাধিকার সংরক্ষণ করা কঠিন। মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে উঠার জন্য নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সর্বাধিক। একটি দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক মানবাধিকারের ইসু সমূহের সাথে পরিচিত না হয় তাহলে মানবাধিকারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না।

২) সরকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনগণের মধ্যে ডায়ালগে ও পার্টনারশিপে অংশগ্রহণ করা  :

মানবাধিকারের বিষয়টি একটি যৌধ। প্রচেষ্টা। কোন ব্যক্তি, সংগঠন  রাস্ট্রএককভাবে মানবাধিকার সংরক্ষণে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে না। প্রত্যেকটি নাগরিক সংগঠন ও সরকার এর সমন্বিত এবং যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানবাধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়ােজন  বিভিন্ন ডায়ালগ ও পার্টনারশিপের। নাগরিক হিসেবে একজন ব্যক্তির উচিত এই ডায়ালগ এবং পার্টনারশিপ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ, কর্মপরিকল্পন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।

 ৩) মানবাধিকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাঃ

 মানবাধিকার সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক আইন রয়েছে। প্রত্যেকটি নাগরিকের অন্যতম দ্যয়িত্ব ও কর্তব্য হল ঐ সমস্ত আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে মানবাধিকার সংরক্ষণে সহায়তা প্রদান করা ।

৪) মানবাধিকার বিষয়ে সচেতন হওয়াঃ

 প্রত্যেক নাগরিক যদি মানবাধিকার বিষয়ে সচেতন হয় তাহলে মানবাধিকার সংরক্ষণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষত মানবাধিকার বিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যসূচিতে অশগ্রহণ নিজেকে সক্রিয় হতে হবে। 

৫) সমাজে গণতান্ত্রিক চর্চা ও উন্নয়নে সহায়তা করা :

 মানবাধিকার সংরক্ষণে সমাজের গণতান্ত্রিক চর্চার ধারা অব্যাহত রাখা জরুবি। গণতন্ত্রকে মানবাধিকারের অন্যতম ভিত্তি বলে মনে করা হয়। যে সমাজ যতটা গণতান্ত্রিক সে সমাজ ততটা সভ্য। অন্যদিকে সভ্যতা মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় সূচক। 

৬) মানবাধিকার ডিফেন্ডারের পক্ষে ও সহিংসতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া :

প্রত্যেক নাগরিকের উচিত মানবাধিকার যেই লংঘন করুক। না কেন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং তার প্রতিবাদ করা এবং সহিংস আচরণের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পাশে অবস্থান নিয়ে ঐ ব্যক্তিকে সাহস যােগানাে ও মানবাধিকার উন্নয়ন ও সংরক্ষণে সহায়তা করা।

 ৭) মুক্ত ও স্বাধীন মিডিয়া তৈরিতে সহায়তা করা :

মানবাধিকার সংরক্ষণে মুক্ত ও স্বাধীন মিডিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হল মুক্ত ও স্বাধীন মিডিয়া গঠনে অব্যাহত সহায়তা প্রদান।

৮)  ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা:

প্রতিটি সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠীর পাশাপাশি সংখ্যালঘিষ্ট জনগােষ্ঠী বাস করে। মুসলমান বাংলাদেশে প্রধান ধর্মীয় গােষ্ঠী হলেও এখানে অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেমন- হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদির বসবাস রয়েছে। ফলে প্রত্যেক নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হল এই সমস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের মানবাধিকার সংরক্ষণে সহায়তা করা।

 ৯ ) নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা : 

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার সম্মুখীন হয়। প্রত্যেক নাগরিকের উচিত নারীর প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ হচ্ছে সে বিষয়ে সচেতন হয়ে বৈষম্য নিরসনে উদ্যোগী ভূমিকা রাখা। 

১০) অন্যের মতামতে শ্রদ্ধাশীল থাকা :

প্রত্যেক নাগরিক অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে তারা  মানবাধিকার সংরক্ষণে শুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ব্যক্তি যখন অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং যৌক্তিকভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলবে তখন সমাজে সহিংসতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে।

১১) ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়াঃ 

বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বসবাস রয়েছে। এদের অনেকের মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে এদের মানবাধিকারের প্রতি যত্নশীল হওয়া। এর ফলে তাদের মানবাধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব।

উপসংহারঃ 

মানবাধিকার রক্ষার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি জাতিসংঘ স্বীকৃত। মানবতার মুক্তির জন্য এতে কাজ করা হয়। এটি মানবীয় কল্যাণের জন্য নিবেদিত । যার ফলে বিশ্বব্যাপী গঠিত হয়েছে মানবাধিকার কমিশন।

২. অধিকার বলতে কী বােঝায়? শিশুর কী কী অধিকার থাকার প্রয়ােজন? শিশু তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে শিশুর মনে কী প্রভাব পড়তে পারে? 

অথবা, শিশুর কী অধিকার থাকার প্রয়ােজনা শিশু তার অধিকার থেকে বাঞ্চিত হলে শিশুর মনে কী প্রভাব পড়বে? 

অথবা ,, অধিকার বলতে কি বুঝায়? শিশুর কি কি অধিকার থাকা প্রয়ােজন? শিত তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে শিশুর মনে কি প্রভাব পড়তে পারে বলে আপনি মনে করেন? 

অধিকারঃ 

অধিকার হলাে সে সকল বাহ্যিত  যা মানসিক পরিপুষ্টি সাধন করে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। মূলত একটি রাষ্ট্রের চরিত্র বােঝা সম্ভব হয় ঐ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কতটুকু অধিকার দিচ্ছে তার মাধ্যমে। রাষ্ট্র কতটুকু জনকল্যানকর তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের নাগরিকেরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার কী পরিমাণ ভােগ করে তার উপর ।রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কির মতে, “প্রত্যেক রাষ্ট্রই পরিচিতি পায় তার প্রদত্ত অধিকার পরিচর্যা ও লালন পালন দ্বারা (ভুইয়া, ১৯৯৭)। প্রচলিত অর্থে অধিকার হলাে মানুষের ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা। কিন্তু ক্ষমতা ও

অধিকারের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। অধিকার হলাে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত দাবি। ক্ষমতা তখনই অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে যখন রাষ্ট্র ঐ ক্ষমতা স্বীকৃতি ও অনুমােদন দেয়। অধিকারের বিষয়টি সর্বজনীন। মূলত সমাজের উন্নতি, কল্যাণ সাধন এবং ধারাবাহিকতা রক্ষায় রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্র সমাজে বসবাসরত জনগােষ্ঠীর অধিকার পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করে থাকে।

শিশু অধিকারঃ

 বিভিন্ন ডকুমেন্ট অনুযায়ী শিশুদের অধিকারগুলাে হলাে; ১) শিক্ষার অধিকার; ২) বেঁচে থাকা ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার; ৩) খাদ্য, পুষ্টি ও চিকিৎসার অধিকার; ৪) সম্পদের অধিকার; ৫) স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ পরিবেশে বসবাস ও কাজের অধিকার; ৬) একটি নাম পাওয়ার ও জন্ম রেজিস্ট্রেশনের অধিকার; ৭) ভালাে ব্যবহার পাওয়ার অধিকার; ৮) শারীরিক নির্যাতিত ও যৌন হয়রানির শিকার না হওয়ার অধিকার; ৯) শিশু শ্রমে জড়িত হওয়ার অধিকার; ১০) অল্প বয়সে বিয়ে না করার অধিকার; ১১) খেলাধুলা ও বিনােদনের অধিকার; ১২) ছেলে-মেয়ে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি নির্বিশেষে সবার সমান সুযােগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার; ১৩) আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার; ১৪) মা-বাবার সাথে একসাথে বসবাসের অধিকার; ১৫) অবৈধভাবে বিদেশে পাচার না হওয়ার অধিকার; ১৬) তথ্য পাওয়ার ও মত প্রকাশের অধিকার; ১৭) কর্মক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বীকার না হওয়ার অধিকার; ১৮) অবহেলা, শোষণ ও নির্যাতনের শিকারে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার; ইত্যাদি। 

অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে শিশুর মনে প্রভাবঃ 

উপরােক্ত অধিকার গুলি থেকে বঞ্চিত হলে শিশু মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। আমাদের দেশে এসব অধিকার বাস্তবায়নের পরিমাণ খুবই কম। এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে শিশুরা নিরাপত্তাহীন, নির্ভরশীল ও অবহেলিত হয়। শিশুরা সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ এবং সুন্দর ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠতে পারে না এবং বিভিন্ন ধরণের দৈহিক ও মানষিক ক্ষতির শিকার হয়। শিশু মনে দেখা দেয় অস্থিরতা। শিশুর অধিকারের গৃহীত আইনগুলাের কার্যকারিতাও যৎসামান্য। ফলে আমাদের দেশের শিশুরা প্রতিনিয়ত তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটি একদিকে যেমন শিশুর নিজের ক্ষতি করছে, অন্যদিকে শিশুর আদর্শ ও সক্রিয় নাগরিক হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। এ অবস্থার উত্তরণ প্রয়ােজন।

৩. রাষ্ট্রের প্রতি আদর্শ নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা করুন।

অথবা, নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য ব্যাখ্যা করুন।

রাষ্ট্র গঠনের মূল উপাদান হলো নির্দিষ্ট জনসমষ্টি, যাদেরকে রাষ্ট্রের নাগরিক বলা হয়। নাগরিক রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি। নাগরিক রাষ্ট্রকে দিয়ে অধিকার ভোগ করে। আদর্শ নাগরিক রাষ্ট্র প্রদত্ত  অধিকার ভোগ করে রাষ্ট্রের প্রতি যথার্থ দায়িত্ব পালন করে।অধিকারের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকেরই রাষ্ট্রের প্রতি বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি রাষ্ট্রব্যবস্থা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেক কর্তব্য রয়েছে যেগুলাে আইন কর্তৃক অনুমােদিত এবং এই কর্তব্যসমূহ পালন না করলে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। 

নিচে নাগরিকের প্রধান প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা করা হলো :

১. রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য :

 নাগরিকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলাে রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংহতি, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষিত হয়। আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে নাগরিক অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা ও বৈদেশিক আক্রমণ হতে দেশকে রক্ষায় সহায়তা করে থাকে।

২. আইন মান্য করা

রাষ্ট্রের আইন মানা নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। আইন অমান্য করলে নাগরিককে শাস্তি পেতে হয়। মূলত রাষ্ট্রের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়। দেশের আইন মান্য করাকে সমাজ উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়

৩. কর প্রদান

রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক নাগরিককে আয় অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে কর প্রদান করতে হয়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের উচিত সময়মত কর প্রদান করা।

৪, ভোটদান করা : 

প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হলাে ভােটাধিকার প্রয়ােগের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা। সততা ও নিষ্ঠার সাথে সৎ ও যােগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনে নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

৫. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করা :

দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রত্যেক নাগরিকের উচিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে প্রয়ােজন অনুযায়ী সার্বিক সহায়তা প্রদান করা। আইন-শৃঙ্খলা স্থিতিশীল থাকলে নাগরিকগণ সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারবে।

৬. অন্যায়ের প্রতিবাদ করা :

 সমাজের বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। অন্যায়ের প্রতিবাদের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় ।

৭. সহিষ্ণুতা প্রদর্শন :

 নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হলাে প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা। প্রত্যেকের মতামতকে গুরুত্বসহকারে শােনা এবং যৌক্তিক মতামতকে গ্রহণের মানসিকতা থাকা।

রাষ্ট্রের সুনাগরিক হতে হলে নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এগুলাে আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে একইভাবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত-কর্তব্যসমূহ যথাযথ ভাবে পালন করতে হবে।

৪. অটিস্টিক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পারিবারিক ও সামাজিক অধিকার এর গুরুত্ব বর্ণনা করুন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনগত অধিকারসমূহ উল্লেখ করুন।

শিশু অধিকার একটি সার্বজনীন বিষয়। শিশুর প্রতিটি অধিকার প্রত্যেক শিশুর পারিবারিক, সামাজিক ও এবং পরিপূর্ণ সুষম বিকাশের জন্য অপরিহার্য। বিষয়টি অটিস্টিক ও অন্যান্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানবিক মর্যাদা শিশুদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। অটিস্টিক শিশুর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এক ধরনের নিউরাে। ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধিতা। অটিস্টিক ও অন্যান্য বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সাধারণ শিশুদের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। ফলে তাদের অধিকার অনুধাবন ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। পরিবার থেকে শুর করে বিদ্যালয়, কমিউনিটি, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সকল সম্ভাব্য জায়গায় যাতে এসব শিশু তাদের সকল ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত বা বৈষম্যের শিকার না হয়, গুরুত্ব সহকারে তা নিশ্চিত করতে হবে।তারা যাতে মর্যাদা সহকারে সমাজে একজন উৎপাদনশীল নাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এজন্য শিক্ষা ও প্রয়ােজনীয় অন্যান্য দিকের প্রতি আমাদের আন্তরিক ও যত্নশীল হতে হবে ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের সমঅধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা, মৌলিক মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এই অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ ‘United Nations Convention on the Rights of the Persons with Disabilities,2006’ অনুসমর্থন করে। ফলশ্রুতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে এতদসংক্রান্ত বিদ্যমান আইন রহিতক্রমে পুনঃপ্রণয়নের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়ােজনীয় বলে মনে করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে জাতিসংঘ সনদের উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির শিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রে সমান সুযােগ এবং সব ধরনের বৈষম্য হতে মুক্তি লাভের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।

এ আইনের ১৫ নং ধারার ১ নং উপ ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যে সকল আইনগত অধিকার লাভ করবেন তা উল্লেখ করা হয়েছে।

নিম্নে কিছু অধিকার তুলে ধরা হলোঃ

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনগত অধিকারসমূহ:

@পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা;

 @সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি এবং বিচারগম্যতা;

@স্বাধীন অভিব্যক্তি ও মত প্রকাশ এবং তথ্যপ্রাপ্তি;

@প্রবেশগম্যতা;

@ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে,প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী, পূর্ণ ও কার্যকর ভাবে অংশগ্রহণ;

@শিক্ষার সকল স্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযােগ;

সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে, একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ;

@সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তি;

@কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তি কর্মে নিয়োজিত থাকিবার, অন্যথায় যথাযথ পুর্নবাসন বা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি;

@ নিপীড়ন হইতে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এর সুবিধা প্রাপ্তি;

@ প্রাপ্যতা সাপেক্ষে সর্বাধিক মানে স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি;

@ শারীরিক, মানসিক ও কারিগরি সক্ষমতা অর্জন করিয়া সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হইবার লক্ষ্যে সহায়ক সেবা ও পূর্ণবাসন সুবিধা প্রাপ্ত।

এছাড়া উপধারা(২)এ বলা হয়েছে যে, কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উপ-ধারা (১) এ উল্লেখিত অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কোন প্রকারের বৈষম্য প্রদর্শন বা বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করার ব্যাপারে এ আইনের ৩২ নং ধারার ১ নং উপধারায় বলা হর “প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনাে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্তৃপক্ষ উক্ত ব্যক্তির অন্যান্য যােগ্যতা থাকা সত্তে ভর্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করিতে পারিবেন না। একই সাথে উপধারা নং ২ এ বৈষম্যের শিকার প্রতিবন্ধী

ব্যক্তি উক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটির নিকট অভিযােগ দায়ের করতে পারবে বলে উল্লেখ রয়েছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতি কোনরূপ বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ৩৫ নং ধারায় বলা হয়ছে যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কোন প্রকার বৈষম্য প্রদর্শন বা বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না । অপর দিকে, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা, তাদের বেড়ে উঠা, নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন, সামাজিকভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাদের জন্য যথাযথ শিক্ষা ব্যবস্থার তথা মূলধারার বিদ্যালয় বা অবস্থাভেদে বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযােগ উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব দেয় ।

শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয় বরং আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশ বেশ স্বার্থকতার সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে অটিজম সহ অন্যান্য প্রতিবন্ধিতার কারণে উদ্ভূত এবং বৃদ্ধি পাওয়া বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অবদান রাখছে। আজকের শিশু জাতির সােনালী ভবিষ্যতের স্থপতি। সুন্দর কল্যাণকর জাতি গঠনের জন্য প্রয়ােজন এমন সুন্দর পরিবেশ যেখানে জাতির ভবিষ্যৎ স্থপতিগণ সকল সম্ভাবনাসহ সুস্থ, স্বাভাবিক ও স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারে।

অটিস্টিক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এরূপ একটি পরিবেশ গঠন করতে হলে তাদেরকে কারাে অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল করা যাবে না। এজন্য প্রয়ােজন এ ধরনের শিশুদের অধিকার পূরণে উপযুক্ত ও প্রয়ােজনীয় আরও আইন প্রণয়ন এবং সেগুলাে বাস্তবায়নের সম্মিলিত ও কার্যকর উদ্যোগ।

৫. বাল্যবিবাহ ও এর ক্ষতিকর দিক গুলো কী কী? বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের উপায় উল্লেখ করে এর আইনগত দিক গুলো বর্ণনা করুন।

বাল্য বিবাহ :

বাল্যবিবাহ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের পরিপন্থী এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিরােধী। এটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় সমস্যা। বাংলদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাল্য বিবাহ আইন সম্পর্কে অজ্ঞানতা ও অসচেতনতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে সমস্যাটি সমাজে বিদ্যমান। এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রচার ও প্রয়ােগের অভাবও সমস্যাটির অন্যতম কারণ। বাল্যবিবাহ , এর ক্ষতিকর দিক ও এর আইনগত দিকগুলাে সম্পর্কে সকলের জানা প্রয়োজন ।

আমাদের দেশে বর্তমান বিবাহ আইন অনুযায়ী বিয়ের সময় যদি পাত্রের বয়স ২১ বছরের নিচে এবং কনের বয়স যদি ১৮ বছরের নিচে হয়, তখন তাদের বিবাহকে বাল্যবিবাহ বলা হয়। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বেআইনী।

বাল্যবিবাহের ফলে কিশাের-কিশােরীদের বিভিন্নভাবে মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক ক্ষতি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলাে হলাে:

 ১) এ বয়সের সহজাত উচ্ছাস-বৃদ্ধি ও গতিশীলতাকে থামিয়ে দেয়।

২) দ্রুত শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়ে,হোলি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয় ও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে না।

 ৩) অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণের ফলে মেয়েদের অপুষ্টি ও গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। এমনকি প্রসবকালে মা ও শিশুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। 

 ৪) শিশুর স্বল্প ওজন হয় ও অপুষ্টিতে ভুগে জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাবেড়ে যায়। 

৫) সংসারের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে অপরিপক্ক হওয়ায় দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয় ও নারীরা অধিক মানসিকভাবে ক্ষতির নির্যাতনের শিকার হয়।

 ৬) বাল্য বিবাহের ফলে অল্প বয়সী মেয়ে তালাক প্রাপ্ত হলে তার পরিবারক আর্থিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।

 ৭) অত্যাচারিত হয়ে অনেক মেয়ে বিপথে চলে যায়, এমনকি আত্মহত্যার মত অপরাধের পথ বেছে নেয়।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আমাদের করণীয়: 

বাল্যবিবাহের মত একটি সামাজিক সমস্যাকে প্রতিহত করতে আমাদেরকে নিচের বিষয়গুলাের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা উচিত।

১) জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বিয়ের সময় জন্ম সনদ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

২) কিশােরী ও নারীদের সচেতনতার পাশাপাশি পরিবার-সমাজকে সচেতন করতে হবে।

৩)কাজী ও ইমামদের বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক ও আইনগত বিধিবিধান সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

৪ ) পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৫) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার বিশেষ করে নির্বাচিত নারী মেম্বারগণ সামাজিক প্রতিরােধ গড়ে

তুলতে সবাইকে সচেতন করবে। বাল্যবিবাহ আইন সম্পর্কে সমাজের সকলকে সচেতন করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়ােগ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই বাল্যবিবাহ রােধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

বাল্যবিবাহের আইন : 

বাল্যবিবাহ হল অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিবাহ। আইনত বিয়ের বয়স ১৮ বৎসর, বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে। কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে অভিবাবকের অনুমতি সাপেক্ষে এই বয়সের আগেও বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়। যদিও আইন অনুযায়ী বিয়ের বয়স ১৮ বৎসর, তারপরও কিছু কিছু দেশের নিজস্ব প্রথাকেই আইনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বাল্যবিবাহে মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের উপরই প্রভাব পড়ে। তবে মেয়েরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষত নিম আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণে। বেশিরভাগ বাল্যবিবাহে দুজনের মধ্যে শুধু একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। বিশেষত মেয়েরাই বাল্যবিবাহের শিকার বেশি হয়।

“বাল্যবিবাহ নিরােধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী বাল্যবিবাহ অর্থ এইরূপ বিবাহ যাহার কোন এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ অপ্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রান্ত বয়স্ক অর্থ বিবাহের ক্ষেত্রে ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনাে পুরুষ এং ১৮ (আঠারাে) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনাে নারী” ।

 বাল্যবিবাহের শাস্তি : 

বাল্যবিবাহ নিরােধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী –

৭। বাল্যবিবাহ করিবার শাস্তি:

(১) প্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক  ২(দুই) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

(২) অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করিলে তিনি অনধিক ১ (এক) মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তিযােগ্য হইবেন:

তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৮ এর অধীন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা দণ্ড প্রদান করা হইলে উক্তরূপ অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী বা পুরুষকে শাস্তি প্রদান করা যাইবে না। 

(৩) উপ-ধারা (২) এর অধীন বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে শিশু আইন, ২০১৩ (২০১৩ সনের ২৪ নং আইন) এর বিধানাবলী প্রযােজ্য হইবে ।

৮ ।বাল্যবিবাহ সংশ্লিষ্ট পিতা-মাতাসহ অন্যান্য ব্যক্তির শাস্তি : 

পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোন ব্যক্তি, আইনগতভাবে বা আইন বহির্ভূতভাবে কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হইয়া বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করিবার ক্ষেত্রে কোন কাজ করিলে অথবা করিবার অনুমতি বা নির্দেশ প্রদান করিলে অথবা স্বীয় অবহেলার কারণে বিবাহটি বন্ধ করিতে ব্যর্থ হইলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর ও অনন ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দন্ডিত হইবে।

৯। বাল্যবিবাহ সম্পাদন বা পরিচালনা করিবার শাস্তি

কোন ব্যক্তি বাল্যবিবাহ সম্পাদন বা পরিচালনা করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২

(দুই) বৎসর ও অন্য ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদন্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

১০। বাল্যবিবাহ নিবন্ধনের জন্য বিবাহ নিবন্ধনের শাস্তি, :

লাইসেন্স বাতিলকোন বিবাহ নিবন্ধক বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর ও অন্যন ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং তাহার লাইসেন্স বা নিয়ােগ বাতিল হইবে।

ব্যাখ্যা: এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, “বিবাহ নিবন্ধক” অর্থ Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974 (Act No. LII of 1974) এর অধীন লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিকাহ রেজিষ্ট্রার এবং Christian Marriage Act, 1872 (Act No. XV of 1872), Special Marriage Act, 1872 (Act No. III of 1872) ও হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ (২০১২ সনের ৪০ নং আইন) এর অধীন নিয়ােগপ্রাপ্ত বিবাহ নিবন্ধক।”

8Oct2020

অধ্যায়-১২: বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী

১. গারো জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালীর বর্ণনা দিন।

গারো:

‘গারো ‘ নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস: বাংলাদেশ বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হল গারো ।এ গোষ্ঠী কারো নামে বহুল পরিচিত হলেও এরা নিজেদের কে আচিক মান্দে বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ,শেরপুর, জামালপুর, সুনামগঞ্জ ,সিলেট, গাজীপুর জেলায় গারোদের বসবাস। তবে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর, টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় অধিকাংশ গারোদের বসবাস। মেঘালয় রাজ্য ও গারোদের বসবাস রয়েছে।
দৈহিক গঠন:
গারোদের মুখমণ্ডল গোলাকার ও সমতল। চুল ও চোখের রং কালো। ছোট চোখ ও নাক চ্যাপ্টা, ছোট কপাল ,বড় কান ও ঠোঁট মোটা হয়ে থাকে । চুল সাধারণত ঢেউ খেলানো ও কোঁকড়ানো ।পুরুষের মুখে পাতলা দাড়ি গজাতে  দেখা যায়। গারোরা উচ্চতার দিক থেকে খুব একটা লম্বা হয় না ।তবে শারীরিকভাবে খুবই শক্তিশালী ও কর্মঠ হয়ে থাকে।
পরিবার ব্যবস্থা:
গারো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা লক্ষ করা যায়। মাতা পরিবারের প্রধান ও সমস্ত সম্পত্তির মালিক। স্বামী-স্ত্রীর বাড়িতে অবস্থান করে ।পারিবারিক কাজ কর্ম সম্পাদন করার দায়িত্ব স্বামীর উপর। মায়ের পরিচয় সন্তানের পরিচয়। কন্যা সন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা রীতি অনুযায়ী সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে ,যদি না মাতা অন্য কোন কন্যাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে থাকে ।উত্তরাধিকারী কন্যাকে বলা হয় নোকনা ।আর অন্য কন্যারা এগেট নামে অভিহিত হয় ।নোকনা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে ।পরিবারের ছেলে সদস্যরা বিয়ের পর বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ।গারো বিয়েতে কোন যৌতুকের প্রচলন নেই ।গারোদের একই গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ ।এই সমাজে এক বিবাহ প্রথা বেশি লক্ষণীয়।
ধর্মীয় ব্যবস্থা:
গারোদের ধর্মের নাম সংসারেক। বাংলাদেশে অবস্থিত গারোদের বেশিরভাগ খ্রিষ্টান। কিছু গারো সর্বপ্রাণবাদ এ বিশ্বাসি ।এরা দেবতার প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন বস্তু ও শক্তিপূজা করে থাকে ।নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। এদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে ওয়াঙগালা। সমগ্র গারো  সম্প্রদায় এই উৎসবে মাতোয়ারা হয় ।গারো যুবক-যুবতীরা বিশেষ পোশাক পরিধান করে উদ্দাম নৃত্য পরিবেশন করে ।এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা তাদের স্বামী বা স্ত্রীকে পছন্দ করে নেয়। নাচের সাথে মহিষের শিংয়ের বাঁশি ও ড্রাম বাজানো হয়। দুষ্টু আত্মাকে ভয় দেখানোর জন্য ছেলেরা নৃত্য করে থাকে ।এটি সংসারেক ধর্ম পালনের একটি অংশ।

২. চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালীর বর্ণনা দিন।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম হচ্ছে চাকমা জনগোষ্ঠী ।পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এরা প্রধানত বাস করেন । ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশ চাকমা জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২,৫৩,০০০ জন। এদের মধ্যে ৯০%- এর বেশি বাস করে রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলায়।
বৈবাহিক অবস্থা: চাকমাদের নিজস্ব বংশে বা গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। বহু-বিবাহ অনুমোদিত। তবে এর প্রচলন দেখা যায় ।বিধবা বিবাহ প্রথা রয়েছে ।চাকমা ছেলেরা অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকেও  বিয়ে করতে পারে ।তবে চাকমা মেয়েদের বিয়ে চাকমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীতেই হয়ে থাকে ।চাকমা বিয়েতে বর কনের বাড়িতে যায় না। বরং বর পক্ষের লোকজন গিয়ে কন্যাকে নিয়ে বরের বাড়িতে ফিরে আসে এবং বরের বাড়িতে বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বিয়ের পর নবদম্পতি পিতার গৃহে অথবা স্বামীর নিজ গৃহে জীবন শুরু করে।
চাষাবাদ:
জুম চাষ হল জীবিকার প্রধান উৎস। নরম মাটিতে ধান, শসা ,ঢেঁড়স ,ভূট্টা, তুলা ইত্যাদি সকল ফসল উৎপাদন করে। এছাড়া অনেকেই মোরগ-মুরগি ও শুকর পালন করে ।বন থেকে শাকপাতা সবজি সংগ্রহ করে বাঁশ ও বেত দিয়ে কুটির শিল্প সামগ্রী তৈরি করে ।তারা নিজেদের কাপড় নিজেরাই তাঁতে বুনে নেয় ।চাকমা পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি পরিশ্রমী ।বর্তমানে অনেক চাকমা পুরুষ ও মহিলা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে।
প্রধান খাদ্য:
চাকমাদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত, মাছ ,সবজি। প্রধান পানীয় হিসেবে নিজেরাই তৈরি করে নেয়। চাকমারা মাটি থেকে উঁচুতে মাচার উপর ঘর নির্মাণ করে। এর সাহায্যে ঘরে ওঠে। চাকমা সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করার রীতি প্রচলিত। চাকমা সমাজে সাধারণত মৃতদেহ পোড়ানো হয়। তবে বাচ্চাদের মৃতদেহ কবর দেয়ার নিয়ম আছে। এরা যেহেতু পুর্নজন্মে বিশ্বাসী সেহেতু আত্মার কল্যাণে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে।

৩.মনিপুরী জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালীর বর্ণনা দিন।

মনিপুরী:
মনিপুরিরা সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মনিপুরী সংখ্যা ২৫,০০০।মনিপুরী সমাজ বিভিন্ন দল ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নিচে মণিপুরীদের জীবনযাপন প্রণালী বর্ণনা করা হলো:
১) ভাষা: মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য অতি প্রাচীন ।এর অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ইতিহাস কোথায় রয়েছে। মানবদেহের বিভিন্ন নামের মণিপুরী ভাষা প্রতিটি বর্ণের নামকরণ করা হয়েছে। মানবদেহে বিভিন্ন অঙ্গের আকার ও বর্ণের আকার একই রকম।
২) ধর্ম: মণিপুরীদের ধর্ম বৈষ্ণব ধর্ম। একদা মনিপুরী অঞ্চলে ব্রাত্যধর্ম প্রচলিত ছিল । মনিপুরিরা সনাতন ধর্মের অনুসারী ।মৈ তৈ পাঙন নামে একটি মুসলিম মণিপুরী জনগোষ্ঠীও আছে।
৩) জীবিকা: মণিপুরীদের প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ ।মনিপুরী পুরুষ ও মহিলারা একত্রে কৃষিক্ষেত্রে কাজ করেন ।পুরুষেরা জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি তৈরি করেন। তাতে বীজ বপন করা মহিলাদের কাজ ।ফসল লাগানো ও ফসল কাটার কাজটিকে তারা উৎসব হিসেবে উদযাপন করেন ।নারীরা কাপড় বোনায় অত্যন্ত দক্ষ।
৪) বাসস্থান: মণিপুরীদের ঘরবাড়ি ছাউনি ঘেরা বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। তবে বিত্তবানরা দালান তৈরি করেন। তারা ঘরবাড়ি খুব পরিষ্কার রাখেন ।বাড়ির আঙ্গিনায় বিভিন্ন ফুল ফলের গাছ লাগান ।তাদের পিতৃতান্ত্রিক পরিবার এবং মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার পিতার সম্পত্তির উপর নির্ভর করে।
৫) খাদ্যাভ্যাস: মণিপুরীদের প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ শুটকি, সবজী। বৈষ্ণবধর্মে মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ বলে তারা মাংস খান না ।শুটকি ভর্তা খুবই প্রিয় খাদ্য। এছাড়া কতিপয় কাঁচা সবজির কচি পাতা দিয়ে  ‘সিবেই’ (সালাদ) খেতে পছন্দ করেন। খাবারে তুলনামূলকভাবে তেল-মসলা কম খেয়ে থাকেন।
৬) পোশাক: মনিপুরিরা ভদ্র, শান্তশিষ্ট ও আত্মনির্ভরশীল সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। পুরুষেরা ধুতি, পাঞ্জাবি ,আর মেয়েরা লাহিং পরিধান করে এবং অলংকার মেয়েদের খুবই পছন্দ ।মনিপুরী সকল মেয়েরাই অলংকার পরিধান করেন।
৭) উৎসব: মনিপুরিরা মনিপুরিরা প্রায় সারা বছরই উৎসবে মেতে থাকেন। নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে তারা আনন্দ করেন ।এছাড়া রথযাত্রা, দোলযাত্রা ,হোলি উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি ,রাস পূর্ণিমা ইত্যাদি উৎসব পালন করেন ।কার্তিক মাসে রাস উৎসব তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এসব উৎসবে তারা মদ পান করেন।
৮) বিবাহ: বর্ণাঢ্য প্যান্ডেল তৈরি করা হয় তাদের বিয়েতে। বর ও কনে- এর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করতে থাকলে বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের উপর ধান দূর্বা সিটি আশীর্বাদ করেন।

উপরোক্ত আলোচনায় বলা যায় আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে মনিপুরী জাতিসত্তা অন্যতম। এদের সংস্কৃতি অনেক উন্নত । এরা আমাদের সিলেটের পূর্বাঞ্চলে বসবাস করলেও এরা ভারতের মনিপুরী রাজ্যের অধিবাসীদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এরা বর্তমানে লেখাপড়া করে উন্নত জীবনযাপন করছেন।

৪. মারমা জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালী বর্ণনা দিন।

মারমা:
জনসংখ্যার দিক দিয়ে চাকমাদের পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থানে আছে মারমা ।মারমা সম্প্রদায় প্রধানত রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলায় বাস করে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মারমা অধিবাসীর সংখ্যা ১,৫৭,৩০১ জন। কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকায় কিছু মারমা এখনো বাস করে। মারমারা মঙ্গোলীয় মিলি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
১) আকৃতি:এরা সাধারণত খাটো আকৃতির হয়ে থাকে। গালের হাড় উঁচু, গায়ের রং ফর্সা । কালো চুল, ছোট চোখ এবং চ্যাপ্টা নাক এদের সাধারণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য।
২) ভাষা: মারমারা আরাকানি উচ্চারণে কথা বলেন এদের ভাষা বার্মিজ হরফে লিখিত হয়। বর্তমানে শহর এবং এর কাছাকাছি অঞ্চলে বসবাসরত মারমারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে ।বাংলা ভাষা মারমা জনগোষ্ঠী আয়ত্ত করেছেন।
৩) পোশাক: মারমা নারী-পুরুষের পোশাক হচ্ছে ‘থামি’ ও ‘আনগি’। বর্তমানে নারী-পুরুষেরা আধুনিক পোশাক পরেন।
৪) বাসস্থান: মারমাদের বাড়ি সাধারণত মাটি থেকে উঁচুতে কাঠ অথবা বাশের পাটাতন বা মাচাং এর উপর নির্মিত হয়। ঘর তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে বাঁশ, খড় ও বুনো ঘাস ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি ঘর একই সাথে সবার জন্য এবং ভাঁড়ার-ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোথাও কোথাও মাচা ব্যতীত সমতল জায়গায় মাটির ঘর দালান দেখা যায়।
৫) ধর্ম: মারমা জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বর্তমানে তারা ধর্মান্তরিত হতে চলেছে। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠান তারা আগ্রহ ভরে পালন করে। তারা সর্বপ্রাণবাদ এ বিশ্বাসী। তাদের বিশ্বাস যে,তাদের জন্ম মৃত্যু এবং জীবনের সকল কর্মকান্ড এক অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। তারা বিভিন্ন দেবদেবীর অনুগ্রহ লাভের জন্য পূজা করে থাকেন।
৬) খাদ্যাভ্যাস: ভাত, মাছ ও মাংস সিদ্ধ শাকসবজি হচ্ছে মারমাদের প্রধান খাবার। তবে নাপ্পি নামক শুটকি মাছের মন্ড মারমাদের অতি প্রিয়। মারমারা রোড ও ভাত থেকে তৈরি মদ পান করেন। রান্নার জন্য তারা মাটির পাত্র ব্যবহার করেন। এছাড়া বাঁশ ও কাঠের তৈরি জিনিসপত্র তারা ব্যবহার করে থাকেন।
৭) সমাজ ব্যবস্থা: মারমাদের মধ্যে একক পরিবারের প্রচলন দেখা যায়। স্বামীরা যদিও পরিবারের প্রধান, তথাপি নারীদের পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
৮) জীবিকা: কৃষিকাজ মারমাদের প্রধান পেশা, বিশেষ করে জুম চাষ। এছাড়া মারমারা বিভিন্ন গাছের পাতা,মূল ও কান্ড জাতীয় খাবার বন থেকে সংগ্রহ করে থাকে। মারমা নারীরা তাঁত বোনার কাজ ও করে। বর্তমানে মারমারা ব্যবসা-বাণিজ্য দিকে ঝুঁকছে।
৯) বিবাহ: সামাজিক জীবনে বিবাহ তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহুবিবাহ ও এক বিবাহ প্রচলিত আছে ।তবে তাদের মধ্যে বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ।
মারমা জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। প্রতি মাসে তারা ‘ল্যাব্রে’নামে একটি উৎসব পালন করে। বর্মী ভাষায় ‘ল্যাব্রের’ অর্থ হলো পূর্ণচন্দ্র বা পূর্ণিমা। জলের উৎসব তাদের আরও একটি অনুষ্ঠান ।তারা বাংলা নববর্ষের দ্বিতীয় দিন ‘সাগ্রেইন’ উৎসব পালন করেন।

৫. বাংলাদেশের খাসি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালী বর্ণনা দিন।

খাসি:
মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত খাসি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়। আদি বাসভূমি তিব্বত থেকে তারা আসাম ও সন্নিহিত অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছেন। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর ,তাহিরপুর এবং অঞ্চলে খাসি জনগোষ্ঠী বাস করে।১৯৯১ সালের গণনা অনুযায়ী প্রায় ১২,৩০০ খাসি বাংলাদেশে বাস করে।


১) সমাজ ব্যবস্থা: খাসি সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। স্ত্রী গৃহে স্বামী বসবাস করার রীতি থাকলেও ২-৩ টি সন্তান হওয়ার পর স্বামী স্ত্রীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। খাসিয়া পরিবারে মেয়েদের কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা অনেক বেশি। খাসিদের নিজেদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ।
২) জীবিকা: খাসি সাধারণত কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে একটি জনগোষ্ঠীর ‘নার’ বা ‘প্রার’  যাদের লোকসংখ্যার বেশিরভাগই পান চাষ করে। মৌমাছি চাষ ও তাদের জীবিকার অংশ।
৩) বাসস্থান: তারা বাঁশ বা কাঠের মাচার উপর বাড়ি তৈরি করে ।সামনে কিছুটা জায়গা খোলা রাখে, যা বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় প্রতিটি বাড়ি সংলগ্ন শূকরের খোয়ার দেখা যায় ।খাসি গ্রাম ‘পুঞ্জি’ বলা হয়। বাড়ির আঙিনায় ফুল ফলের গাছ থাকে। তারা প্রায় ই এক পুঞ্জী থেকে অন্য অঞ্চলে গিয়ে নতুন পুঞ্জী গড়ে তোলে । পুঞ্জি প্রধান কে ‘সিয়েম’ (মন্ত্রী )বলা হয়। তারা নিজস্ব সংস্কৃতিতে জড়িত।
৪) ধর্ম: খাসি ধর্ম অনেক পুরাতন। এটি দীর্ঘ সময় ধরে বিকশিত হয়েছে। প্রত্যেক পুঞ্জির ই নিজস্ব গির্জা রয়েছে। একেশ্বরবাদী হলেও ঈশ্বরের রূপ হিসেবে বিভিন্ন জড়বস্তুকে পূজা করেন। খাসিদের প্রধান দেবতার নাম ‘উব্লাই নাংযউ’। তাকে তারা পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা মনে করেন ।তারা পিতাকে দেবতা মনে করে পূজা করেন ।এরা ইদানিং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করছে। এদের কোন ধর্ম গ্রন্থ নেই। এরা প্রথা ও ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন করেন।
৫) ভাষা: খাসিদের কোন বর্ণমালা নেই। এর দ্বিভাষী। তারা খাসিয়া এবং বাংলা উভয় ভাষায় ব্যবহার করেন। খাসিয়া ভাষায় বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে তারা আধুনিক বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করছে।
৬) উৎসব: খাসিদের সমাজে নাচ গান খুবই প্রিয়। সকল ধরনের অনুষ্ঠান যেমন -পূজা-পার্বণ, বিয়ে, খরা , অতিবৃষ্টি, ফসলহানি ,মৃতের সৎকারে তারা নাচ ও গান উৎসবের আয়োজন করে।
৭) বিবাহ: খাসিদের সমাজে নারী- পুরুষের বিবাহ বাধ্যতামূলক। ছেলে মেয়েরা বড় হলে পিতা-মাতা বিয়ের ব্যবস্থা করেন ।এতে বিয়ের উৎসব ও সম্মিলিতভাবে গান গাওয়ার সাধারণ রীতি রয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, খাসি জনসমাজে নারী -পুরুষ উভয়েই সমানতালে গৃহস্থালির কাজ করে। নারীরা অধিক পরিশ্রম করে। পরিবারে মায়ের প্রাধান্য থাকায় সন্তান মায়ের পরিবারে বড় হয়। এদের সাংস্কৃতিক জীবন যাপন একটু উন্নত। বর্তমানে এরা লেখাপড়া করে আধুনিক জীবন যাপন করছে।

৬. সাঁওতাল জনগোষ্ঠী হিসেবে সাঁওতালদের জীবন যাপন বর্ণনা করুন।

সাঁওতাল: বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হচ্ছে সাঁওতাল।বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী ,রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া অঞ্চলের সাঁওতালরা বসবাস করেন।১৯৯১ এর আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশ সাঁওতাল জনসংখ্যা দুই লক্ষের অধিক।
১) আকৃতি: সাঁওতালদের গায়ের রং কালো মাঝারি উচ্চতার কোঁকড়ানো কালো চুল ,পুরু ঠোঁট, লম্বা গলা ও নাক প্রশস্ত এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য।
২) ভাষা: সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রিক ভাষা থেকে উদ্ভূত। সাঁওতালদের ভাষা লেখার জন্য কোন বর্ণমালা নেই। বর্তমানে তারা বাংলা ও সাঁওতালি ভাষায় কজথা বলে। সাঁওতালদের কোন লিখিত সাহিত্য নেই। তবে তারা ঐতিহ্য প্রবণ।
৩) সমাজ ব্যবস্থা: সাঁওতাল জাতিসত্তা ১২ টি গোত্রে বিভক্ত। একই গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ।সাঁওতাল সমাজ যদিও পুরুষশাসিত, তবুও নারীদের ভূমিকা কম নয়। সাঁওতাল মেয়েরা খামারে কাজ করে থাকে। এদের ঘরগুলো ছোট হলেও এদের আঙিনা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
৪) বাসস্থান:সাঁওতালদের ঘরগুলো খুব ছোট হলেও এদের আঙিনা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখা যায়। ঘরের মাটির দেয়ালে চিত্রকর্ম সাঁওতাল মেয়েদের শিল্পী মনের পরিচয় বহন করে। এদের বাড়িঘর সাধারণত ছন ও খড়ের তৈরি। ঘরে কোনো জানালা থাকে না। বাঁশের চাটাই, খাটিয়া ও কাঁসার বাসন প্রধান আসবাব হিসেবে ব্যবহার করেন।
৫) পোশাক: সাঁওতালদের পোশাক-আশাক খুবই সাধারণ। সাঁওতালরা খুবই পরিশ্রমী নারীরা মোটা ধরনের রঙিন শাড়ি খাটো করে পরিধান করে ,চুলের খোপায় ফুল গুজতে পছন্দ করে ।পুরুষদের সাধারণ পোশাক ধুতি ও গামছা। সাঁওতাল পুরুষ ও নারীর প্রথাগতভাবে শরীরে উল্কি আঁকেন।
৬) খাদ্যাভ্যাস: ভাত, মাছ ,মাংস, সবজি সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য। এছাড়া কাঁকড়া, মুরগি, গরু ও কাঠবিড়ালের মাংস এদের অতি প্রিয়। পাট পাতা, হাঁস মুরগির ডিম, বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং কাছিম তাদের খাদ্যতালিকায় বিশেষ গুরুত্ব পায়।
৭) উৎসব: সাঁওতালরা উৎসবপ্রিয় জনগোষ্ঠী। বাঙালি হিন্দুদের মত এদেরও বারো মাসে তেরো পার্বণ। এদের বছর শুরু হয় ফাগুন মাস থেকে জাঁকজমকপূর্ণ নাচ , গান ও বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে। প্রতি মাসেই এদের বিভিন্ন রকম উৎসব পালিত হয় ।”শিয়ালসেই “ফাল্গুন মাসের শুরুতে নববর্ষ হিসেবে এবং “সহরাই” উৎসব পৌষের শেষে উদযাপিত হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা সাঁওতাল। কৃষিকাজ এদের প্রধান পেশা।বর্তমানে এরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উন্নত জীবনযাপন করছে। এরা খুবই সাধারণ এবং মিশুক প্রকৃতির। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা  এদের প্রধান পেশা।

এমসিকিউ :

১.গারোদের সমাজ ব্যবস্থা কি?
ক) মাতৃতান্ত্রিক
খ) পিতৃতান্ত্রিক
গ) জাতি তান্ত্রিক
ঘ) ভ্রাতৃতান্ত্রিক
উত্তর:ক) মাতৃতান্ত্রিক
২.গারোরা কোন ধর্মের অনুসারী?
ক) ওয়াংগালা
খ) সাংসারেক
গ) খ্রিষ্টান
ঘ) বৌদ্ধ
উত্তর:খ) সাংসারেক
৩. বাংলাদেশে কতটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করে?
ক)২০টি
খ)৩০টি
গ)৪০টি
ঘ)৪৫টি
উত্তর:ঘ)৪৫টি
৪. চাকমারা কোন ভাষায় কথা বলে?
ক) তিব্বতি -বর্মী
খ) ইন্দো-ইউরোপীয়
গ) বাংলা ভাষা
ঘ) হিন্দি ভাষা
উত্তর:ক) তিব্বতি -বর্মী
৫. জুম চাষ কোন নৃ-গোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস?
ক) মারমা
খ) চাকমা
গ) ম্রো
ঘ) মনিপুরী
উত্তর:খ) চাকমা
৬. বাংলাদেশ মণিপুরীদের সংখ্যা কত?
ক)২৩,০০০
খ)২৪,০০০
গ)২৫,০০০
ঘ)৩০,০০০
উত্তর:গ)২৫,০০০
৭. মনিপুরিরা কোন ধর্মে বিশ্বাসী?
ক) বৈষ্ণব
খ) হিন্দু
গ) বৌদ্ধ
ঘ) খ্রিষ্টান
উত্তর:ক) বৈষ্ণব
৮. মারমারা বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ উপলক্ষে কি উৎসব উদযাপন করেন?
ক) সাংগ্রাই
খ) পানি খোলা
গ) জল উৎসব
ঘ) দুর্গাপূজা
উত্তর:ক) সাংগ্রাই
৯. বাংলাদেশ ক্ষুদ্র  নৃ-গোষ্ঠী গুলোর মধ্যে বৃহত্তম অংশ হচ্ছে-
ক) গারো
খ) চাকমা
গ) মনিপুরী
ঘ) খাসি জনগোষ্ঠী
উত্তর:খ)চাকমা
১০. ত্রিপুরা কোন ধর্মের অনুসারী?
ক) খ্রিষ্টান
খ) বৌদ্ধ
গ) সনাতন
ঘ) বৈষ্ণব
উওর:গ) সনাতন
১১. বাংলাদেশের লোকসংগীত কোনটি?
ক) রবীন্দ্র সংগীত
খ) নজরুল সংগীত
গ) লালনগীতি
ঘ) বাউল সংগীত
উত্তর:ঘ) বাউল সংগীত
১২. মনিপুরী পুরুষরা পরিধান করে-
ক)দামি
খ)পাহাতি
গ)লাফিং
ঘ) লুঙ্গি
উত্তর:খ)পাহাতি
১৩. স্থানীয়ভাবে গারোদের ভাষাকে বলা হয়?
ক) মান্দি
খ) আচিক
গ)বৌদ্ধিক
ঘ) তান্ত্রিক
উত্তর:ক) মান্দি
১৪. সাঁওতাল নৃগোষ্ঠী বিভক্ত-
ক)১০
খ)১১
গ)১২
ঘ)১৩ টি গোত্রে
উত্তর:গ)১২
১৫. ‘পুঞ্জি ‘যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সমাজ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত তা হল-
ক) মারমা
খ) খাসি
গ) মনিপুরী
ঘ) সাঁওতাল
উত্তর:খ) খাসি

8Oct2020

অধ্যায়-১১: বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য

১. বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরানাে-এই উক্তির আলােকে বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ধারণা দিন ।

বাংলা ভাষা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা। এ ভাষার সাধু ও চলিত দুটি রুপ রয়েছে। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র বাংলাদেশের ভাষা সাহিত্যের বিকাশ সাধিত হয়েছে। দশম থেকে দ্বাদশ শতকে লিখিত ‘চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরাতন সাহিত্য নিদর্শন। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ এ ভাষায় গীতিপদাবলি রচনা করেছিলেন। চর্যাপদের গীতিপদাবলি বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে খুবই মূল্যবান। এ পদাবলির মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রাচীন বাংলার ভাষা ও তার ঠিক পূর্বের ভাষার নমুনা পাওয়া যায় তেমনই জানা যায় প্রাচীন বাংলার মানুষের সমাজ, সভ্যতা ও জীবন চিত্র। প্রাচীনকাল হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম সংযােজিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং বৈষ্ণব সাহিত্য মধ্যযুগীয় সাহিত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন, পনেরাে শতকের শেষ দিকে মঙ্গলকাব্য বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদান রেখেছে। পাশাপাশি মধ্যযুগে লােক সাহিত্যের প্রসার ঘটে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় হতে আধুনিক বাংলা সাহিত্য প্রসার লাভ করে। আধুনিক সাহিত্যে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরােধা রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, লালন গীতি, পল্লি গীতি, বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে। এছাড়াও বাংলার বাউল গান, জারিগান, সারিগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, গম্ভীরা, কবিগান, পালাগান, কীর্তন গান – সবকিছুই বাংলা সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর পাশাপাশি ক্ষুত্র নূ-গােষ্ঠীর সংস্কৃতির মধ্যে উল্লেখযােগ্য চাকমা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন। রাধামন ধনুপদি পালা, ‘চাদিগাংছারা পালা ও লক্ষ্মীপালা মধ্যযুগে ‘সাদেংগিরির উপাখ্যান, ‘গােবােন লামা ও ‘বারমাসি উল্লেখযােগ্য। বাংলা সাহিত্যের পাশাপশি বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠীর সাহিত্যচর্চা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। রামাধন ধনুপদি পালা মধ্যযুগে সাদেংগিরির উপাখ্যান উল্লেখযােগ্য। আধুনিক যুগের ক্ষেত্রে সুগত চাকমা রাঙামাত্যা, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমার পাদারঙ কোচপানা ও সুহ্রদ চাকমার বাগী অন্যতম।

২. বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের বর্ণনা দিন।

বাংলাদেশ বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর আবাসস্থল। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠীর বসবাস এ দেশে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে করেছে সমৃদ্ধ। সে জন্য এ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি (ভান সেন্দেল, ১৯৯৮) বলা হয় । হিন্দু, মুসলিম, বৈষ্ণব, বাউল, আশরাফ, আতরাফ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠী—সবই বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ এ সমস্ত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরাতন।

বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ মুসলিম হলেও এখানে অন্যান্য ধর্মীয় গােষ্ঠী যেমন- হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসে জনগােষ্ঠী বসবাস করে। যে কারণে সমাজজীবনের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ’ মূল্যবােধ গড়ে উঠেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব হলো ঈদ-উল-ফিতর ও ‘ঈদ-উল-আজহা। হিন্দু সম্প্রদায় দুর্গাপূজা’ প্রধান উৎসব হিসেবে পালন করে। বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় যথাক্রমে বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং ‘বড়দিন’ প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করে। এসব উৎসবে একে অপরের উপস্থিতি এ দেশের সংস্কৃতি বিকাশে সহায়তা করেছে।  এছাড়া সামাজিক উৎসব হিসেবে বাঙালি জনগােষ্ঠী বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে। বাংলা সনের প্রথম তারিখে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়। এটি বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। পুরাতনকে বিদায় করে নতুনকে নানা উৎসবের মাধ্যমে বরণ করে নেয়া হয়। নতুন বছরের উৎসবে গ্রামীণ জনগােষ্ঠীর নিবিড় যােগাযােগ। রাজধানী ঢাকাতে “ছায়ানট এর উদ্যোগে নতুন বছরকে আহ্বান করা হয়। বর্ষবরণে বৈশাখী মেলা, বিভিন্ন পিঠা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া ও গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযােগিতা যেমন- নৌকা বাইচ, লাঠি খেলার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া নবান্ন উৎসব, পৌষ-পার্বণ ইত্যাদি লােকজ উৎসবের প্রচলন রয়েছে। প্রার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব হলাে ‘বিজু-সংগ্রাহ-বৈসুক। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যারা বর্ষ বিদায় ও নববর্ষ আগমন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী এই উৎসব পালন করে থাকে।

৩। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্থাপত্য এবং চিত্রকলার বর্ণনা দিন। অথবা, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য এবং চিত্রকলা ব্যাখ্যা করুন।

বাংলাদেশ বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর আবাসস্থল। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠীর বসবাস এদেশে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে করেছে সমৃদ্ধ। হিন্দু, মুসলিম, বৈষ্ণব, বাউল, আশরাফ, আতরাফ, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠী সবই বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। এ সমস্ত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরাতন। নিচে বাংলাদেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের বর্ণনা দেওয়া হলাে :

বাংলাদেশের স্থাপত্য এবং চিত্রকলা : বাংলাদেশে হাজার বছর ধরে স্থাপত্য, চারুকলা ও কারুশিল্পের বিকাশ সাধিত হয়েছে। স্থাপত্য শিল্পের প্রাচীনতম নিদর্শন হলাে এদেশের আপামর জনগােষ্ঠীর বসবাসের জন্য ‘কুঁড়েঘর’ বা খড়ের ঘর। অনেক অঞ্চলে অতি বৃষ্টির কারণে মাটির পরিবর্তে বাশ ও খড় দিয়ে ঘর তৈরি করতে দেখা যায়। আধুনিকতার ছোঁয়ার কারণে বর্তমানে ঘরের ছাদ হিসেবে টিনের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তবে প্রাচীনকালে যে সমস্ত নগরীর বিকাশ হয়েছিল তা ছিল বড় বড় প্রাচীর ও পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। এ সমস্ত নগরীতে বিশাল বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়েছিল। বিভিন্ন পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ যেমন-পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার, সোনারগাঁও প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

মধ্যযুগের স্থাপত্যশিল্প বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ সময় বিভিন্ন মসজিদ, মাজার ও খানকাহ গড়ে ওঠে। এর ফলে কারু চারুকলার বিকাশ ঘটে। এ সমস্ত মুসলিম স্থাপত্যে ছােট-বড় বিভিন্ন মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদের গায়ে কুলুঙ্গি ও পোড়া  মাটির অলঙ্কারের ব্যবহার করা হতাে। মসজিদের পাশাপাশি এ সময়ে মন্দির ও নির্মাণ করা হয়েছিল। মন্দিরগুলো নির্মাণের সময় বাংলা ঘরের অনুকরণ করা হয়েছিল । নুয়ে পড়া চালা বা বাঁকানাে কার্নিশ মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। মােঘল আমলে ঢাকায় বিভিন্ন স্থাপত্য শিল্পের প্রসার লাভ করে। এগুলোর মধ্যে হােসনি দালান, আহসান মঞ্জিল ইত্যাদি অন্যতম।

কার্জন হল, নর্থব্রুক হল, কোর্ট কাচারী, দপ্তর ও জেলখানা ইত্যাদি মােঘল ও ইউরােপীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণের নির্মিত। প্রাচীন  বাংলার প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রে চারুকলা ও কারুকলার ব্যবহার লক্ষণীয়। বিভিন্ন আসবাবপত্র, মাটির বাসন-কোসন ছাড়াও ব্রোঞ্জের তৈরি গয়না, বাতি, পােড়ামাটির তৈরি নকশা ও মূর্তি, রুপার মুদ্রা ও অলংকার এবং রত্নালঙ্কার এদেশের সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ইটের তৈরি প্রাচীর পােড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা ও নানারকমের মূর্তির খােদাই বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম বাহন। এ সমস্ত ফলকে বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা লিপিবদ্ধ হয়েছে। চিত্রকলা বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। চিত্রশিল্পী যামিনী রায়, জয়নুল আবেদিন, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের মতাে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর জন্ম এদেশে হয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ চিত্রকর্মটি পৃথিবীজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছিল। চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের চিত্রকলায় এদেশের সাঁওতালদের লোকশিল্প, ধর্মীয় কাহিনি ও প্রাত্যহিক জীবন স্থান পেয়েছে। কামরুল হাসানের চিত্রকলায় বাংলার লােকজ ঐতিহ্য ফুটে উঠেছে।মাটির তৈরি হস্তশিল্প বাংলাদেশের সংস্কৃতির ও ঐতিহ্যের অন্যতম উপাদান। হস্তশিল্পের পাশাপাশি ঘটচিত্র, সরার চিত্র, শখের হাড়ি,পুতুল ইত্যাদি তৈরির শিল্প এখানে বিদ্যমান। নকশী কাথা’ এদেশের আবহমান সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪.  বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে মহাস্থানগড়, উয়ারি বটেশ্বর, পাহাড়পুর এবং ময়নামতি এর বর্ণনা দিন।

ঐতিহাসিক স্থান :

আমাদের দেশে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান এখনও বহু কিংবদন্তি হয়ে আছে, যাদের সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন উপাখ্যান। ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি একদিকে যেমন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতির চেয়ে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে ছিল তেমনি কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতেও এ অঞ্চল অন্যান্য জাতিগােষ্ঠীকে আকৃষ্ট করেছিল। নিচে এদেশের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থানের বর্ণনা দেয়া হলাে :

মহাস্থানগড় :

মহাস্থানগড় বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার করতােয়া নদীর তীরে অবস্থিত। বগুড়া শহর হতে প্রায় ১০ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত মহাস্থানগড় একসময় বাংলার রাজধানী ছিল। পূর্বে মহাস্থানগড়ের নাম ‘পুন্ড্রবর্ধন’ বা ‘পুন্ড্রনগর’ ছিল। এটি বাংলাদেশের অন্যতম পুরাকীর্তি। ঐতিহাসিকদের মতে, মহাস্থানগড় কমপক্ষে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। ভাসু বিহার, ভীমের জাঙ্গাল, বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, কালিদহ সাগর, জিয়ত কুণ্ড, গোকুল মেধ বা কিংবদন্তির বেহুলা-লক্ষীন্দরের বাসরঘর, খোদাই পাথর ভিটা, মালখালীর কুণ্ড, বন্দুকধারা, কান্তজির মন্দির, হাতিবান্ধা, ধােপার পুকুর, হাতি ডােবা পুকুর, শিলাদেবীর ঘাট, মথুরা চিঙ্গাসপুর, কাঞ্জির ঘাট, ছেলীরধাপ, গােদারকাপ, ধােলাইধাপ প্রভৃতি কালের সাক্ষী হয়ে আছে। মহাস্থানগড় প্রাচীন ও পরিখাবেষ্টিত একটি দুর্গ নগরী ছিল। মহাস্থানগড় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থান হিসেবে সর্বজনবিদিত।

উয়ারী-বটেশ্বর :

নরসিংদী জেলার বেলাব থানা সদর হতে ৫ কিলোমিটার অদূরে উয়ারী-বটেশ্বর হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের দুটি প্রাচীন গ্রাম। লালমাটি দ্বারা গঠিত উঁচু গ্রাম দুটো টিলার মতাে। তবে স্থানীয় জনগােষ্ঠীর নিকট পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। প্রাচীনকালে ব্রহ্মপুত্র নদ গ্রাম দুটোর পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল। উয়ারী-বটেশ্বরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দুদিকে দুটি মাটির প্রাচীর। প্রাচীর দুটি লাল মাটি দ্বারা গঠিত এবং এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৫ কিলােমিটার। প্রাচীরের বাইরে পরিখা আছে। গ্রাম দুটি আয়তনে অনেক বড় এবং ছােট-বড় অনেক ঢিবির সমন্বয়ে গঠিত, দুর্গভূমিতে অজস্র প্রাচীন মৃৎভগ্নাংশ দেখা যায়।

এই স্থানে বহু প্রাচীন ও অতি মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ব যেমন, ছাপযুক্ত মুদ্রা, অসংখ্য মূল্যবান পাথরের গুটিকা, লােহার তৈরি হাত কুড়াল পাওয়া গেছে।

পাহাড়পুর :

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারটি সােমপুর বিহার বা মহাবিহার নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ও প্রাচীন প্রত্নতত্ত্বের অন্যতম নিদর্শন। রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলায় এটি অবস্থিত। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষ দিকে বা নবম শতকের প্রথম ভাগে এই বৌদ্ধবিহারটি নির্মাণ করেন। পুন্ড্রনগর ও কোটিবর্ষের মাঝামাঝি ১০ হেক্টর অঞ্চল জুড়ে এই পুরাকীর্তিটি অবস্থিত। এটির ভূমি পরিকল্পনা চতুর্ভুজ আকৃতির। লৌহজাত পদার্থের উপস্থিতির কারণে এর মাটি লালচে। ভূমি হতে ৩০.৩০ মিটার উঁচুতে পাহাড় সদৃশ স্থাপনা হিসেবে এটি টিকে আছে। ১৯৮৫ সালে পাহাড়পুরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম স্থাপত্য  নিদর্শন হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। স্থাবর স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে বিহার কেন্দ্রীয় মন্দির, উন্মুক্ত অঙ্গন, স্নানাগার ও শৌচাগার। এবংঅস্থাবর স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে পােড়ামাটির ফলক, প্রস্তর ভাস্কর্য, চুনবালি সমন্বয়ে গঠিত মাথা, ধাতব মূর্তি, তাম্রশাসন ও শিলালিপ মুদ্রা, মৃন্ময় পাত্র ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।

 ময়নামতি :

ময়নামতি বাংলাদেশের কুমিল্লা শহর হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান এবং একটি প্রাচীন বাংলার নিদর্শনের অন্যতম উৎসস্থল। এটি ময়নামতি লালমাই অঞ্চলের প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শনের অন্যতম। মেঘনা বেসিনের ভাটিতে গোমতী নদীর তীরস্থ ময়নামতি গ্রাম থেকে লালমাই রেলস্টেশনের নিকটে চান্দিমুরা পর্যন্ত এটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৭ কিলােমিটার বিস্তৃত। এর প্রশস্ততম অংশটি ৪.৫ কিলোমিটার চওড়া এবং সর্বোচ্চ চূড়াটি ৪৫ মিটার উঁচু। ময়নামতি প্রাচীন বঙ্গ সমতটের (দক্ষিণপূর্ব বাংলা) স্মৃতিস্তম্ভ, খননকৃত ধ্বংসাবশেষ সম্বলিত। এটি প্রাচীন বাংলার অতীত গৌরবের নিদর্শন। ময়নাতির প্রত্নস্থলের মধ্যে কোটিলা মুড়া, রূপবান মুড়া, চারপত্র মুড়া ও শালবন বিহার অন্যতম।

৫. বাংলাদেশের পুরাকীর্তি হিসেবে শালবন বিহার, সোনারগাঁও, যাটগম্বুজ মসজিদ এবং লালবাগের কেল্লার বর্ণনা দিন।

অথবা, এদেশের পুরনাে স্থাপত্যকীর্তি হিসেবে শালবন বিহার ও সােনারগাঁও এর বর্ণনা দিন।

ঐতিহাসিকভাবে বাঙালিরা একদিকে যেমন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতির তুলনায় এগিয়ে ছিল তেমনি কৃষ্টি ও সভ্যতার বিকাশের ফলে এই অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগােষ্ঠীকেও দ্রুত আকৃষ্ট করেছিল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী বঙ্গদেশে অবস্থানের ফলে বিভিন্ন নিদর্শনের সাক্ষ্য রেখেছে। নিম্নে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে শালবন বিহার, সােনারগাঁও, ষাটগম্বুজ  মসজিদ ও লালবাগ কেল্লার বর্ণনা দেওয়া হলাে । শালবন বিহার : ময়নামতির খননকৃত প্রত্নস্থানসমূহের মধ্যে শালবন বিহার গুরুত্বপূর্ণ। শৈলরাজির প্রায় কেন্দ্রে বর্তমানে কোর্ট বাড়িতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির নিকটস্থ লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝিতে এই বিহারটি অবস্থিত। এটি একটি বৌদ্ধ বিহার বিহারটি শাল-গজারির বন দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় এই বিহারটির নামকরণ করা হয়েছিল শালবন বিহার। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীবভদেব এই বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন। শালবন  বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬.৭ মিটার দীর্ঘ এবং বিহারের চারদিকে দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলাে বিহারের চারদিকে বেষ্টনি দেয়াল পিট করে নির্মিত। বিহারের প্রবেশ বা বাহির হওয়ার জন্য একটি মাত্র পথ রয়েছে। বিহার প্রাঙ্গনের মাঝখানে কেন্দ্রীয় মন্দির। শালবন বিহারে সর্বমােট ১৫৫ টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে তিনটি কুলুঙ্গি রয়েছে। এই কক্ষগুলােতে বৌদ্ধ ভিক্ষুকগণ থাকতেন এবং এখানে বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চা করা হতাে।

সােনারগাঁও :

সােনারগাঁও নগরী ‘সুবর্ণগ্রাম বা ‘সােনার গ্রাম’ নামেও পরিচিত। ঢাকা থেকে ২৭ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। প্রাচীনকালে হিন্দু-বৌদ্ধযুগে এই নগরী গড়ে উঠলেও এটি বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সোনারগাঁও পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা পরিবেষ্টিত। বার ভুইয়াদের অন্যতম ঈসা খা দীর্ঘদিন যাবৎ সােনারগাঁও শাসন করেছেন। বিডিন্ন নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ার কারণে শত্রুপক্ষ সহজেই আক্রমণ করতে পারত না। বর্তমানে সােনারগাঁও বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম। এখানে লােক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের যাদুঘর, কারুপল্লী, ঐতিহাসিক পানাম নগর, সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহেব মাজার, পাঁচ পীরের মাজার, গোয়ালদি মসজিদ প্রভৃতি নির্শনীয় স্থান বাংলার ঐতিহ্য ও সভ্যতার স্মারক হিসেবে দাড়িয়ে রয়েছে।

ষাটগম্বুজ মসজিদ :

ষাট গম্বুজ মসজিদ সুলতানী আমলের সর্ববৃহৎ মসজিদ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্য। এটি বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। অনুমান করা হয় ১৫ শতাব্দীতে খান-ই-জাহান এটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণের বাইরের অংশ প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের অংশ প্রায় ১০৪ ফুট এবং ভিতরের অংশ প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলাে প্রায় ৮.৫ মিটার পুরু। সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ-এর আমলে (১৪৩৫-৫৯) খান আল-আমজ উল্লুগ খানজাহান বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে শাসনের ক্ষমতা অর্জন করেন এবং সুলতানের সম্মানে তিনি এই এলাকার নাম খলিফাবাদ রাখেন। তিনি বৈঠক করার জন্য একটি দরবার গড়ে তােলেন যা পরবর্তীতে ষাট গম্বুজ মসজিদে রূপান্তরিত হয়। মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১ টি বিরাট খিলানযুক্ত দরজা ও উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে ৭টি দরজা রয়েছে। মসজিদের ৪টি কোণ মিনার ও ভিতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরভাগের পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মিহরাজ রয়েছে। এর মাঝখানের মিহরাজটি আকারে বড় ও কারুকার্য খচিত। বিভিন্ন সময় অবহেলায় ঐতিহাসিক এ মসজিদটির অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। তবে ব্রিটিশ সরকার থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের নানারকম সংস্কারমূলক কার্যক্রমের ফলে এটি বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থানে পরিণত হয়। ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে বাগেরহাট শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়।

লালবাগ কেল্লা :

লালবাগ কেল্লা ঢাকাতে অবস্থিত। এর আদি ও পােশাকী নাম ‘আওরঙ্গবাদ। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ শাহজাদা আযম এই প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তবে মারাঠাদের সাথে যুদ্ধে তিনি অংশ নেয়ায় দুর্গ নির্মাণের দায়িত্ব পড়ে পরবর্তী সুবেদার নওয়াব শায়েস্তা খানের ওপর। শায়েস্তা খানের শাসনামলে ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রেখে দিলে দুর্গটি পরিত্যক্ত হয়। সে সময় নতুনভাবে এর নামকরণ করা হয় ‘লালবাগ কেল্লা’। এটি সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। এতে প্রধান ফটকসহ মােট তিনটি ফটক রয়েছে। দুর্গের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপত্য নিদর্শন হলাে এর দক্ষিণ তােরণ। এই তােরণের সম্মুখভাগের দুই দিক দুটি সুউচ্চ সরু পিলার দ্বারা সুশােভিত। দক্ষিণ ও উত্তর দেয়ালের মাঝামাঝি পূর্বকোণ ঘেঁষে একটি পুকুর রয়েছে। কেল্লার মধ্যে দরবার গৃহ ও হাম্মামখানা রয়েছে। দরবারগৃহের পশ্চিমে শায়েস্তা খানের কন্যা পরীবিবির সমাধি সৌধ রয়েছে যা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পুরাকীর্তি। এই মাজার মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রকমের ফুল, পাতা শােভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছে। এ ছাড়াও তিন গম্বুজ বিশিষ্ট লালবাগ কেল্লা মসজিদ রয়েছে। এ ছাড়া শায়েস্তাখানের বাসভবনের পাশে একটি কামান রয়েছে, যা ঐ সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহার করা হতাে।

৬. আবহমানকাল ধরে এদেশের স্থাপত্য চারু ও কারুকলা এদেশের সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ উক্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করুন।

বাংলাদেশের হাজার বছর ধরে স্থাপত্য, চারুকলা ও কারুশিল্পের বিকাশ সাধিত হয়েছে। প্রাচীনকালে স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শনের মধ্যে আপামর জনগােষ্ঠীর বসবাসের জন্য ‘কুড়েঘর বা খড়ের ঘর’ ছিল বর্তমানে সেখানে টিনের চালা কিংবা দালান ঘর দেখা যায়। তবে প্রাচীনকালে যে সমস্ত নগরী ছিল তা ছিল বড় বড় প্রাচীর ও পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। বিভিন্ন পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ যেমন : মহাস্থানগড়, ময়নামতির বৌদ্ধ বিহার, সােনারগাঁও প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। মধ্যযুগের স্থাপত্যশিল্প বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ সময় বিভিন্ন মসজিদ, মাজার, খানকাহ গড়ে ওঠার ফলে কারু ও চারুকলার বিকাশ ঘটে।

এ সমস্ত মুসলিম স্থাপত্যে ছােট-বড় বিভিন্ন মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। বেশ কিছু মন্দিরও এ সময় নির্মাণ করা হয়। ইংরেজ আমলে ইউরােপীয় প্রভাবে ঢাকায় বিভিন্ন স্থাপত্য শিল্প প্রসার লাভ করে। হােসনি দালান, আহসান মঞ্জিল মােঘল স্টাইলে হলেও পরবর্তীতে ইউরােপীয় স্টাইলের সংমিশ্রণে করা হয়। কার্জন হল, নর্থব্রুক হল মােঘল ও ইউরােপীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণ।

প্রাচীন বাংলার ব্যবহার্য বিভিন্ন আসবাবপত্র, মাটির বাসন-কোসন ছাড়াও ব্রোঞ্জের তৈরি গয়না, বাতি, পােড়া মাটির নকশা ও মূর্তি, রূপার মুদ্রা ও অলংকার এবং রত্নালঙ্কার এদেশের সংস্কৃতির অন্যতম বাহন। ইটের তৈরি প্রাচীর পােড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা ও নানা রকমের মূর্তির খােদাইয়ে বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বিধায় এটিও বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম বাহন। চিত্রকলা বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর চিত্রকর্মটি বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছিল। যামিনী রায়ের চিত্রকলায় এদেশের সাঁওতালদের লোকশিল্প, ধর্মীয় কাহিনী ও প্রাত্যাহিক জীবন স্থান পেয়েছে। কামরুল হাসানের চিত্রকলায় বাংলার লােকজ ঐতিহ্য ফুটে উঠেছে। মাটির তৈরি হস্তশিল্প বাংলাদেশের লােকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের অন্যতম উপাদান। এ শিল্পের পাশাপাশি ঘটচিত্র, সরার চিত্র, শখের হাড়ি, পুতুল ইত্যাদি শিল্প এখানে বিদ্যমান। নকশীকাথা এদেশের চিরায়ত সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হিসেবে বিবেচতি হয়।

৭. বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রবাসী সরকার শপথ নিয়েছিল কোথায়? মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের বর্ণনা দিন।

মুজিবনগর মেহেরপুর জেলায় অবস্থিত। আছে এই গ্রামটির নাম বৈদ্যনাথতলা ছিল। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই গ্রামের আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘােষণা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার অন্য মন্ত্রীর এখানে শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে এই গ্রামের নাম পরিবর্তন করে মুজিবনগর রাখা হয়। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছরের ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালন করে। ফলে এই দিন বাঙালি জাতির জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। বৈদ্যনাথতলার যে জায়গায় মঞ্চ তৈরি করে অস্থায়ী প্রবাসী সরকার শপথ নিয়েছিল সেখানে স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে যা ‘মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ’ নামে পরিচিত।

২৩টি কংক্রিটের ক্রিকোণ দেয়ালের সমন্বয়ে উদীয়মান সূর্যের প্রতিকৃতিকে পটভূমি করে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিসৌধে ছােট থেকে বড় মােট ২৩টি স্তম্ভ আছে, যার অর্থ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছর বাংলাদেশ বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধীনস্থ ছিল। স্মৃতিসৌধে ৯টি সিড়ি আছে, যার অর্থ বােঝায় ২৬ মার্চ থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস যুদ্ধ কালীন সময়। ৩০ লাখ ছােট ছােট পাথর আছে, যার অর্থ বােঝায় ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর ৩ লাখ বড় পাথর আছে যার অর্থ দেশের ৩ লাখ মা-বােনের ইজ্জতের বিনিময়ে এসেছে সেই মহার্ঘ্য স্বাধীনতা।

মুজিবনগরের প্রবেশ পথে বিশাল গেট আছে যা ‘মুজিবগেট’ হিসেবে পরিচিত। মুজিবনগরে ৬ দফার স্মৃতিমূলক ভিত্তিক ৬ প্রজাতির ২২শ গােলাপ গাছের বাগান, ১৩শ বৃক্ষ শােভিত আম বাগান, বঙ্গবন্ধুর তােরণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকেন্দ্র, টেনিস মাঠ, প্রশাসনিক ভবন, পর্যটন মােটেল, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক বাংলাদেশের মানচিত্র, হাসিনা মঞ্চ, শিশুপল্লী ও ডরমিটরি রয়েছে।

6Oct2020

অধ্যায়-১০: বাংলাদেশের জাতীয় বিষয়াবলি

প্রশ্ন।১। সংক্ষিপ্ত পরিচয় সহ বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক, দিবস বিষয়াবলির তালিকা করুন।

পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের আছে বিভিন্ন জাতীয় প্রতীক। এগুলাে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংহতির প্রতীক । ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে আমরা এসব অর্জন করেছি।  জাতীয় প্রতীকগুলাে একদিকে বিশ্ব দরবারে নিজের দেশের  স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রকাশ করে ও দেশকে মর্যাদার সাথে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে।
নিচে সংক্ষিপ্ত পরিচয় সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় প্রতীক, দিবস ও বিষয়ের তালিকা প্রদান করা হলাে:

১ সংবিধান : এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি।

২, জাতীয় মনোগ্রাম :লাল রংয়ের বৃত্তের মাঝে হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র। বৃত্তের উপরে লেখা ‘গনপ্রজাতণ্রী বাংলাদেশ এবং নিচে লেখা ‘সরকার। বৃত্তের দুই পাশে দুটি করে মােট চারটি তারকা আছে।

৩, রাষ্ট্রীয় প্রতীক :পানিতে ভাসমান শাপলার দু ‘পাশে দুটি ধানের শিষ। শাপলার উপরে তিনটি সংযুক্ত পাট পাতা  আছে। পাতাগুলোর দু পাশে দুটি করে মােট চারটি তারকা আছে। জাতীয়

৪. জাতীয় পতাকা:পতাকার রং সবুজ। মাঝে গাঢ় লাল বৃত্ত। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ১০ ৬.

৫. জাতীয় সংগীত:বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমার সোনার বাংলা কবিতার প্রথম ১০ লাইন।

৬. জাতীয় পাখি:দোয়েল বাংলাদেশের জাতীয় পাখি।

৭. জাতীয় ফল: কাঁঠাল দেশের জাতীয় ফল।

৮.জাতীয় ফুল: জাতীয় ফুল শাপলা

৯.জাতীয় বৃক্ষ:বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ আম গাছ। 

১০. জাতীয় কবি: কাজী নজরুল ইসলাম 

১১. জাতীয় মাছ :ইলিশ

১২. জাতীয় পশু:রয়েল বেঙ্গল টাইগার। 

১৩. জাতীয় খেলা :হা-ডু-ডু

১৪. জাতীয় মসজিদ:বায়তুল মােকাররম।

১৫. জাতীয় স্মৃতিসৌধ:এটি ঢাকার নবীনগরে অবস্থিত। এর নাম ‘সম্মিলিত প্রয়াস’।

১৬. জাতীয় উদ্যান:সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

১৭. স্বাধীনতা দিবস:২৬ মার্চ।

১৮. বিজয় দিবস:১৬ ডিসেম্বর।

১৯. শােক দিবস:১৫ আগস্ট।

২০, শহিদ দিবস:২১ ফেব্রুয়ারি।

২১, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস:১৪ ডিসেম্বর।

প্রশ্ন । ২। বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, পত, গাছ এবং খেলার বর্ণনা দিন।অথবা , আমাদের জাতীয় মাছ, পশু,  জাতীয় মসজিদ এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধের বর্ণনা দিন।

পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশের মতাে বাংলাদেশেরও আছে বিভিন্ন জাতীয় প্রতীক। এগুলাে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে আমরা এগুলাে অর্জন করেছি। জাতীয় প্রতীকগুলাে এক দিকে বিশ্ব দরবারে নিজ দেশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব প্রকাশ করে ও দেশকে মর্যাদার সাথে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে নাগরিকদের দেশপ্রেম, জাতীয় আদর্শ ও সংহতিতে উদ্বুদ্ধ করে। নিম্নে জাতীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা হলো :জাতীয় মাছ : জাতীয় মাছ ইলিশ। সমুদ্রে বাস হলেও পূর্ণবয়স্ক ইলিশ ডিম পাড়ার মৌসুমে ঝাঁক বেধে মোহনা অতিক্রম করে নদীর উজানে এসে ডিম পাড়ে। মিষ্টি পানিতে জন্ম নেওয়া পোনা ইলিশকে বলা হয় জাটকা। এরা আবার নদীর ভাটি পথ ধরে সমুদ্রে পৌঁছে যায়। ইলিশ  বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মৎস্যজাত প্রােটিনের উৎস। এর অর্থনৈতিক মূল্য তাই বিশাল। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ও ইলিশ খুবই উল্লেখযোগ্য একটি মাছ। বর্ষাকালে এ মাছ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় ।জাতীয় পশু: রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের জাতীয় পশু। বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত সুন্দরবন এর আবাসস্থল। হলুদের মাঝে কালাে ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আকারে অনেক  বড় ও হিংস্র। সুন্দরবন পরিবেশগত হুমকির মুখে পড়ার কারণে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। সুন্দরবনের বাঘের রাজকীয় ভাবভঙ্গি ও জৌলুস দেখে মানুষ স্তম্বিত হয়ে যায়। জাতীয় বৃক্ষ: জাতীয় বৃক্ষ আম গাছ। দেশের সব অঞ্চলেই নানা জাতের আম গাছ জন্মে। তবে সবচেয়ে ভালাে ও উন্নত জাতের গাছ হয় রাজশাহীতে। বাংলাদেশের গ্রামাঞালের প্রায় সব বাড়িতেই আম গাছ আছে। এই অঞ্চল ফলটির আদি জন্মভূমি। আম খেতে খুব সুস্বাদু। জাতীয় খেলা : কাবাড়ি আমাদের জাতীয় খেলা। এর আরেক নাম হা ডু ডু। এটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা। ১০ জনের দুটি দলে এ খেলা হয়। এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। এক সময় গ্রামগঞ্জে এ খেলার বহুল প্রচলন ছিল। বর্তমানে সাফ গেমসেও এ খেলা স্থান পেয়েছে। জাতীয় মসজিদ : ঢাকায় অবস্থিত বায়তুল মোকাররম মসজিদ আমাদের জাতীয় মসজিদ। ১৯৬০ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। সর্বপ্রথম নামাজ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি। মসজিদটি অটিতলা বিশিষ্ট। তবে মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ছয় তলা। জাতীয় স্মৃতিসৌধ : সাভারের নবীনগরে অবস্থিত। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদদের স্মরণে  এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই প্রতিবছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে এখানে ফুল প্রদানের মাধ্যমে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। এর উচ্চতা ১৫০ ফুট। এতে সাতটি ফলন আছে, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি পর্যায়কে নির্দেশ করে। যথা : ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬-এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। বিদেশ থেকে আগত রাষ্ট্রীয় অতিথিবৃন্দ ও এখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা দেখান। 

প্রশ্ন । ৩। রাষ্ট্রীয় প্রতীক, জাতীয় মনােগ্রাম ও জাতীয় পতাকার বর্ণনা দিন।

পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের আছে বিভিন্ন জাতীয় প্রতীক। এগুলাে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংহতির প্রতীক। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে আমরা এসব অর্জন করেছি। জাতীয় প্রতীকগুলাে একদিকে বিশ্ব দরবারে নিজের দেশের স্বতন্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার  মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রকাশ করে ও দেশকে মর্যাদার সাথে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে। নিম্নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়  প্রতীক, জাতীয় মনােগ্রাম ও জাতীয় পতাকার বর্ণনা দাও হলাে।  রাষ্ট্রীয় প্রতীক :পানিতে ভাসমান শাপলার দু ‘পাশে দুটি ধানের শীষ। শাপলার উপরে তিনটি সংযুক্ত পাট পাতা আছে। পাতাগুলাের দু’পাশে দুটি করে মােট চারটি তারকা আছে। চাৱটি তারকা রাষ্ট্রের  চারটি মূলনীতি- জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রকাশ করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি  ও প্রধানমন্ত্রী এটি ব্যবহার করেন। রাষ্ট্রীয়  প্রতীকের রূপকার শিল্পী কামরুল হাসান। জাতীয় মনোগ্রাম: লাল রঙ্গের বৃত্তের মাঝে হলুদ রঙ্গের  বাংলাদেশের মানচিত্র। বৃত্তের উপরে লেখা ‘গণপ্রজাতণ্রী বাংলাদেশ’ এবং নিচে লেখা  “সরকার”। বৃত্তের দুই পাশে দুটি করে মােট চারটি তারকা আছে। চারটি তরকা রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি- জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র , ধর্মনিরপেক্ষতা  প্রকাশ করে। সরকারি কাজকর্মে এই মনোগ্রাম ব্যবহৃত হয়।জাতীয়  পতাকা : বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রং সবুজ। মাঝে গাঢ় লাল বৃত্ত। লাল রঙ্গের বৃত্তটি রক্তক্ষয়ী সংঘামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার নতুন সূর্যের প্রতীক। উজ্জ্বল ঘন সবুজ  অংশটি বিস্তৃত গ্রামবাংলার প্রতীক। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ১০: ৬। বাংলাদেশের যেকোনাে জাতীয় দিবসে এটি উত্তোলন করা হয়। জাতীয় শোক দিবস, রাষ্ট্র  কর্তৃক ঘােষিত কোনাে শােকের দিনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত  রাখা হয় । বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রুপকার শিল্পী কামরুল হাসান।

প্রশ্ন॥ ৪ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত লিখুন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাঁর রচিত‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতা থেকে প্রথম ১০ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে নেওয়া হয়েছে।বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত টি নিম্নরূপ:

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥

প্রশ্ন। ৫। বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে লিখুন।

বিজয় দিবস : ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। তাই প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস পালন করা হয়। 

শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : ১৯৫২ সালের ভাষা শহিদদের স্মরণে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালন করা হয়। এদিন বাঙালি খালি পায়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহিদদের শ্রদ্ধা জানায়। আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদের সুরারােপিত। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গাইতে গাইতে সবাই প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করে ।ভাষা শহিদদের স্মরণে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার নির্মিত হয়। জাতীয় শহীদ মিনারের রূপকার শিল্পী হামিদুর রহমান।ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেজন্য জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘােষণা করেছে। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো যথাযথ  মর্যাদায় এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালন করে।


শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস : ১৪ ডিসেম্বর আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে বাঙালিকে মেধাশূন্য করার জন্য এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর সহায়তায় এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরে এদের অনেকের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় ।

6Oct2020

অধ্যায়-৯: বাংলাদেশের সম্পদ, শিল্প ও বাণিজ্য


১. বাংলাদেশের কৃষিজ সম্পদের বর্ণনা দিন ।

বাংলাদেশের কৃষিজ সম্পদ:

বাংলাদেশের কৃষি প্রধান দেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিজ সম্পদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। দেশের প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি উৎপাদনের জন্য ভূ-প্রকৃতি ,জলবায়ু, মাটি ,পানির সহজলভ্যতা ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উল্লেখিত উপাদানসমূহ অনুকূলে থাকার কারণে বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ১৫ ভাগ ই হল কৃষিজ পণ্য ও কাঁচামাল।

১) খাদ্যশস্য:

বাংলাদেশের আবাদযোগ্য জমির শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয়। খাদ্যশস্যের মধ্যে ধান, গম ,ভুট্টা, জোয়ার ,ডাল তেলবীজ, শাকসবজি, আলু, বিভিন্ন প্রকার মসলা ও ফলমূল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। দেশের মোট আবাদি জমির সিংহভাগ অংশে ধানের চাষ হয়। এদেশের দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব পাহাড়ি ভূমি ব্যতীত প্রায় সব অঞ্চলেই ধানের চাষ করা হয়ে থাকে। দেশীয় ধানের প্রধান তিনটি আউশ, আমন, এবং বোরো ।বাংলাদেশের সব অঞ্চলে ধানের চাষ করা হলেও তুলনামূলকভাবে রংপুর ,দিনাজপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, পটুয়াখালী,ঢাকা, কিশোরগঞ্জ ,খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার অধিক ধান উৎপন্ন হয়। অতীতে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল ।বর্তমানে এদেশে আধুনিক কৃষি কাজ শুরু হওয়ায় কৃষি উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন দাঁতের বীজ উদ্ভাবন করে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ।বর্তমানে বাংলাদেশ আধুনিক ইরি ব্যাপক আবাদ হচ্ছে।২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৮৮.১৪ লক্ষ মেট্রিক টন।

২) অর্থকরী ফসল:

যেসব ফসল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উৎপাদন করা হয় সেই সমস্ত ফসলকে ফসলকে  অর্থকরী  ফসল বলা হয়। বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে পাট, চা ,তামাক, ইক্ষু, তুলা ,রেশম, রাবার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । এসব ফসল বাজারজাত করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। এটি রপ্তানি করে প্রায় ৯.৮% বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাটের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাটকে ‘সোনালী আঁশ’ বলা হয়। বাংলাদেশের জলবায়ু ও উর্বর দো-আঁশ মাটি পাট চাষের জন্য খুব উপযোগী।

এছাড়া সুলভ শ্রমিক, প্রয়োজনীয় মূলধন, সহজ পরিবহন এবং নিশ্চিত বাজার প্রভৃতি অর্থনৈতিক উপাদানের কারণে এদেশে বিপুল পরিমাণ পাট উৎপাদন করা হয় ।বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চলের পাট চাষের উপযোগী। তবে রংপুর ,ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ,কুমিল্লা, ঢাকা, যশোর, জামালপুর ,টাঙ্গাইল ,পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে বেশি পাট উৎপন্ন হয়।

চা বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল। এ দেশে উৎপাদিত চা -এর প্রায় ৬০% বিদেশে রপ্তানি করা হয় ।পাহাড়ি এলাকায় যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় অথচ বৃষ্টির পানি জমে থাকে না এবং শীতের প্রকোপ কম এরূপ স্থান চা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। চা চাষের ক্ষেত্রে মাটির pH মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বর্তমানে ১৫৬ টি চা বাগান রয়েছে। এরমধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় সর্বাধিক ৯০টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, এবং সিলেট জেলায় ১৯টি চা বাগান রয়েছে। দেশের মোট উৎপাদনের ৮০% সা এসব বাগানে উৎপন্ন হয়ে থাকে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় ১৪টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাঙ্গামাটি জেলায় ১টি করে ২টি এবং পঞ্চগড় জেলায় ৭টি চা বাগান রয়েছে।

অন্যান্য অর্থকরী ফসলের মধ্যে তামাক ,তুলা ,রাবার ,ও রেশম  উল্লেখযোগ্য।

রংপুর ,দিনাজপুর, রাজশাহী ,পাবনা এবং কুষ্টিয়ায় তামাক, যশোর কুষ্টিয়া ,রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী প্রভৃতি জেলায় তুলা ;বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে রাবার এবং রাজশাহী ও বগুড়া রেশম উৎপাদিত হয়।

২. বাংলাদেশের বনজ সম্পদের বিবরণ দাও।

কোন দেশের অর্থনীতিতে বনজ সম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের বৃষ্টিপাত, আবহাওয়া  শোধন ,মাটির ক্ষয়রোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও অন্যান্য নানাবিধ ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতে সে দেশের মোট আয়তনের ২০-২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন ,কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৫,৯৭৪.৯৪ বর্গ কিলোমিটার; অর্থাৎ দেশের আয়তন এর শতকরা প্রায় ১৭.৬০ ভাগ সুতরাং প্রয়োজনের তুলনায় এটি মোটেই  পর্যাপ্ত নয়।

জলবায়ু মৃত্তিকা ও উদ্ভিদের উপর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বনভূমিকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়।যেমন-
১) ক্রান্তীয় চিরসবুজ (হরিৎ) ও পাতাঝরা (পত্রপতনশীল) বৃক্ষের বনভূমি;
২) ক্রান্তীয় পত্রপতনশীল বৃক্ষের বনভূমি;
৩) স্রোতজ  বনভূমি (সুন্দরবন)।

১) ক্রান্তীয় চিরসবুজ (হরিৎ) পাতাঝরা (পত্রপতনশীল) বৃক্ষের বনভূমি: বাংলাদেশের দক্ষিণ -পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকের পাহাড়ি এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এ বনভূমি বিস্তার লাভ করেছে ।এ বনভূমির আয়তন প্রায় ১৫,৩২৬ বর্গ কিলোমিটার ।কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বনভূমির আয়তন প্রায় ২,১৪১ বর্গ কিলোমিটার এবং সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা তে মাত্র ৭৯৬ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি রয়েছে। বাংলাদেশের এসব বনভূমির গাছগুলো ঘরে ২৪-৩০ মিটার উঁচু হয়। পরিমিত তাপমাত্রা এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে বনভূমির গাছের পাতা সব সময় সবুজ দেখায় ।তাই একে চিরসবুজ বা চিরহরিৎ বনভূমি বলা হয়। চির সবুজ বৃক্ষের মধ্যে চাপালিশ ,তেলসুর ,মেহগনি, ময়না, প্রভৃতি প্রধান ।এছাড়া এ বনভূমিতে চম্পা, জলপাই, কদম, ছাতিম পিঠালি, জারুল, গর্জন, গামার, সেগুন , পিতরাজ, চাম্বল, কাঞ্চন, নাগেশ্বর ইত্যাদি পাতাঝরা বৃক্ষ রয়েছে।

২) ক্রান্তীয় পত্রপতনশীল বৃক্ষের বনভূমি: এ বনভূমি ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় (১,১৬৪ বর্গ কিলোমিটার) এবং রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় (৩৯ বর্গ কিলোমিটার) অবস্থিত এসব বনভূমির গাছগুলো গড়ে১৫-২৪ মিটার উঁচু হয় ।শাল বা গজারি গাছ ছাড়াও এ বনভূমিতে ছাতিম, কাঁঠাল, কেলীকদম্ব ,হরিতকী, হিজল ,শিরিষ প্রভৃতি বহু মূল্যবান গাছ জন্মে। শাল বা গজারি ব্যাপকভাবে ঘরের খুঁটি ও জ্বালানি হিসেবে, ছাতিম টেক্সটাইল ও অন্যান্য মিলে মাড় হিসাবে,কুচ বৃক্ষ ছাতার বাট তৈরিতে এবং বাকল দ্বারা ওষুধ প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়।

৩) স্রোতজ বনভূমি (সুন্দরবন): বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সমগ্র উপকূলবর্তী এলাকাজুড়ে এ বনভূমি গড়ে উঠেছে ।সমুদ্র উপকূলের লবণাক্ত ও জোয়ার ভাটা প্রভাবিত উদ্ভিদ স্রোতজ বনভূমি বলা হয় ।এর মোট আয়তন প্রায় ৬,৭৮৬ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবন নামে পরিচিত এই বনভূমি বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং বিশ্বের অন্যতম প্রধান ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ।এর বেশির ভাগ অংশ ( ৬,৭২৪ বর্গ কিলোমিটার), সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার দক্ষিণাংশ জুড়ে অবস্থিত। মাত্র ৬২ কিলোমিটার বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। নদীবাহিত উর্বর পলিমাটি ,লোনা পানি ,পরিমিত উত্তাপ, প্রচুর বৃষ্টিপাত, বিরল জনবসতি ,অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি নিয়ামক এর প্রভাবে এ বনভূমি গড়ে উঠেছে ।

সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, গুল্ম ও পরগাছা পাওয়া যায়। এ বনভূমির বৃক্ষের মধ্যে সুন্দরী প্রধান। এছাড়া গেওয়া, গরান, ধুন্দল ও পশুর,বয়েন এবং মোম , গোলপাতা ও ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে ।কাঠ ছাড়া অন্যান্য বনজ সম্পদের মধ্যে বাঁশ ,বেত, ঔষধি গাছ ,মোম, পশুপাখি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।এ বনভূমি হতে প্রাপ্ত আসবাবপত্র, ঘরের খুঁটি, জ্বালানি এবং কাগজ, দিয়ে ও পেন্সিল তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ।তাছাড়া গোলপাতা ঘরের ছাউনি তে ব্যবহার করা হয়।

৩. বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের বর্ণনা দিন।

বাংলাদেশের মৎস উৎপাদন ক্ষেত্রে অবস্থান অনুযায়ী মৎস্য ক্ষেত্রগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়।যথা-

ক) অভ্যন্তরীণ মৎস্য ক্ষেত্র এবং

খ) সামুদ্রিক মৎস্য ক্ষেত্র।

ক. অভ্যন্তরীণ মৎস্য ক্ষেত্র:

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে নদী- নালা, খাল- বিল, পুকুর -ডোবা, হাওর বাওর, ধান ও পাটক্ষেত এবং নদীর মোহনা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে থেকে ধৃত মৎস্য কে অভ্যন্তরীণ বা মিঠা পানির মৎস্য বলা হয় ।অভ্যন্তরীণ মৎস্য ক্ষেত্রের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৩০লক্ষ ৩৫ হাজার ৬০০ একর।
প্রকৃতি ও অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য ক্ষেত্র কে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা:

১) নদ-নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয়:

বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদী, খাল বিল ,হাওর -বাওর প্রভৃতি প্রাকৃতিক জলাশয়ের অন্তর্গত। দেশের প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নদীতে মৎস্য ধরা হয়। তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলো তে সবচেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়।

২) বদ্ধ জলাশয়:

জলাশয় ,পুকুর, দিঘি: বাংলাদেশের বৃহত্তর বরিশাল, সিলেট ,খুলনা ,কুমিল্লা, নোয়াখালী, যশোর, পটুয়াখালী, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ,ফরিদপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলায় দিঘীও পুকুরের সংখ্যা বেশি। এসকল দিঘী ও পুকুরে রুই ,কাতলা , গজার কৈ, সিং, মাগুর, পাবদা, পুটি প্রভৃতি মাছ চাষ করা হয়।

৩) কৃত্রিম জলাশয়:

বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই হ্রদটি অভ্যন্তরীণ মৎস্য ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।এটি দেশের একমাত্র বৃহৎ কৃত্রিম জলাশয়। কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই হ্রদের মুখের নিকটে পানি বিদ্যুতের জলাধার তৈরি করতে গিয়ে এ হ্রদটি সৃষ্টি হয় ।এখানে বহু মূল্যবান মাছের চাষ করা হয়। এরমধ্যে রুই কাতলা মৃগেল কই শিং প্রধান।
৪) নদীর মোহনা: নদীর মোহনা ও উপকূলবর্তী সুন্দরবন অঞ্চলের প্রায় ৪,৫৩,০০ একর এলাকা এ মৎস্য ক্ষেত্রের অন্তর্গত। মিঠা পানি ও লবণাক্ত পানির মিলন স্থলে এ মৎস্য ক্ষেত্র অবস্থিত বলে এখানে স্বাদু ও লবণাক্ত উভয় প্রকার  পানির মৎস ই পাওয়া যায় ।এ এলাকায় চিংড়ি ,ভেটকি, ও তপসে মাছ পাওয়া যায়।
৫) জলমগ্ন শস্য ক্ষেত্র সমূহ: প্লাবন সমভূমির ধান ও পাটক্ষেত গুলো বর্ষাকালে পানিতে পূর্ণ হয় মৎস্য বিচরণের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। স্বল্পস্থায়ী এসব মৎস্য ক্ষেত্র গুলো মাছের খাদ্য ও বংশবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপযোগী ।এ সময় ধান ও পাটক্ষেতের পোকামাকড় ,কেঁচো, কিট ইত্যাদি মাছগুলো খুব দ্রুত পুষ্ট হয় এবং ডিম প্রসব করে বংশ বৃদ্ধি করে।

খ. সামুদ্রিক মৎস্য ক্ষেত্র:

বাংলাদেশের দক্ষিণে প্রায় ৭৩২ কিলোমিটার উপকূল রেখা বরাবর প্রায় ২২ লক্ষ ৬৪ হাজার ১৩২ একর
অঞ্চল ব্যাপী এ মৎস্য ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে ।এলাকায় প্রায় ১৮ টি প্রজাতির চিংড়ি মাছ রয়েছে ।তাছাড়া ভেটকি, লইটা, চেলা ,পোয়া, রূপচাঁদা ,ভারতীয় স্যামন ,ছুরি মাছ উল্লেখযোগ্য।

৪. বাংলাদেশে প্রাপ্ত খনিজ সম্পদ সমূহের বর্ণনা দিন।

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খনিজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম ।বাংলাদেশ আবিষ্কৃত খনিজ সম্পদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস ,খনিজ তৈল, কয়লা ,পিট কয়লা, চুনাপাথর, সিলিকা বালি, চিনামাটি, কঠিন শিলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
নিম্নে এসব খনিজ সম্পদের বর্ণনা দেওয়া হল।
       “বাংলাদেশের মানচিত্র “
        রিসোর্স বুুুকঃ পৃষ্ঠা-৯৯

ক) প্রাকৃতিক গ্যাস:

প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের প্রধান খনিজ সম্পদ। ১৯৫৫ সালে সর্বপ্রথম সিলেটে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রের সংখ্যা ২৩ টি। এর অধিকাংশই বৃহত্তর সিলেট জেলায় অবস্থিত ।এদেশের বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রে প্রায় ২৩ হাজার বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সংরক্ষিত আছে, তার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার বিলিয়ন ঘনফুট।

খ) খনিজ তেল:

পেট্রোলিয়ামের তরল অবস্থা হল খনিজ তেল।১৯৮৬ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রথম তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। ২০২০ থেকে ২০৩০ মিটার গভীরতা প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এখানে মজুদ আছে, তবে উত্তোলনযোগ্য তেলের পরিমাণ প্রায় ৬ মিলিয়ন ব্যারেল। এছাড়াও সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ,কৈলাসটিলা ,এবং বরমচাল তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে।

গ) কয়লা:

বাংলাদেশ কয়লা সম্পদের ততটা সমৃদ্ধ নয়। জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ, রংপুর জেলার খালাসপীর এবং পীরগঞ্জ, দিনাজপুর জেলার বড় পুকুরিয়া এবং দীঘিপাড়া, বগুড়া জেলার কুচমা এবং নওগাঁ জেলার শিবগঞ্জ কয়লা খনি রয়েছে ।জামালগঞ্জ কয়লা খনিতে ১০৫ কোটি ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লা ,খালাসপীর কয়লা খনিতে ৮৬ কোটি ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লা, বড় পুকুরিয়া কয়লা খনিতে ৩৮ কোটি ৯০ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লা সঞ্চিত আছে। উপর্যুক্ত কয়লাখনি  ছাড়া গোপালগঞ্জ ,খুলনা ,সিলেট, সুনামগঞ্জ ,মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ জেলায় পিট কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে।

ঘ) চুনাপাথর:

বাংলাদেশ প্রচুর চুনাপাথর সঞ্চিত আছে। বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাট, লালঘাট ও বগলী বাজার; সিলেট জেলার জাফলং, জকিগঞ্জ; জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট ও জামালগঞ্জ ;চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড; কক্সবাজার জেলার সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় চুনাপাথর পাওয়া যায়। চুনাপাথর সিমেন্ট, গ্লাস, ইস্পাত, সাবান, কাগজ, ব্লিচিং পাউডার প্রভৃতি প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

ঙ) সিলিকা:

এটি এক ধরনের বালু যা কাচ নির্মাণে ব্যবহৃত হয় ।এছাড়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য, রং, অগ্নি চুল্লির ইষ্টক নির্মাণে এর দরকার হয় ।বাংলাদেশের শেরপুর জেলার বালিজুরি, মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া ,হবিগঞ্জ জেলার শাহজিবাজার ও নয়াপাড়া, সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাট, কুমিল্লা জেলার বাতাসিয়া ও  দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে সিলিকা বালু পাওয়া যায়।

চ) চিনামাটি:

বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার বিজয়পুর গ্রামে, নওগাঁ জেলার পত্নীতলা এবং দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে চিনামাটি পাওয়া যায় ।বাসনপত্র, রবার, বস্ত্র, বৈদ্যুতিক ইনস্যুলেটর, স্যানিটারি জিনিসপত্র প্রভৃতি নির্মাণে চিনামাটি ব্যবহৃত হয়।

ছ) কঠিন শিলা:

বাংলাদেশের রংপুর জেলার রানিপুকুর এবং দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া নামক স্থানে কঠিন শিলা পাওয়া যায় ।রেললাইন, রাস্তাঘাট, গৃহ নির্মাণ, নদীর বাঁধ তৈরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কঠিন শিলার প্রয়োজন হয়।

6Oct2020

অধ্যায়-৮ : মানচিত্র অংকন ও ব্যবহার

১. মানচিত্রের সংজ্ঞা লিখুন। মানচিত্রের প্রকারভেদসমূহ বর্ণনা করুন।


বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ের বিভিন্ন পাঠ পরিচালনায় মানচিত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মানচিত্র কী?
সাধারণত মানচিত্র বলতে বড় আকারের কোন এলাকাকে নির্দিষ্ট অনুপাতে ছোট করে আঁকা প্রতিকৃতিকে বুঝায়।
ইংরেজি ম্যাপ (Map )শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘ম্যাপ্পা'(Mappa) থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। যার অর্থ একখণ্ড কাপড় বা একটি রুমাল বা টেবিল আচ্ছাদনের মতো আবরণী কাপড়কে বুঝায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: রউফ এবং মাহমুদ ,২০১০ এর মতে,সমগ্র পৃথিবী অথবা এর কোন অংশের প্রতিকৃতি সঠিক দিক অনুসারে নির্দিষ্ট স্থানে সমতল কাগজের উপর অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা রেখা দ্বারা সৃষ্ট ছকের ভিতরে অংকন করা হলে তাকে মানচিত্র বলে।
মানচিত্র হলো কতকগুলো প্রচলিত সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে কোনো ভূপৃষ্ঠের বস্তু, এলাকা এবং বিষয়ের চিত্র প্রদর্শন করাকে বুঝায়।

মানচিত্রের প্রকারভেদ:


মানচিত্র বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। কী উদ্দেশ্যে মানচিত্রটি ব্যবহৃত হবেতার উপর ভিত্তি করে যে যে মানচিত্র হয় তার কিছু প্রকারভেদ নিচে উল্লেখ করা হলো:
১। মৌজা মানচিত্র (Cadastral Map): ভূমিও বিল্ডিং এর মালিকানার সীমানা চিহ্নিত করার জন্য যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাই মৌজা মানচিত্র। নিখুঁতভাবে সীমানা নির্ধারিত থাকে এ মানচিত্রে।
২। ভূস্থানিক মানচিত্র (Topographic Map): প্রকৃত জরিপ কার্যের মাধ্যমে ভূস্থানিক মানচিত্র তৈরি করা হয়। এ ধরনের মানচিত্রে সাধারণত প্রাকৃতিক ও সামাজিক উপাদান দেখানো হয়ে থাকে। যেমন পাহাড়, সমভূমি, নদনদী, রেলপথ ,হাট-বাজার ইত্যাদি নিখুঁতভাবে দেখানো হয়।
৩। দেয়াল মানচিত্র (Wall Map) : মূলত শ্রেণিকক্ষে ও দেয়ালে প্রদর্শনের জন্য এ ধরনের মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।মানুষের চাহিদা মোতাবেক যখন কোন একটি মহাদেশ ,দেশ ও দেশের এক একটি অংশকে আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয় তাকে দেয়াল মানচিত্র বলে।
৪। মৃত্তিকা বিষয়ক মানচিত্র (Soil Map): মাটির ধরনের উপর ভিত্তি করে এ মানচিত্র তৈরি করা হয়।
৫। প্রাকৃতিক মানচিত্র( Physical Map): মানচিত্রে যখন কোনো দেশ বা অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভূমিরূপ যেমন__ পর্বত, মরুভূমি ,নদনদী, ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে তখন সে মানচিত্রই হলো প্রাকৃতিক মানচিত্র।
৬। ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র( Geological Map): ভূতক গঠনকারী শিলাসমূহের অবস্থান ও গঠনের উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র বলে।
৭। জলবায়ুগত মানচিত্র(Climate Map): বায়ুর তাপ,বায়ুর চাপ ,বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, আদ্রর্তা প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে জলবায়ুগত মানচিত্র বলে।
৮। উদ্ভিজ্জ বিষয়ক মানচিত্র (Vegetation Map) : বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ আছে তার উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে উদ্ভিজ্জ মানচিত্র বলে।
৯। ভূচিত্রাবলী বা এটলাস মানচিত্র (Chorographical or Arts Map) : মানচিত্রের সমষ্টিকে ভূচিত্রাবলি বা এটলাস মানচিত্র বলে। এতে প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও কৃষিভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানচিত্র তৈরি করা হয়।
১০। সাংস্কৃতিক মানচিত্র( Cultural Map): বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের সীমা ঐতিহাসিক কোনো স্থান বা স্থাপত্য বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজব্যবস্থার বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাই সাংস্কৃতিক মানচিত্র।
রাজনৈতিক মানচিত্র, বন্টন মানচিত্র, ঐতিহাসিক মানচিত্র ,সামাজিক মানচিত্র ইত্যাদি সাংস্কৃতিক মানচিত্রের বিভিন্ন প্রকার।

২. মানচিত্রের উপাদান সমূহ লিখুন।


একটি মানচিত্র তৈরি করতে যা কিছু প্রয়োজন হয় সেগুলো হচ্ছে মানচিত্রের উপাদান। কোনো স্থানের মানচিত্র তৈরি করতে হলে যা যা লাগবে তা নিম্নরূপ:

১. কাগজ ,

২. নির্দিষ্ট স্কেল ,

৩. দিকনির্দেশ,

৪. অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখা,

৫. বহি:সীমারেখা,

৭. শিরোনাম ,

৮. সূচি,

৯. মানচিত্রের সিট নম্বর,

১০. জরিপের/ অঙ্কনের তারিখ,

১১. প্রকাশনা ও

১২. গ্রিড দিতে হবে।

মানচিত্র অঙ্কনের জন্য উন্নত মানের কাগজ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাইলর (Mylor) পেপার/অথবা আর্ট পেপারে মানচিত্র অঙ্কন করা সমীচীন। কাগজের আকার অনুসারে মানচিত্রকে কোন নির্দিষ্ট অনুপাতে ছোট বা বড় করে আঁকতে হয়। সে জন্য প্রয়োজন হয় স্কেলের।

৩. অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ এর সংজ্ঞা লিখুন।


মানচিত্রে দেশ, মহাদেশ, মহাসাগর বা অন্য কোন কিছুর সঠিক অবস্থান নির্দেশ করার জন্য অক্ষরেখা এবং দ্রাঘিমা রেখার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। অক্ষরেখা এবং দ্রাঘিমা রেখা অনুসরণ করে মানচিত্র অংকন করলে তা নির্ভুল হয়।
অক্ষাংশ: মূল মধ্যরেখার (যার মান 0° এবং গ্রিনিচ শহরের উপর দিয়ে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত ) পূর্বে এবং পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর যে রেখা অঙ্কন করা হয় তাকে দ্রাঘিমা রেখা বলে। মূল মধ্যরেখা ও পৃথিবীর কেন্দ্রের সাথে যে কোণ সৃষ্টি করে তাকে দ্রাঘিমাংশ বলে।
অক্ষাংশ: অন্যদিকে নিরক্ষীয় বৃত্তের সমান্তরাল করে উত্তর এবং দক্ষিণে যে বৃত্ত অঙ্কন করা হয় তাকে অক্ষরেখা বলে। বিষুব রেখা ও পৃথিবীর কেন্দ্রের সাথে কোনো স্থান যে কোণ সৃষ্টি করে তাকে অক্ষাংশ বলে।

৪. মানচিত্র অঙ্কনে বিশেষ বিভাগ সমূহ উল্লেখ করুন।


মানচিত্রে পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, শহর-বন্দর, রাস্তা, রেলপথ, সীমারেখা প্রভৃতির অবস্থান দেখানো হয় এবং এর জন্য কতগুলো সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় ‌।পৃথিবীর সব দেশে এক ধরনের প্রতীক ব্যবহার করা হয় ।এগুলো সাধারণত মানচিত্রে শিরোনামের নিচে থাকে ।কাগজের উপরের অংশে তীর চিহ্ন বা অনুরূপ কোনো প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করে মানচিত্রের দিক নির্দেশ করা হয়।
মানচিত্র অংকন করার পর চারদিকে সরু ও মোটা রেখা দিয়ে বহি সীমা রেখা অঙ্কন করতে হয়। সীমারেখা এমন ভাবে অঙ্কন করতে হবে যেন কোন অংশ মানচিত্রের বাহিরে না থাকে এবং মানচিত্রে শিরোনাম, সূচী সহজে দেখানো যায়।

শিরোনামঃ মানচিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানচিত্রের সকল ব্যবহৃত সাংকেতিক চিহ্ন দেখা করার জন্য শিরোনামের নিচে বা কাছে একটি সূচি অপরিহার্য। এছাড়াও কোন কোন মানচিত্রে শিট নম্বর উল্লেখ করতে হয়। মানচিত্রের প্রাকৃতিক অবয়ব গুলো সহজে পরিবর্তন হয় না, কিন্তু রাস্তা-ঘাট, শহর-বন্দর প্রভৃতি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় ।তাই মানচিত্রে জরিপের তারিখ সংযোজন করতে হয়।

৫. ট্রেসিং পদ্ধতিতে মানচিত্র অঙ্কন প্রণালী সম্পর্কে লিখুন।

মানচিত্র অঙ্কনের জন্য ট্রেসিং পদ্ধতি অর্থাৎ ছাপ দিয়ে আঁকা খুব সহজ একটি পদ্ধতি।
ট্রেসিং পদ্ধতিতে মানচিত্র অঙ্কনের জন্য ট্রেসিং পেপার, পেন্সিল, বলপেন, জেমস ক্লিপ, ইরেজার, ট্রেসিং টেবিল স্কেলের প্রয়োজন।
যে মানচিত্রটি আঁকতে হবে সে মানচিত্রটিকে ট্রেসিং টেবিলে রেখে তার ওপর সম আকৃতির ট্রেসিং পেপার রেখে চারপাশ এমনভাবে জেমস ক্লীপ আটকাতে হবে কেন মানচিত্র এবং ট্রেসিং পেপারটি নড়াচড়া করতে না পারে। এখন ট্রেসিং টেবিলের লাইট জ্বালালেই নিচের মানচিত্রটি
স্পষ্ট দেখা যাবে।‌ মানচিত্রটিতে যে রেখা যেভাবে আছে সে রেখাগুলো ট্রেসিং পেপার এর উপর পেন্সিল বা বলপেন দিয়ে দাগ টেনে মানচিত্রটি আঁকতে হবে। তারপর মানচিত্রের চারপাশ বহি: সীমারেখা এঁকে মানচিত্রের শিরোনাম ,দিক চিহ্ন এবং সূচি দিতে হবে। মানচিত্র অংকন করার পর জেমস ক্লিপ সরিয়ে নিলেই মানচিত্র অংকন শেষ হবে।

৬. স্কেল কী? বিভিন্ন প্রকার স্কেলের বর্ণনা দিন।


স্কেল:

মানচিত্রের যেকোনো দুটি স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব এবং ভূভাগের উপরিস্থ ঐ দুটি স্থানের মধ্যবর্তী প্রকৃত দূরত্বের অনুপাতই স্কেল।

স্কেলের প্রকারভেদ:

মানচিত্র অংকন করার জন্য সাধারণত তিন ধরনের স্কেল ব্যবহার করা হয়। যথা -১. বর্ণনামূলক স্কেল, ২. রৈখিক স্কেল, ৩. প্রতিভূ অনুপাত স্কেল।
নিম্নে এ তিন ধরনের স্কেল সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো:

১) বর্ণনামূলক স্কেল ( Scale by statement):
মানচিত্রের স্কেল যখন লিখিত বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে বর্ণনামূলক স্কেল বলে। যেমন_১ সেন্টিমিটার সমান ১০ কিলোমিটার ।এক্ষেত্রে মানচিত্রের ১ সেন্টিমিটার দূরত্ব প্রকৃত ভূমির ১০ কিলোমিটার দূরত্বের সমান।

২) রৈখিক স্কেল (Linear scale):
রৈখিক পরিমাপে একটি সরলরেখা অঙ্কন করে তাকে সুবিধামতো কতগুলো অংশে বিভক্ত করে ভূমির দূরত্ব প্রকাশ করা হয় ,তখন তাকে রৈখিক স্কেল বলে। যেমন ১ সেন্টিমিটার = ১০কিলোমিটার । এই স্কেল দেখানোর জন্য মানচিত্রের স্কেল স্থানে সেন্টিমিটার ৬ সে. মি .লম্বা একটি রেখা টেনে তাকে সমান ৬ টি ভাগে ভাগ করলে প্রতি ভাগ ১০ কিলোমিটার হবে, যা ভূমির প্রকৃত দূরত্ব নির্দেশ করে।

৩) প্রতিভূ অনুপাত স্কেল ( scale by representative fraction) :
স্কেলকে যখন ভগ্নাংশে বা অনুপাতে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে প্রতিভূ অনুপাত স্কেল বলে।
যেমন-১সেন্টিমিটারে ১ কিলোমিটার বর্ণনায় প্রকাশিত স্কেলটিতে প্রতিভূ অনুপাতে প্রকাশ করতে হলে কিলোমিটারকে সেন্টিমিটারে আনতে হয় এবং উভয় স়়ংখ্যার অনুপাত হবে ১:১০০০০০।

৭. মানচিত্র অঙ্কনের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করুন।

কোনো মানচিত্র অংকন করার আগে কতকগুলো বিষয় চিন্তা ভাবনা করে মানচিত্র অঙ্কন করতে হয়।
মানচিত্র অংকনবিদকে জানতে হবে- মানচিত্র ব্যবহারকারী কে বা কারা? তাদের বয়স কত! মানচিত্রটি কী প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে ? মানচিত্র কতটুকু সঠিক হওয়া প্রয়োজন? কোন কোন সংকেত ব্যবহার করতে হবে, মানচিত্রের স্কেল কী হবে? ইত্যাদি(রউফ এবং মাহমুদ,২০১০:৩৩৪)

মানচিত্র অঙ্কন পদ্ধতি:
মানচিত্র অঙ্কনের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। মানচিত্র অঙ্কনের কয়েকটি পদ্ধতি নিম্নরূপ । (গ্রাফোসম্যান,১৯৯৬:৭৩)

১. ট্রেসিং ও ছকবর্গ পদ্ধতি:
পূর্বে অঙ্কিত মানচিত্র হতে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সুবিধাজনক স্কেলে পরিবর্তন করে নতুন মানচিত্র অঙ্কন করা হয়। ট্রেসিং পদ্ধতি এবং ছকবর্গের সাহায্যে সহজে মানচিত্র অঙ্কন করা যায়।

২. জরিপ পদ্ধতি:
ভূমি জরিপের মাধ্যমে নতুন মানচিত্র অঙ্কন করা হয় ।এতে চেইন, প্লেন ,টেবল,টেপ, কম্পাস ,লেভেলিং , প্রিজমেটিক কম্পাস, থিওডিলাইট প্রভৃতি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।

৩. এরিয়াল ফটোগ্রাফ(Aerial Photograph):

আকাশ থেকে বিমান বা ভূ- উপগ্রহের মাধ্যমে ছবি দিয়ে এ ধরনের মানচিত্র অঙ্কন করা হয়।

৪. জি আই এস পদ্ধতি (Geographic Information System):
ভৌগোলিক তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ ব্যবস্থাকে সংক্ষেপে জিআইএস বলে। এটি কম্পিউটারের মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ ব্যবস্থা। জিআইএস এর মাধ্যমে একটি মানচিত্রের মধ্যে তথ্যের বিশ্লেষণ করে মানচিত্র উপযোগিতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

মানচিত্রে পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী ,শহর বন্দর, রাস্তা ,রেলপথ, সীমারেখা প্রভৃতির অবস্থান দেখানো হয় এবং এর জন্য কতগুলো সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর সব দেশেই একই ধরনের প্রতীক ব্যবহার করা হয়। এ চিহ্নগুলো সাধারণতমানচিত্রের শিরোনামের নিচে থাকে কাগজের উপরের অংশ উত্তর দিক। তীরচিহ্ন বা অনুরূপ কোন প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করে মানচিত্রের দিক নির্দেশ করা হয়।

৮. ছকবর্গ পদ্ধতিতে মানচিত্র অঙ্কন প্রণালী বর্ণনা করুন।

পূর্বে অঙ্কিত মানচিত্র থেকে ছকবর্গের সাহায্যে সহজে মানচিত্র অঙ্কন করা যায় এ ক্ষেত্রে কয়েকটি পর্যায় অনুসরণ করতে হবে। নিম্নে পর্যায়সমূহ নিম্নরূপে বর্ণিত হলো:

প্রথম পর্যায়:
যে মানচিত্রটি আঁকতে হবে তা নির্বাচন করতে হবে ।এরপর মানচিত্রের উপর পেন্সিল দিয়ে সমান দূরত্ব বজায় রেখে পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণ বরাবর কয়েকটি রেখা আঁকতে হবে। রেখাগুলো এমনভাবে আঁকতে হবে যেন মানচিত্রটি পুরোপুরি ছকের ভিতর থাকে। এটি হবে মূল মানচিত্র। পূর্ব পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণ বরাবর রেখাগুলো পরস্পর ছেদ করে কয়েকটি ছক বর্গ তৈরি হবে। মানচিত্র ছোট করতে হলে ছক বর্গ ছোট করতে হবে এবং মানচিত্র বড় করতে হলে ছকবর্গ বড় করতে হবে ।তবে সে ক্ষেত্রে মানচিত্রের স্কেল সমানুপাতিক হারে বড় বা ছোট করতে হবে।

দ্বিতীয় পর্যায়:
মানচিত্রের সম-আকৃতির একটি সাদা কাগজ নিতে হবে। সাদা কাগজে ছক বর্গ আঁকতে হবে মনে রাখতে হবে প্রথম মানচিত্রটিতে যে কয়টি ছকবর্গ অঙ্কন করা হয়েছিল সাদা কাগজে সেই কয়টি ছকবর্গ অঙ্কন করতে হবে। মানচিত্রটি পূর্বের মানচিত্র অপেক্ষা দ্বিগুণ করতে হলে প্রতিটি বর্গের দূরত্ব দ্বিগুণ করতে হবে।

তৃতীয় পর্যায়:

পূর্বের মানচিত্রের ছকবর্গের মধ্যে মানচিত্রের সীমানা রেখা এবং অন্যান্য বিষয়াদি যে যেভাবে আঁকা হয়েছে অবিকল এ কিভাবে সাদা কাগজের ছকবর্গে সেই সীমানা রেখা এবং অন্যান্য বিষয়াদি আঁকতে হবে ।এভাবে নতুন একটি মানচিত্র পাওয়া যাবে। তারপর মানচিত্রের চারপাশ বহি :সীমারেখা এঁকে মানচিত্রের শিরোনাম দিতে হবে। দিকচিহ্ণ দিতে হবে । মানচিত্রে বিভিন্ন বিষয়ে বুঝানোর জন্য মানচিত্রের শিরোনামের নিচে বা সুবিধাজনক স্থানে সাংকেতিক চিহ্ন দিতে হবে। সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রচলিত সাংকেতিক চিহ্ন অনুসরণ করতে হবে ‌।পূর্বের মানচিত্রে যেভাবে স্কেল অংকন করা আছে নূতন মানচিত্রে সেইভাবে স্কেল অংকন করতে হবে। নতুন মানচিত্রের অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের বা সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বতের নাম লিখতে হবে।

প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য পূর্বে অঙ্কিত মানচিত্র হতে ট্রেসিং পদ্ধতি এবং ছকবর্গের সাহায্যে মানচিত্র অঙ্কনের দক্ষতা অর্জন করা দরকার।

ভূমি জরিপের মাধ্যমে নতুন মানচিত্র অঙ্কন করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।এরিয়াল ফটোগ্রাফ এবং বর্তমানে কম্পিউটারের জিআইএস এর মাধ্যমে সঠিকভাবে ইলেকট্রনিক মানচিত্র অঙ্কন করা যায়। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়।

৯. বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয় পাঠদানে মানচিত্র ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আপনার ধারণা ব্যাখ্যা করুন।

সাধারণত মানচিত্র বলতে বুঝায় বড় আকারের কোনো এলাকাকে নির্দিষ্ট অনুপাতে ছোট করে আঁকা প্রতিকৃতিকে বুঝায়।
‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বিষয়ের বিভিন্ন পরিচালনায় মানচিত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এজন্য’ বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ‘শিক্ষকের মানচিত্র অংকন ও ব্যবহারের জ্ঞান,দক্ষতা থাকা প্রয়োজন।

মানচিত্র ব্যবহারের গুরুত্ব:
‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ প্রকৃতি ও সমাজের নানাবিধ দিকের একটি সমন্বিত বিষয়। এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ,ইতিহাস, সংস্কৃতি ,অর্থনীতি, রাজনীতি , ভূগোল , জনসংখ্যা ইত্যাদি। বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ের বিভিন্ন পাঠে মানসম্মত শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনায় মানচিত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
মানচিত্র ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. প্রাকৃতিক মানচিত্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর পাহাড় পর্বত, নদ-নদী, হৃদ, সাগর মহাসাগর প্রভৃতির অবস্থান জানতে পারবে।

২. সাংস্কৃতিক মানচিত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দেশের সম্পদ, জনমিতিক পরিস্থিতি, রাষ্ট্রের সীমা , প্রশাসনিক অঞ্চল, ঐতিহাসিক স্থান ওস্থাপত্য ,বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থার বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা ও জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা যায়।

৩. মানচিত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে নিজ দেশ ও অন্যান্য দেশের স্থল ,জল ,আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কে যথাযথভাবে অবহিত করা যায়।

৪. কোন দেশের বিভিন্ন বন্দর ,শহর, বাণিজ্য কেন্দ্রের অবস্থান বুঝানোর জন্য শিক্ষকের মানচিত্র ব্যবহার করা দরকার। মানচিত্র ব্যবহার করে পাঠ পরিচালনা করা নানা দিক থেকে অপরিসীম বার্তা বহন করে। ফলে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে মানচিত্রের সহকারে পাঠ পরিচালনায় শিক্ষককে আগ্রহী ও যত্নবান হতে হবে। এজন্য শিক্ষককে নানাবিধ মানচিত্র সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শিক্ষক মানচিত্র তৈরি করবেন।

পরিশেষে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় পাঠদানে মানচিত্রের ব্যবহার যথাযথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

6Oct2020

অধ্যায়-৭

১) বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা করুন।

ভূ-প্রকৃতিঃ কোনাে স্থানের ভূমির রূপ বা অবস্থাকে সে স্থানের ভূ-প্রকৃতি বলা হয়। 

আমাদের প্রত্যকের তার এলাকা বা অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি যেমন জানা প্রয়ােজন, তেমনি নিজ দেশ অর্থাৎ সমগ্র বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কেও সকলের সম্যক ধারণা থাকা প্রয়ােজন।

উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া দেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চলই নদী বাহিত পলি দ্বারা গঠিত সমভূমি। এ দেশের ওপর দিয়ে অসংখ্য নদ-নদী প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এগুলাের মধ্যে প্রধান প্রধান নদী হল পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী প্রভৃতি। এসব নদ-নদী এবং এর উপনদী ও অসংখ্য শাখা-প্রশাখা উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। সাগরে মিশে যাওয়ার আগে এসব নদী তার পলি দিয়ে এ অঞ্চলকে পৃথিবীর বৃহওম বদ্ধীপ হিসাবে গড়ে তুলেছে।

ভূমির অবস্থা ও গঠন সময়ানুক্রমিক হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিরূপকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা

(১) পাহাড়ি অঞ্চল

(২) পুরাতন পলল গঠিত সমভূমি অঞ্চল ও

(৩) সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি অঞ্চল।

১.পাহাড়ি অঞ্চলঃ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জের পাহাড়ি এলাকাগুলাে নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। সম্ভবত টারশিয়ারি যুগে (২.৫মিলিয়ন বছর আগে) হিমালয় পর্বতমালা সৃষ্টির সময়ে মিয়ানমারের দিক থেকে আসা ধাক্কায় ভাঙাগ্রস্ত হয়ে এ অঞ্চলের পাহাড়গুলাের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এদের টারশিয়ারি যুগের পাহাড় বলা হয়। এ পাহাড়গুলােকে আসামের লুসাই এবং মিয়ানমারের আরাকান পাহাড়ের সমগোত্রীয় বলে ধারণা করা হয় (চৌধুরী, ২০১১:১৫২)। উত্তর-পূর্ব অর্থাৎ সিলেট অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়গুলাে বেশ উঁচু। এগুলাের গড় উচ্চতা ৬১০ মিটার। বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় চুড়ার নাম তাজিংডং (বিজয়)। এর উচ্চতা ১২৩১ মিটার। দ্বিতীয় উঁচু পাহাড় চুড়ার ন্যম কেওক্রাডং। এর উচ্চতা ১২৩০ মিটার। দুটি পাহাড়ই বান্দরবান জেলায় অবস্থিত (মাবুফা, ২০১০, পৃ. ৬৩)। দক্ষিণ-পূর্ব এ পাহাড়ি অঞ্চলের প্রধান নদী কর্ণফুলী, মাতামুহুরী, সাঙ্গু, হালদা ও নাফ। এ অঞ্চলটি বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষে আবৃত। বৃক্ষরাজির মধ্যে শাল, সেগুন, কড়ই, গর্জন, গজারি, চাপালিশ, মেহগনি, রাবার, জাবুল, গামার, অর্জুন, চাম্বল ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। উত্তর-পূর্ব দিকের পাহাড়গুলাে বেশি উঁচু নয়। এদেরকে টিলা বলে। সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জের এসব ছােট ছােট পাহাড়লােতে বাংলাদেশের অধিকাংশ চা বাগান অবস্থিত। এ এলাকার নদীগুলাের মধ্যে সুরমা, কুশিয়ারা অন্যতম।

২.পুরাতন পলল গঠিত সমভূমি অঞ্চল ঃ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলের বিশাল বরেন্দ্রভূমি, মধ্যভাগের ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর, গাজীপুর জেলার ভাওয়ালের গড় এবং কুমিল্লা জেলার লালমাই উচ্চভূমি এ অঞ্চলের অন্তর্গত। প্লাইস্টোসিন যুগের শেষে বরফ গলা পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্লাবন সৃষ্টি হয়ে এসব উচ্চভূমি গঠিত হয় বলে ধারণা করা হয়। বরেন্দ্রভূমির আয়তন ৯,২৮৮ বর্গকিলোমিটার, মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের আয়তন ৪,১০৫ বর্গকিলোমিটার এবং লালমাই পাহাড়ের আয়তন ৩৪ বর্গ কিলোমিটার। বরেন্দ্র ভূমির উচ্চতা ৬-১২ মিটার, মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের উচ্চতা ৬-৩০ মিটার এবং শালমাই পাহাড়ের গড় উচ্চতা ২১ মিটার। এ অঞ্চলের মাটির রং লাল ও ধূসর। মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ে গজারি এবং শাল বৃক্ষের বন রয়েছে।

৩. সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি অঞ্চল : বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল এবং প্লাইস্টোসিন যুগের সােপানসমূহ ছাড়া দেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চল সাম্প্রতিককালের পলল সমভূমি। এ সমভূমি ক্রমশ উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালু। এ অঞ্চল পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্ৰহ্মপুত্ৰ প্রভৃতি নদ-নদী এবং এদের উপনদী ও শাখানদী বাহিত পলল মাটি দ্বারা গঠিত। এ সমভূমির গড় উচ্চতা ৯ মিটার । বর্ষার সময় নদীগুলাে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। প্রতি বছরই বন্যার পানিতে এ অঞ্চল প্লাবিত হয়, ফলে জমিতে প্রতিনিয়ত পলিমাটি পড়ে নতুন ভূমি গঠন করে। এই মাটি অনেক উর্বর। 

২) অর্থনৈতিক কার্যাবলি, মানুষের জীবনধারা, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভূ-প্রকৃতির প্রভাব বর্ণনা করুন।

অর্থনৈতিক কার্যাবলি, মানুষের জীবনধারা, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভূ-প্রকৃতির প্রভাবঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যাবলি, মানুষের জীবনধারা, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভূ প্রকৃতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যেমন-বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাহাড় থাকায় বর্ষাকালে। দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এ সকল পাহাড়ে বাধা পেয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়, যা কৃষিকাজে বিশেষ করে ইরি এবং বােরাে ধান উৎপাদনে ব্যাপক সাহায্য করে। পাহাড়ি অঞ্চলে রয়েছে বিশাল বনভূমি, এসব বনভূমিতে প্রচুর মূল্যবান কাঠ এবং ফল পাওয়া যায়। শাল, সেগুন, কড়াই, গর্জন, গজারি, চাপালিশ, মেহগনি, রাবার প্রভৃতি মূল্যবান কাঠের গাছ এ অঞ্চলে রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে বাঁশ, বেত জন্মায়, যেগুলাে ঐ অঞ্চলের কাগজ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব অঞ্চলে খনিজ সম্পদ বিশেষ করে গ্যাস তেল পাওয়া যায়। অঞ্চলের পাহাড়ের ঢাল টিলা গুলাে চা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযােগী।পাহাড়ি এলাকার নদী গুলাে খুবই খরস্রোতা হয়। এ এলাকার এরকম একটি নদী হল কর্ণফুলী। এ খরস্রোতা নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে এ সকল অঞ্চলে বহু শিল্প গড়ে উঠেছে। বরেন্দ্রভূমি, মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং লালমাই উচ্চভূমি থেকে প্রচুর মূল্যবান কাঠ এবং ফল সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের বিশাল নদী বাহিত পলল মৃত্তিকার সমভূমিতে অতি সহজেই কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য এ অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানেই ঘন বসতিও গড়ে ওঠে। সমতলভূমির দক্ষিণ-পশ্চিমে বিশাল সুন্দরবন গড়ে উঠেছে। এখানে পাওয়া সম্পদের মধ্যে প্রচুর কাঠ, মধু, পশু-পাখি বিশেষ করে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার উল্লেখযােগ্য। দক্ষিণের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত ও সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের অন্যান্য প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনাসমুহ দেখতে অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ভিড় করে। পাহাড়ি অঞ্চলের অধিবাসীগণ সাধারণত বলিষ্ঠ, স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ, পরিশ্রমী, সাহসী, উৎসাহী ও কষ্টসহিষ্ণু হয়ে খাকে। প্রতিকূল পরিবেশ এদের দৈহিক গঠন, চরিত্র এবং বসবাসের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সমভূমির ন্যায় যাতায়াত সহজ নয় বলে এরা বলিষ্ঠ। প্রায়ই বন্য জন্তুর সম্মুখীন হতে হয় বলে এরা যথেষ্ট সাহসীও হয়ে থাকে। কৃষি এবং বসবাস সহজ নয় বলে এরা পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু হয়। অন্যদিকে উর্বর সমভূমি অঞ্চল গুলোতে সহজেই ফসল উৎপাদন সন্ভ্ব বলে মানুষ সহজে কৃষিকাজ করে। এখানকার যাতায়াতও সহজ বলে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। তবে নদীভাঙন এলাকা, বন্যাকবলিত এলাকা এবং সাগরপাড়ের অধিবাসীগণ প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হয় বলে অপেক্ষাকৃত কষ্টসহিষ্ণু। এ অঞ্চলের অধিবাসীগণ সহজ-সরল জীবনযাপনের পাশাপাশি সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে চর্চা করে থাকে। সুতরাং দেখা যায় ভূ-প্রকৃতি কোনাে অঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যাবলি, মানুষের জীবনধারা, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

৩) বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীগুলোর উৎপত্তিস্থল ও শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে বর্ণনা দিন।

 বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের নদ-নদীর মানচিত্র লক্ষ করলে দেখা যায়, দেশ জুড়ে জালের মতাে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী এবং তার শাখা-প্রশাখা। এগুলাের মধ্যে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র কর্ণফুলী এবং তিস্তা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এসব নদীর শাখানদী এবং উপনদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০-এর মতে।

পদ্মা : গাঙ্গেয় বদ্বীপের অন্যতম নদী গঙ্গা। মধ্য হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে এ নদী ভারতের দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। গঙ্গা নদীর একটি শাখা পদ্মা নামে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবেশ করেছে এবং গােয়ালন্দের কাছে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। পদ্মা নদী আরাে ১০৪ কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। পদ্মা নদীর প্রধান শাখা নদীগুলাের মধ্যে ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কুমার, গড়াই, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। এর উপনদী এগুলাে হলাে পুনর্ভবা, নাগর, পাগলা, মহানন্দা । ব্ৰহ্মপুত্ৰ : ব্ৰহ্মপুত্ৰ হিমালয়ের কৈলাস পর্বতের একটি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও আসামের মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রামের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। প্রথম শাখাটি যমুনা নামে দক্ষিণ দিকে ২৭৭ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে গােয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। দ্বিতীয় শাখাটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবাহিত হয়ে ভৈরবের কাছে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা নদী বংশী ও শীতলক্ষা এবং প্রধান উপনদী ধরলা ও তিস্তা।

যমুনা : জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্রের শাখা যমুনা নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে দৌলতদিয়ার কাছে পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে । যমুনা নদীর প্রধান শাখা নদী ধলেশ্বরী এবং ধলেশ্বরীর শাখানদী বুড়িগঙ্গা। এর উপনদী এগুলাে হলাে ধরলা, করতোয়া, আত্রাই প্রভৃতি।

মেঘনা : ভারতের বরাক নদী সিলেট সীমান্তে সুরমা এবং কুশিয়ারা নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং আজমিরিগঞ্জের কাছে মিলিত হয়ে কালনী নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। পরে মেঘনা নাম ধারণ করে চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামেই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। সোমেশ্বরী, কংস, গোমতী প্রভৃতি মেঘনার উপনদী এর শাখা নদীগুলাের মধ্যে তিতাস ও ডাকাতিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

কর্ণফুলী : কর্ণফুলী নদী লুসাই পাহাড়ে উৎপন্ন হয়ে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে ২৭.৪ কিলােমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এটি চট্টগ্রাম ও রাঙামাটির প্রধান নদী। কাসালং, হালদা, মাইনী, চেঙ্গী প্রভৃতি কর্ণফুলী নদীর উপনদী এবং শাখা ও বােয়ালখালী এর প্রধান শাখা নদী।

 ৪) বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনৈতিক কার্যাবলি, মানুষের জীবনধারা, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নদ নদীর প্রভাব বর্ণনা করুন।

বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনৈতিক কার্যাবলি, মানুষের জীবনধারা, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নদ নদীর প্রভাবঃ

বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনৈতিক কার্যাবলি, মানুষের জীবনধারা, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নদ নদীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এর জন্য নদ-নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অসংখ্য নদ-নদী বর্ষাকালে দুকূল প্লাবিত হয়ে প্রচুর পলিমাটি সঞ্চিত করে যা ধান, পাট, গম চাষে খুবই উপযােগী। অন্যদিকে শুকনাে মৌসুমে কৃষিকাজে প্রচুর সেচের প্রয়ােজন হয়। এ সকল নদ-নদী থেকে সেচের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। গঙ্গা-কপােতাক্ষ (জিকে) প্রকল্প, তিস্তা বাধ প্রকল্প, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, মেঘনা,ধােনাগােদা প্রকল্প প্রভৃতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জমি সেচ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। বাংলাদেশে সড়ক পথের যথেষ্ট সম্প্রসারণ হলেও এখনাে অধিকাংশ বাণিজ্য নদীপথে পরিচালিত হয়ে থাকে, ফলে প্রধান নদীগুলােকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নদীবন্দর। তাছাড়া এ সকল নদ-নদী বিশাল মৎস্যভাণ্তার। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রভৃতি নদী থেকে প্রচুর ইলিশ, রুই, কাতলা, বােয়াল, চিতল, চিংড়ি প্রভৃতি মাছ ধরা পড়ে। এগুলাে রপ্তানি করে বাংলাদেশ যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে তেমনি এ অঞ্চলের মানুষের আমিষের অভাব পূরণ করছে। শিল্পকারখানায় ও কৃষিকাজে প্রচুর পানির প্রয়ােজন, নদীগুলাে সে চাহিদা মেটাচ্ছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের শিল্পকারখানায় বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা, চট্টগ্রাম শিল্পকারখানায় কর্ণফুলী, রাজশাহী শিল্পকারখানায় পদ্মা, খুলনা শিল্প কারখানায় রূপসা, সিলেট শিল্প কারখানায় সুরমা এবং বরিশাল শিল্পকাৱখানায়

কীর্তনখোলা নদী থেকে পানি সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশের নদী থেকে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে প্রায় ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হচ্ছে। 

৫) বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এ দেশের জলবায়ুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। জলবায়ুর ভিত্তিতে বাংলাদেশকে কয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে তা বর্ণনা করুন।

 বাংলাদেশের ভৌগােলিক অবস্থান এ দেশের জলবায়ুর ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।বাংলাদেশের প্রায় মধ্যভাগ দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এবং দক্ষি বিশাল জলরাশি থাকায় এ দেশের জলবায়ু সমভাবাপন্ন। বাংলাদেশের উত্তর দিকে এশিয়ার প্রায় মধ্যভা সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসা হিমশীতল বায়ুপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, তাই শৈ তীব্র শীত অনুভূত হয় না। আবার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থাকায় গ্রীষ্মকালে মৌসুমি বায়ু প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প বহন করে আনে এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এর ফলে গরমের তীব্রতাও হ্রাস পায়। বছরকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ কলেও জলবায়ুর ভিত্তিতে বাংলাদেশে মাত্র তিনটি সুনির্দিষ্ট ঋতু লক্ষ করা যায়। এ ঋতুগুলাে হলাে-গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত ঋতু ।

মার্চ থেকে মে (ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি) মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ঋতু। গ্রীষ্ম সবচেয়ে উষ্ণতম ঋতু। এ ঋতুতে সাধারণত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। এপ্রিল উষ্ণতম মাস। এপ্রিল-মে মাসে প্রচণ্ড বজপাতসহ ঝড়-বৃষ্টি হয়। এই ঝড়-বৃষ্টিকে কালবৈশাখী বলে। অনেক সময় কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে শিলাবৃষ্টিও থাকে। ঝড়ে প্রচুর ক্ষতি হয়। তবে বৃষ্টিপাতে কৃষির উপকার হয়।

 গ্রীষ্মের পরই বর্ষা ঋতু শুরু হয়। বাংলাদেশে জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বর্ষা ঋতু স্থায়ী হয়। এ সময় সূর্য কর্কটক্রান্তির নিকটে থাকায় বায়ুচাপের তারতম্য ঘটে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে আসায় প্রচুর জলীয়বাষ্প বহন করে এবং বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এ সময় দেশে সারা বছরের মােট বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০% সংঘটিত হয়। এ সময় সর্বনিম্ন ১১৯ সেন্টিমিটার এবং সর্বোচ্চ ৫৩৭ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। গড় বৃষ্টিপাত ৩৪০ সেন্টিমিটার। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয় সিলেটের লালখানে (প্রায় ৩০৪ সেন্টিমিটার)। বর্ষাকালে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ২৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে।

 প্রতি বছর নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে শীতকাল থাকে। এ সময় সূর্য দক্ষিণ গােলার্ধে থাকায় বাংলাদেশে এর রশ্মি তীর্যকভাবে পড়ে এবং তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে যায়। এই সময় মধ্য এশিয়ার শীতল বাতাস উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু হিসাবে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জানুয়ারি মাস সবচেয়ে শীতলতম মাস। উপকূলীয় অঞ্চলে শীত একটু কম এবং উত্তর অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত শীত বেশি অনুভূত হয়। শীতকালে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা প্রায় ২৬.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা প্রায় ১২.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তর পূর্বের শুষ্ক অঞ্চল থেকে আসা শীতল বায়ু জলীয়বাষ্প শূন্য থাকায় বৃষ্টি খুব কম হয়।

৬) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যাবলির ওপর জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে লিখুন।

 অর্থনৈতিক কার্যাবলির ওপর জলবায়ুর প্রভাব বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যাবলি জলবায়ুর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। এ দেশের অধিকাংশ লােক প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে কৃষি হতে। আর কৃষির উৎপাদন আবার সম্পূর্ণ জলবায়ুর আনুকূল্যের ওপর নির্ভর করে। নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যাবলির ওপর জলবায়ুর প্রভাব আলােচনা করা হলো।বাংলাদেশের কৃষি কাজের ওপর জলবায়ুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। মৌসুমি জলবায়ু বিশিষ্ট বাংলাদেশের জলবায়ুতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঋতুর আবির্ভাব হয় বলে এক এক ঋতুতে এক এক ধরনের ফসল উৎপন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রীষ্মকালে অধিক উত্তাপ ও বৃষ্টি সহ্যকারী ফসল যেমন-ধান, পাট, ইক্ষু, চা, শীতকালে মুদু উত্তাপ ও মৃদু শীত সহকারী ফসল যেমন-গম, ভুট্টা, তুলা, যব, ডাল, সরিষা, শাক সবজি, পিয়াজ, রসুন, ধনিয়া প্রভৃতি ফসল উৎপন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আর্দ্র জলবায়ু এ দেশে কার্পাস বয়ন ও পাট বয়ন শিল্প প্রসারের সহায়ক। বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জলবায়ুতে এ পরিবর্তনগুলাে কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে দেশে বিভিন্ন ঋতুর আগমন ও প্রস্থান, বিভিন্ন ঋতুর তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিগত প্রায় এক যুগ ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, মাঘ-ফায়ুন পার হওয়ার পরও চৈত্র-বৈশাখ মাসে দেশের উত্তরাঞ্চলে রাতে প্রচণ্ড শীত অনুভূত হয় এবং দুপুর পর্যন্ত ঘন কুয়াশাজ পরিলক্ষিত হয়। কোনাে কোনাে বছর বর্ষাকাল পূর্বের চেয়ে কিছুটা দীর্ঘ হয়। এর অন্যতম কারণ হলাে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ছে। ব্যাপক হারে বন-জঙ্গল ধ্বংস ক্রার ফলে এবং যন্ত্রত্তর শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের ফলে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে । ফলে জলবায়ুতে এ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।

৭) বাংলাদেশের অবস্থান, আয়তন, সীমানা ও আবহাওয়া সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করুন।

বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ, যা ২৬° ৩৮’ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২০° ৩৪’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮° ০১’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৯২° ৪১’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই দেশটির পশ্চিম, উত্তর, আর পূর্ব সীমান্ত জুড়ে রয়েছে। ভারত। পশ্চিমে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় রাজ্য। পূবে আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম। তবে পূর্বদিকে ভারত ছাড়াও মিয়ানমারের (বার্মা) সাথে সীমান্ত রয়েছে। দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। ভূতাত্ত্বিকভাবে, দেশটি থেকে উত্তর দিকে রয়েছে সুউচ্চ হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, যেখান থেকে বরফ গলা পানির প্রবাহে সৃষ্ট বড় বড় নদী (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ইত্যাদি) বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবহমান এবং নদীগুলো গিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। বর্ষাকালে নদী বাহিত পানির প্রবাহ বেড়ে গেলে নদী উপচে পানি লোকালয়ে পৌঁছে যায়, এবং দেশটি এভাবে প্রায় প্রতি বছরই বন্যায় আক্রান্ত হয়। এই দেশটির প্রায় মাঝখান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে এবং এর আবহাওয়াতে নিরক্ষীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়। বছরে বৃষ্টিপাতের মাত্রা ১৫০০-২৫০০ কিলোমিটার (৬০-১০০ইঞ্চি); পূর্ব সীমান্তে এই মাত্রা ৩৭৫০ মিলিমিটার (১৫০ ইঞ্চি বেশি)। স্বাভাবিক অবস্থায় গড় তাপমাত্রা ২৫° সেলসিয়াস। আবহমান কাল থেকে এদেশে ঋতুবৈচিত্র্য বর্তমান ছিল, ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্য আলাদা আলাদাভাবে এই দেশে উপলব্ধ হয়; গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত -এই ছয় ঋতুর কারণে দেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়ে থাকে। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত হালকা শীত অনুভূত হয়। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল চলে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এদেশে মৌসুমী বায়ু সক্রীয় থাকে, তাই জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে বর্ষা মৌসুম। এসময় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, যা অনেক সময়ই বন্যায়ভাসিয়ে দেয়। এছাড়াও মৌসুমী বায়ু প্রবাহের আগ মুহূর্তে কিংবা বিদায়ের পরপরই স্থলভাগে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, কিংবাসাগরে নিম্নচাপ, জল-ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, যার আঘাতে বাংলাদেশ প্রায় সমুদ্র স্তর সর্বাধিক দিয়ে সংঘটিত এসকল পরিবর্তনভূতাত্ত্বিকভাবে, দেশটি থেকে উত্তর দিকে রয়েছে সুউচ্চ হিমালয় পার্বত্যাঞ্চল, যেখান থেকে বরফ গলা পানির প্রবাহে নিয়মিতই আক্রান্ত হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের এই স্বাভাবিক চিত্র এখন অনেকখানি বদলে গেছে। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ,বাংলাদেশে, জলবায়ুগত স্থূল পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে।

৮) বাংলাদেশের রাজধানী ও বিভাগ সম্পর্কে বর্ণনা দিন।

বাংলাদেশের রাজধানী ও বিভাগঃ
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, এটি বাংলাদেশের প্রায় মাঝখানে অবস্থিত। এটি প্রায় ৪০০ বছরের একটি পুরাতন শহর। শহর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ঢাকার লােকসংখ্যা প্রায় ১৬.৬ মিলিয়ন। বাংলাদেশের সরকার ও জনপ্রশাসনের সকল প্রধান কার্যালয় রাজধানী শহরে অবস্থিত। দেশ পরিচালনার সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে আটটি বিভাগীয় শহরে ভাগ করা হয়েছে। বিভাগগুলাে হলাে-ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, রাজশাহী বিভাগ, খুলনা বিভাগ, বরিশাল বিভাগ, রংপুর বিভাগ, সিলেট বিভাগ ও ময়মনসিংহ বিভাগ। আয়তনে সবচেয়ে বড় চট্টগ্রাম বিভাগ এবং সবচেয়ে ছােট সিলেট বিভাগ। প্রতিটি বিভাগে একটি করে বিভাগীয় শহর আছে, এ শহরগুলাের নাম অনুযায়ী বিভাগগুলাের নামকরণ হয়েছে।ঢাকা বিভাগঃ সীমানা: উত্তরে ময়মনসিংহ, দক্ষিণে বাগের হাট, পিরোজপুর, বরিশাল ও চাঁদপুর; পূর্বে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা; পশ্চিমে নড়াইল, মাগুড়া, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ। আয়তন : ৩১০৫১ বর্গ কিঃ মিঃ, লােকসংখ্যা : ৪,৬৭,২৯,০০০ , জেলার সংখ্যা : ১৩ টি, উপজেলার সংখ্যা : ১২৩টি, সংসদীয় আসন; ৭০ টি।চট্টগ্রাম বিভাগঃপাহাড় সমুদ্র নদী সমতল বেষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র উপকূলের অনুপম সৌন্দর্যের আধার চট্টগ্রাম বিভাগ। বিভাগের দক্ষিণে দিগন্ত বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের মানচিত্রে পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান। সীমানা: উত্তরে ভারতের আগরতলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণ পূর্বে মায়ানমার, পূর্বে ভারতের মিজোরাম,পশ্চিমে ভােলা জেলা, শরীয়তপুর জেলা, মুন্সিগঞ্জ জেলা, নারায়ণগঞ্জ জেলা, নরসিংদী জেলা, কিশােরগঞ্জ জেলা, হবিগঞ্জ জেলা। আয়তন : ৩৩,৯০৪ বর্গ কিঃ মিঃ, লােকসংখ্যা : ২,৯১,৪৫,০০০ (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী), জেলার সংখ্যা : ১১টি, উপজেলার সংখ্যা : ১০৩টি, সংসদীয় আসন: ৫৮টি খুলনা বিভাগসীমানা: খুলনা বিভাগ এর উত্তরে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা জেলা, দক্ষিণে বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন নামে পরিচিত সুন্দরবন সহ বঙ্গোপসাগরের উপর তটরেখা; পূর্বে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, পিরোজপুর, বরগুনা জেলা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমানা।আয়তন : ২২,২৮৫ বর্গ কিমি , লােকসংখ্যা : ১৫,৫৬৩,০০০ (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী), জেলার সংখ্যা : ১০টি, উপজেলার সংখ্যা : ৫৯টি, সংসদীয় আসন: ৩৬টিসিলেট বিভাগসিলেট বিভাগের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে উঁচু উঁচু পর্বত শ্রেণীর পাহাড়ী অঞ্চল। মূলতঃ মেঘালয়, খাসিয়া, জৈন্তিয়া, ত্রিপুরার পাহাড়ের মাঝামারি বিস্তুর্ণ এলাকাটিই হচ্ছে সিলেট বিভাগ বা প্রাচান শ্রীহট্ট। অভ্যন্তরীন সীমাভূমি বেশির ভাগ সমতল প্রান্তর। স্থানে স্থানে জল ও বালুকাময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিলা রয়েছে। সীমানা : উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, পূর্বে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা। আয়তন : ১২,৫৫৮ বর্গ কি মি জনসংধ্যা :৯৮,০৭,০০০ (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী), জেলার সংখ। : প্টি, উপজেলার সংখ্যা: সংসদীয় আসন; ১৯ টিরাজশাহী বিভাগসীমানা: উত্তরে গাইবান্ধা জেলা, দিনাজপুর জেলা ও পশ্চিমবঙ্গ(ভারত), দক্ষিণে কুষ্টিয়া জেলা ও রাজবাড়ি জেলা, পূর্বে জামালপুর জেলা, টাঙ্গাইল জেলা, মানিকগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ (ভারত)। আয়তন: ১৮১৫৪ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা: ১.৮৪.৮৫.০০০, জেলার সংখ্যা: ৮টি , উপজেলা: ৬৭টি,সংসদীয় আসন সংখ্যা ৩৯টিরংপুর বিভাগরংপুর বিভাগ বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত। সীমানা: উত্তরে ভারতের কুচবিহার ও শিলিগুড়ি, দক্ষিণে জয়পুরহাট জেলা ও বগুড়া জেলা, পূর্বে ভারতের আসাম ও মেঘালয়, পশ্চিমে বিহার । আয়তন: ১৬৩৪.৩৭ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা: ১.৫৫,৩৭,৬৭৬, জেলার সংখ্যা ৮টি, উপজেলা: ৫৮টি, সংসদীয় আসন সংখ্যা: ৩৯ টিবরিশাল বিভাগসীমানা: উত্তরে গোপালগঞ্জ জেলা, মাদারীপুর জেলা, শরীয়তপুর জেলা, চাঁদপুর জেলা, দক্ষিণে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর, পূর্বে লক্ষ্মীপুর জেলা, পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা। আয়তন ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা: ৮১,৭৩,৭১৮, জেলার সংখ্যা: ৬টি, উপজেলা: ৪১টি, সংসদীয় আসন সংখ্যাঃ ২১টি ময়মনসিংহ বিভাগ। সীমানা; উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে টাঙ্গাইল জেলা, গাজীপুর জেলা, কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে গাইবান্ধা জেলা, বগুড়া জলা ও সিরাজগঞ্জ জেলা। আয়তন: ১০,৪৮৫ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা: ১,১৩,৭০,০০০, জেলার সংখ্যা: ৪টি, উপজেলা: ৩৫টি, সংসদীয় আসন সংখ্যা: ২৪টি

3Oct2020

অধ্যায়-৬: বাংলাদেশের ইতিহাস

আলোচ্য বিষয়:

১. প্রাচীন যুগের বাংলার ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করুন।

প্রাচীন যুগের বাংলার ইতিহাস:

প্রাচীন যুগের পাল রাজাদের শাসনকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এর আগের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। এ সময়কালে কোনাে শাসক দীর্ঘদিন সমগ্র বাংলা জুড়ে শাসন করতে পারেননি। তাই বিচ্ছিন্নভাবেই বাংলার রাজনৈতিক জীবনের বিকাশ ঘটেছে। মৌর্য ও গুপ্ত শাসনের অবসানের পর এক অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরই মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে কিছু স্বাধীন রাজ্যের। স্বাধীন রাজ্য উত্থানের যুগে উত্তর বাংলার রাজা শশাংক ছিলেন। বচেয়ে শাক্তিমান। তাঁর মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল বাংলায় কোন যােগ্য শাসক ছিলেন না। ফলে রাজ্য জুড়ে অরাজকর্তা ও বিশৃখেলা দেখা দেয়। প্রায় প্কশত বছর এ অবস্থার মধ্যে কাটে। অতঃপর গােপাল নামে এক নেতা এ অরাজক অবস্থার অবসান ঘটান এবং পাল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। বারাে শতকের মাঝামাঝি পাল বংশের পতন ঘটে। পাল শাসন যুগেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠে। এরপর দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট থেকে আগত সেন বংশ পর্ব বাংলায় রাজ্য স্থাপন করে। দীর্ঘকাল বাংলায় সেন শাসন অব্যাহত ছিল। তের শতকের প্রথম দশকে মুসলমান শক্তির হাতে সেন রাজত্বের অবসান ঘটে।

মৌর্য ও গুপ্তযুগে বাংলা :

খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭-২৬ অব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় হতে এ যুগের প্রকৃত ইতিহাসের রূপ পরিগ্রহ করে। আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের মাত্র দুই বছর পর ৩২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাট চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য ভারতের এক বিশাল অঞ্চলের উপর মৌর্য বংশের প্রভূত স্থাপন করেন। উত্তর বাংলায় মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট অশােকের রাজত্বকালে (২৬৯-২৩২ খ্রিঃ পূঃ)। অঞ্চলের মৌর্যদের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। প্রাচীন পুন্ড্রনগর ছিল এ প্রদেশের রাজধানী। উত্তরবঙ্গ ছাড়াও মৌর্য শাসন কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ), তাম্রলিপ্ত (হুগলী) ও সমতট (দক্ষিণ-পূর্ববাংলা) অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর শুঙ্গ ও পরে কম্ব বংশের আবির্ভাব ঘটে। এরপর বেশকটি বিদেশি শক্তি ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। এদের মধ্যে গ্রীক, শক, পুতুব, কুষাণ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় ৩২০ খ্রিস্টাব্দে ।

 গুপ্ত পরবর্তী বাংলা ও স্বাধীন বঙ্গরাজ্য :

বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সারা উত্তর ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব হয়। এভাবে গুপ্তদের পর সমগ্র উত্তর ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। সে সুযােগে বাংলাদেশে দুটি স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এর একটি হলাে বঙ্গ। এর অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ববাংলা ও পশ্চিম-বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে । দ্বিতীয় রাজ্যের নাম গৌড়। এর অবস্থান ছিল বাংলার পশ্চিম ও উত্তর বাংলা নিয়ে। স্বাধীন গৌড়রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ছয় শতকে ‘পরবর্তী গুপ্তবংশ বলে পরিচিত গুপ্ত উপাধিধারী রাজাগণ উত্তর বাংলা, পশ্চিম বাংলার উত্তরাংশ ও মগধে ক্ষমতাবিস্তার করেছিলেন। ছয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ অঞ্চলই গৌড় জনপদ নামে পরিচিতি লাভ করে।

মাৎস্যন্যায় ও পাল বংশ :

শশাংকের মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে এক দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকারময় যুগের সূচনা হয়। দীর্ঘদিন বাংলায় কোন যােগ্য শাসক ছিলেন না। ফলে, রাজ্যে বিশৃখৈলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। এ অরাজকতার সময়কালকে পাল তাম্রশাসনে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘মাৎস্যন্যায় বলে। পুকুরে বড় মাছ ছােট মাছকে ধরে গিলে ফেলার মতাে বিশৃংখল পরিস্থিতিকে বলে “মাৎসযন্যায়। আট শতকের মাঝমাঝি এ অরাজকতার অবসান ঘটে পাল রাজত্বের উত্থানের মধ্য দিয়ে। গােপালের সিংহাসনে আরােহণের মধ্য দিয়ে বাংলায় পাল রাজত্বের সূচনা হয়। আর বাংলায় পাল বংশের রাজাগণ রাজত্ব করেন চারশত বছর। এই চারশত বৎসরের পাল রাজত্বে অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে একে একে দেবপাল, মহীপাল, রামপাল সফল শাসক হিসেবে রাজত্ব করেন। কিন্তু পরবর্তী শাসকগণ সিংহাসনে আরােহণ করলেও দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পাল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটান বিজয় সেন। বাংলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে সেন বংশের শাসন।

সেন বংশ :

সেন বংশের রাজত্বকাল তেরাে শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। বিজয় সেনের সুদীর্ঘকাল রাজত্বের পর সিংহাসনে বসেন তাঁরই পুত্র বল্ল সেন। বৃদ্ধ বয়সে পুত্র লক্ষণ সেনের হাতে রাজ্যের শাসনভার ন্যস্ত করে সস্ত্রীক গঙ্গাতীরে বাণপ্রস্থ অবলম্বন করে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। লক্ষণ সেনের রাজত্বকালের প্রথম দিক ভালভাবে চললেও শেষ জীবন খুব সুখের ছিল না। তিনি শৈব ধর্মের প্রতি অনুরাগ ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। শেষ বয়সে তিনিও পিতার মত গঙ্গাতীরে নবদ্বীপে বসবাস শুরু করেন। তাঁর শাসনের দুর্বলতার সুযােগে বখতিয়ার খলজি নদিয়া আক্রমণ করে খুবসহজেই তা দখল করে নেন। অবসান ঘটে সেন বংশের রাজত্বের।

২. মধ্যযুগের বাংলার মুসলমান শাসকদের ইতিহাস বর্ণনা করুন ।

 মধ্যযুগের বাংলা (১২০৪ খ্রিঃ-১৭৫৭ খ্রিঃ) :

 বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনাকালকে বাংলায় মধ্যযুগের বু বলা হয়। মুসলমানদের বঙ্গ বিজয়ের ফলে বঙ্গের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্পকলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদেশবাসীর জীবনেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। বাংলায় মধ্যযুগের ইতিহাস ১২০৪ খ্রি. থেকে শুরু হয়ে ১৭৫৭খ্রি.পর্যন্ত বিস্তৃত।

মধ্যযুগের সূচনা :

 তেরাে শতকের শুরুতে তুর্কী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন, যা মধ্যযুগের সূচনাকাল হিসেবে বিবেচিত। ইতিহাসে তিনি বখতিয়ার খলজি নামেই বেশি পরিচিত। তার বংশ পরিচয় সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা না গেলেও তিনি ছিলেন খলজি বংশের একজন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক এবং জাতিতে তুর্কী। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির হাত ধরে বাংলায় মুসলমান শাসন সূচিত হয়ে বিভিন্ন শাসনকর্তা কর্তৃক প্রথম পর্যায় শাসিত হয় ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ যুগের শাসনকর্তাদের পুরােপুরি স্বাধীন বলা যাবে না। এদের কেউ ছিলেন বখতিয়ার খলজির সহযোদ্ধা খলজী মালিক। আবার কেউ কেউ তুর্কী বংশের শাসক। শাসকদের সকলেই দিল্লির সুলতানদের অধীনে বাংলার শাসনকর্তা হয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে অনেক শাসনকর্তাই দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হতে চেয়েছেন। কিন্তু দিল্লির আক্রমণের মুখে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মুসলিম শাসনের এ যুগ ছিল বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ।

বাংলায় স্বাধীন সুলতানী শাসনের ইতিহাস :

দিল্লীর সুলতানগণ ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুইশত বছর বাংলাকে তাঁদের অধিকারে রাখতে পারেননি। প্রথম দিকে দিল্লীর সুলতানের সৈন্যবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। চেষ্টা করেছে বাংলাকে নিজের অধিকারে আনার জন্য। অবশেষে সফল হতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এ সময়ে বাইরের অন্য কোনাে আক্রমণেরও তেমন সম্ভাবনা ছিলনা। তাই বাংলার সুলতানগণ স্বাধীনভাবে এবং নিশ্চিন্তে এদেশ শাসন করতে পেরেছেন। ফখবুদ্দিন মুবারক শাহের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের হাতে বাংলা প্রথম স্থিতিশীলতা লাভ করে। ১৩৩৮ খ্রি. থেকে ১৫৩৮ খ্রি. সময়কাল তাই স্বাধীন সুলতানী আমল হিসেবে পরিচিত।

আফগান শাসন ও বারভূঁইয়া (১৫৩৮ খ্রিঃ- ১৫৭৬ খ্রিঃ) :

১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের অবসান হলে একে একে বিদেশি শক্তিসমূহ গ্রাস করতে থাকে বাংলাকে। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন অল্প কিছুকাল বাংলার রাজধানীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে আফগান নেতা শের শাহের কাছে পরাজয় মানতে হয়। বাংলা ও বিহার সরাসরি চলে আসে আফগানদের হাতে। আফগানদের দুই শাখা-শূর আফগান ও কররাণী আফগানরা বেশ কিছুকাল বাংলা শাসন করে। শেষ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আকবরের আফগানদের হাত থেকে বাংলার ক্ষমতা কেড়ে নেন। আর আফগান শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৫৭৬ খ্রি. মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়। রাজধানী দখল করলেও মুঘলরা বাংলার অভ্যন্তরে অনেকদিন পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এ সময় বাংলায় অনেক বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় (বিষয়ের জ্ঞান-১ম অংশ) বড় বড় স্বাধীন জমিদার ছিলেন। ‘বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত এ সমস্ত স্বাধীন জমিদার মুঘলদের কারঅধি মেনে নেননি। আকবরের সময় মুঘল সুবাদার গণ ‘বার ভূঁইয়াদের দমন করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। বার ভূঁইয়াদের দমন করা হয়।সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে।

মুঘল শাসন (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিঃ) :

সুবাদারি ও নবাবি এ দুই পর্বে বাংলায় মুঘল শাসন অতিবাহিত হয়। বার ভূঁইয়াদের দমনের পুর সমগ্র বাংলায় সুবাদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল প্রদেশগুলো ‘সুবা’ নামে পরিচিত ছিল। বাংলা ছিল মুঘলদের অন্যতম সুবা। সতের শতকের প্রথম দিক থেকে আঠার শতকের শুরু পর্যন্ত ছিল সুবাদারী শাসনের স্বর্ণযুগ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পর দিল্লীর দুর্বল। উত্তরাধিকারীদের সময়ে মুঘল শাসন শক্তিহীন হয়ে পড়ে। এ সুযোগে বাংলার সুবাদারগণ প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। মুঘল আমলের এই যুগ ‘নবাবী আমল’ নামে পরিচিত। মুঘল সম্রাটের অনুমােদনে নয়, বাহুবলে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন আলীবর্দী খান। আলীবর্দী শাসনকালে (১৭৪০-১৭৫৬ খ্রি:) বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আলীবর্দী খান তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমেনী। গমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন। অসহায়ভাবে পরাজয় ঘটে সিরাজউদ্দৌলার। এভাবেই পলাশীর। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ শাসনেরভিত্তি স্থাপিত হয়। আর একই সাথে বাংলার মধ্য যুগেরও অবসান ঘটে।

৩. মধ্যযুগে বাংলার আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার বিবরণ দিন।

মধ্যযুগে বাংলার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা :

মধ্যযগে বাংলার আর্থ-সমাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে এ সময়েরশাসকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ সময়ে বাংলার সমাজ জীবনে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মেরই প্রভাবদ্যিমান ছিল বলা যায়, এ দুটো ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল বাংলার সামাজিক রীতি-নীতি। এ সময়ে মুসলমান সমাজে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন এ তিন ধরনের শ্রেণির অস্তিত্ব যেমন বিদ্যমান ছিল তেমনি হিন্দু সমাজেও বর্ণ প্রথা কঠোরভাবে প্রতিপালিত হতাে। উভয় ধর্মাবলম্বীরা তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয় উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন। মধ্যযুগে বাংলার অর্থনৈতিক ও ব্যবসা বাণিজ্য সমাজ পরিবর্তনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছে। অর্থনতিক সমৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি ছিল বাংলার কৃষি ও কৃষিজ উৎপাদন। বস্ত্র ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের অগ্রগতি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বাংলার রপ্তানি পণ্যের  মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল স্মৃতি কাপড়, মসলিন, রেশমী বস্ত্র, চাউল, চিনি, গুড়, আদা, লঙ্কা ইত্যাদি। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে চাউল, তামাক, সুপারি, পাট, ফল ইত্যাদি রপ্তানি হতাে। মধ্যযুগে বাংলার স্থাপত্য নিদর্শন এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। এসব দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের মধ্যে প্রাসাদ ও মসজিদ উল্লেখযােগ্য। যেমন- সোনা মসজিদ, ষাট গম্বুজ মসজিদ, লালবাগ দুর্গ, বড় কাটরা, ছােট কাটরা। মধ্যযুগে বিশেষ করে সুলতানী ও মুঘল শাসনকালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। এ সময়ে বহু আরবি ও ফার্সি শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়। মুসলমান ও হিন্দু কবিদের কাব্যচর্চার নিদর্শন ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’, জয়নুদ্দীনের ‘রসূল বিজয়, কবি মােজাম্মেলের সাতনামা’, ‘নীতিশাস্ত্রবার্তা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এ যুগে বিখ্যাত কবি লেখকগণের মধ্যে রূপ গােস্বামী, সনাতন গােস্বামী, মালাধর বসু, বিজয়গুপ্ত উল্লেখযােগ্য ছিলেন। বৈষ্ণব কবি বৃন্দাবন দাসের অমর রচনা চৈতন্য-ভগবত এবং চন্দ্রাবতীর ‘মনসা মঙ্গল’ বাংলা ভাষার অনন্য নিদর্শন।

৪. পলাশী যুদ্ধের পটভূমি কী ছিল? ইংরেজ শাসনামলে প্রতিরােধ ও স্বাধিকার আন্দোলনে বাংলার জনগণের ভূমিকা বর্ণনা করুন।

পলাশী যুদ্ধ ও বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনা :

১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আলীবর্দী খান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার। নবাব ছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি সফলভাবে বাজা শাসন করেছেন। তিনি তাঁর সময়ে মারাঠা ও বর্গীদের দমন করে রাখতে সফল হন। সুকৌশলে ইংরেজ বণিক কোম্পানিকেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর বাংলার রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নবাব মৃত্যুর আগে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার সিংহাসনের উত্তরাধিকার মনােনীত করে যান। ১৭৫৬ খ্রিঃ আলীবর্দী খানের মৃত্যু হলে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা ২২ বছর বয়সে নবাবের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সিংহাসনে বসার পর থেকে তাকে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও সমস্যার মােকাবেলা করতে হয়।

তাঁর প্রথম সমস্যা ছিল তাঁর পরিবারে ঘনিষ্ঠজনদের ষড়যন্ত্র। বিশেষ করে আলীবর্দী খানের তিন কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম সিরাজের নবাব হওয়ায় আশাহত হয়ে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এদের সঙ্গে যােগ দেন ঘসেটি বেগমের দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, পুর্নিয়ার শাসনকর্তা সিরাজের খালাতো ভাই শওকত জঙ্গ। কৌশলে নবাবের ঘসেটি বেগমকে নজরবন্দী করেন। পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ বিদ্রোহী হয়ে উঠলে সিরাজউদ্দৌলা এক যুদ্ধে তাকে পরাজিত ও নিহত করে পূর্ণিয়া দখল করে নেন। নবাব পারিবারিক ষড়যন্ত্র কৌশলে দমন করলেও তার বিরুদ্ধে বাইরে ষড়যন্ত্রের আরেক জাল বিস্তৃত হতে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত হয় দেশি বিদেশি বণিক শ্রেণি, নবাবের দরবারের প্রভাবশালী রাজণ্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণি, নবাবের সেনাপতি মীর জাফরসহ আরাে অনেকে। প্রত্যেকে যার যার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করতে থাকে।

রবার্ট ক্লাইভ সন্ধি ভঙ্গের অজুহাতে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। ১৭৫৭ খ্রি. ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে সংঘটিত হয় যুদ্ধ। নবাবের পক্ষে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যান দেশপ্রেমিক মীরমদন, মােহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিন ফ্রে। যুদ্ধে মীরমদন নিহত হন। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফরের চরম ঞঅসহযােগিতা এবং মীর মদনের মৃত্যু নবাবকে বিচলিত করে। নবাবের সৈন্যরা যখন বিশ্রামরত ঠিক সে মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের ইঙ্গিতে ইংরেজ সৈন্যরা নবাবের সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। যার অনিবার্য পরিণতি নবাবের পরাজয়। এর মধ্য দিয়েই ভাগীরথীর তীরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়।

ইংরেজ শাসনামলে প্রতিরােধ ও স্বাধিকার আন্দোলন : 

বাঙালিরা কখনই বিদেশি ইংরেজ শাসকদের মেনে নেয়নি। ইংরেজ শাসনামলের আঠারাে ও উনিশ শতক জুড়ে বাংলায় আর্থ-সামাজিক রাজনীতিতে বইতে থাকে পরিবর্তনের হাওয়া। এ পরিবর্তনের সূচনা করে বাংলার কৃষক ও সাধারণ মানুষ। একদিকে মুসলিমসমাজে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত, অন্যদিকে হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি, কুসংস্কার দূর করে হিন্দু ধর্মেও সংস্কার এ দেশের সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করতে থাকে, আর নিজেদের শিক্ষিত ও যুগােপযােগী করে গড়ে তুলে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। ব্রিটিশ বিরােধী এ প্রতিরােধ আন্দোলন নানাভাবে নানাজনের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিরােধ আন্দোলনগুলাের মধ্যে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন, তিতুমীরের সংগ্রাম, নীল বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযােগ্য। এসমস্ত প্রতিরােধ আন্দোলন এবং বাংলায় নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন বাংলার মানুষকে স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলায় এ গণজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের পুরােধা ব্যক্তিগণ হলেন- রাজা রামমােহন রায়, ডিরােজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মুহম্মদ মহসীন, নওয়াব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী এবং নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রােকেয়া। পরাধীনতার একশ বছর পর স্বাধীনতা ঘোষণা করে এদেশের সৈনিকরা ও দেশীয় রাজরাজরা। পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝঁপিয়ে পড়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ সমাজ। বাঙালি তরুণ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দলে দলে আত্মাহুতি দিয়ে কাপিয়ে তােলে ইংরেজ শাসনের ভিত। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে গৌরবময় ভূমিকা ছিল বাঙালিদের।

৫.  বায়ান্নর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পটভূমি এবং তার কিন্তার বর্ণনা করুন।

অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ঐতিহাসিক “ভাষা আন্দোলন প্রেক্ষাপট ও বিস্তার ব্যাখ্যা করুন।

ভূমিকা :

 ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের বাঞ্চালি জাতি স্বাধীন সত্তার মৌলিক চেতন।।এর মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতা  আন্দোলন জোরদার হয়। এর প্রভাব নাে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর।

ভাষা আন্দোলন  :

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি েিনর শতকরা ৫৬ জনের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। উর্দু পাকিস্তানের কোনাে অদ্লেরই মাতৃভাষা ছিল না। এ ভাষায় পাকিস্তানের মাত্র ৭.২% লাখ কথা বলতে। সাধারণত অধিকাংশ নাগরিকের মাতৃভাষাই যে কোনাে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। কিন্তু তা করে পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। পূর্ব বাংলার জনগণ এর বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে যা ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমিঃ

 ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে প্রথম উর্দুকে পাকিস্তানের বাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা। হয়। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সকল মহলে ঔীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে ‘ব্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও অফিস আদালতের ভাা করার দাবি ছিল এ সংগ্রাম পরিষনের প্রধান উদ্দেশ্য। সেই সাথে বাংলা ও উর্দু দুটিতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ছিল। পরিষদের সদস্য বীরেন্দ্রনাথ দত্ত (মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্ত বাহিনীর হাতে শহিদ) ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের (আইন সভা) প্রথম অধিবেশনের উর্দু ও ইংরেজি পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি পেশ করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিম উদ্দিনসহ মুসলিম লীগ নেতারা এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ অন্যান্য কলেজ ও বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্মঘট পালন করে। ঢাকা রাষ্ট্র গঠনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘােষণার দাবি জানানাে হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে চলতে থাকে আরাে অন্যান্য কর্মসূচি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং করার সময় পুলিশ শেখ মুজিবুর রহমানসহ ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার করে।

ভাষা আন্দোলনের বিস্তারঃ

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন। ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন, “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনের জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা না, না’ বলে জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকে। ঢাকায় অবস্থানকালে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছাত্রদের সাথে ভাষা ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে একাধিকবার আলােচনা করেন। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে তিনি কোনাে আপস করতে রাজি হননি। ফলে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার আন্দোলন ধীরে সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।

একইভাবে ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বলে জাতীয় পরিষদে ঘােষণা করেন। পূর্ব বাংলার জনগণ এর প্রতিবাদে প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফলে জাতীয় পরিষদে ভাষার প্রশ্ন বিষয়ে আলােচনা স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে নিহত হওয়ার পর খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনিও জিন্নাহর অনুসরণে ঘােষণা করেন উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। এই ঘােষণায় পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা চরম ক্ষুব্ধ হয়; এবং শুরু হয় দেশব্যাপী হরতাল, ধর্মঘট ও ছাত্র বিক্ষোভ। ভাষা আন্দোলনকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ও রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ টিকবে না উদ্দেশ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল, সভা ও শােভাযাত্রার ডাক দেয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচিতে সরকার বিচলিত হয়ে পড়ে এবং ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। মিছিল ও জন সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয় ফলে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদের সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই দিনে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকেও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাের হতেই ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে (ঢাকা মেডিকের কলেজ সংলগ্ন) অসংখ্য পুলিশ মােতায়েন দেখে ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ছাত্ররা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগানে প্রাদেশিক পরিষদের সভা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে উত্তেজনার এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের উপর কাঁদানে গ্যাস ও মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে রফিক ও জব্বার তাৎক্ষণিক শহিদ হন। আহত হয়ে পরে শহিদ হন সালাম। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশি নির্যাতনের ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

উপসংহারঃ

২২ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে শহিদদের গায়েবি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এই জানাজায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অংশগ্রহণ করে। ছাত্র-জনতা মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণের চেষ্টা করে। এ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে শফিউর রহমান শহীদ হন । ছাত্র ঘটনাস্থলে ‘শহিদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে একটি শহিদ স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনার তৈরি করা হয় এবং শহিদ শফিউরের পিতা এ শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন শুধু ঢাকা নয় ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার সর্বত্র ।

৬. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক, বেসমারিক বাহিনী ও যৌথ বাহিনী ভূমিকা বর্ণনা করুন।

ভূমিকাঃ

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সােপান। দীর্ঘ নয় মাস আমরা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশের অর্জন করেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সামরিক, বেসামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। যা কোন দিন ভুলবার নয় ।

যুদ্ধে সামরিক, বেসামরিক বাহিনী ও যৌথ বাহিনীর ভূমিকা :

মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর-এর বাঙালি সদস্য, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, যুবক, নারী, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী নিয়ে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।

মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। অনেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এভাবেই প্রাথমিক প্রতিরােধ যুদ্ধ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধে সামরিক-সােমরিক নির্বিশেষে দেশের জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেছে। এদের সমন্বয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বেশ কিছু বাহিনী যেমন, নিয়মিত সেনা ব্যাটেলিয়ন, সেক্টর ট্রপস, গণবাহিনী, বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট ও বিভিন্ন আঞ্চলিক বাহিনী গড়ে উঠেছিল। তারা বিভিন্নভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়।

মুক্তিযুদ্ধ কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য সারা বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর ও বিভিন্ন সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। গঠন করা হয় তিনিট ব্রিগেড ফোর্স। এগুলাে হলাে ‘জেড ফোর্স’, এস ফোর্স এবং কে ফোর্স। মেজর জিয়াউর রহমান ‘জেড ফোর্স, মেজর কে.এম, শফিউল্লাহ ‘এস ফোর্স’ এবং মেজর খালেদ মােশাররফ কে ফোস এর অধিনায়ক ছিলেন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স গঠিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত পূর্ব বাংলার অফিসার, সৈনিক, পুলিশ, ইপিআর, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যগণ এসব বাহিনীর গঠন ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া গেরিলা ও সাধারণ যােদ্ধারা এতে অংশগ্রহণ করে। এরা সকলে মুক্তিবাহিনী বা মুক্তিফৌজ হিসেবে পরিচিতি।দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা নিজ নিজ উদ্যোগে বেশ কিছু বাহিনী গড়ে তােলে। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে তারাও দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী স্থল, জল ও আকাশ পথে আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এ ছাড়া গ্রাম ও শহরের অনেকে এককভাবে কমিটি গঠন করে মুক্তিবাহিনীর থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ও যুদ্ধ পরিচালনায় সাহায্য করে।মুক্তিবাহিনীর থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ও যুদ্ধ পরিচালনায় সাহায্য করে। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর বিশেষ অবদান ছিল। তারা গােপনে ও আকস্মিকভাবে শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করত। তারা পূর্ব পরিকল্পনামত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অতর্কিত আক্রমণের পর নিরাপদ স্থানে আত্মগােপন করত। অনেক সময় সম্মুখ যুদ্ধেও তারা বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ শেষের দিকে প্রবল আকার ধারণ করে। ফলে তাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। দেশের ভিতরে ও বাহিরে গড়ে ওঠা অন্যান্য বাহিনীও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রত্যেক সদস্য অকৃত্রিম দেশপ্রেমের নজীর রেখেছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী ছাড়া দেশপ্রেমিক সকল মানুষ ছিলেন তখন মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি জনপদে মুক্তিকামী নিঃস্বার্থ সাহায্য সহযোগিতা লাভ করে মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। অনেকে শহিদ হয়েছেন, অনেকে পঙ্গু হয়েছেন। অনেক মুক্তিযােদ্ধা এখনও বেঁচে আছেন। আমরা সকল মুক্তিযােদ্ধাকে সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রদান করে।

এছাড়া ন্যাপ (মােজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী), কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি সংগঠন এবং সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতা করেছেন জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, ইসলামী ছাত্র সংঘ ইত্যাদি সংগঠন। তাছাড়া তারা আল বদর বাহিনী ও আল শামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযােগিতা করে এবং মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থীহিসেবে আশ্রয় নেয়। সে দেশের সরকার ও জনগণ তাদের থাকার ব্যবস্থা করে। ভরণপােষণসহ ভারত সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, এক পর্যায়ে সামরিক শক্তি দিয়েও সহযােগিতা করে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী নিয়ে যৌথকমান্ড গঠিত ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ঘােষণা করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারত ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ৭ ডিসেম্বর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা শুরু হয় ।

বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ কমান্ড পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর ওপর শাণিত আক্রমণ পরিচালনা করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিসমূহ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সাবেক সােভিয়েত রাশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগােষ্ঠী বাংলাদেশের শােষিত মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়ালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

উপসংহারঃ

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভােম রাষ্র হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। এর মাধ্যমে পেয়েছি আমরা একটি স্বাধীন দেশ, রাষ্ট্র, লাল সবুজের পতাকা এর মাধ্যমেই বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় একটি নতুন দেশ যার নাম বাংলাদেশ।

৭. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক বাহিনীর ভূমিকা বর্ণনা করুন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক বাহিনীর ভূমিকাঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় বেসামরিক বিভিন্ন আঞ্চলিক বাহিনী গাড় উঠেছিল। তারা বিভিন্নভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ ঢালায়। এছাড়াও দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র জনতা নিজ নিজ উদ্যোগে বেশ কিছু বাহিনী গড়ে তােলে । ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে তারাও দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম ও শহরের অনেকে এককভাবে কমিটি গঠন করে মুক্তি বাহিনীর থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ও যুদ্ধ পরিচালনায় সাহায্য করে। দেশের ভিতরে ও বাহিরে গড়ে ওঠে অন্যান্য বেসামরিক বাহিনীও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপর্ণ অবদান রাখে। দেশের বিভিন্ন সংগঠন এবং সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

৮. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রের অবদান উল্লেখ করুন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রের অবদান/ভূমিকাঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ করে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। প্রায় এক কোটি শরণার্থীদের থাকা ও ভরণপােষণের ব্যবস্থা করে। এক পর্যায়ে সামরিক শক্তি দিয়েও বাংলাদেশকে সহায়তা করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভুটান প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বহির্বিশ্বের প্রাক্তন সােভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র দেশসমূহ, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং পশ্চিমের অনেক রাষ্ট্র ও জনগণ – বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ও বিরুদ্ধাচারী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলাে ডিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যা তাদের কাছে সমর্থনযােগ্য ছিলনা। অন্য রাষ্ট্রের বিশিষ্ট নাগরিক ও মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রাখে।

৯. আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করুন।

মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য:

যে জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অলয়া হয়েছে তার ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতির জতি ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটো রা্ট্রের জন্ম ভাষা ছিল সেটা ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসমূহ ও ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠী না বুঝলেও বাঙালি জাতি তার সংগ্রামী মনোভাব ও চেতনা দ্বারা    বিশ্ববাসীকে এটা বােঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে পরাধীনতার শঙ্লে থাকার অর্থ হল একটি জাতিগোষ্ঠীর রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতিকে বির্সজন দেয়া। ফলে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বাক্তালি জাতিগোষ্ঠীর যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার চূড়ান্ত ও ন্যায়সঙ্গত পরিসমাপ্তি হয়েছিল বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে।

১০. বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মাতৃভাষার সংগ্রাম, ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ভূমিকা ব্যাখ্যা করুন।

মাতৃভাষার সংগ্রাম:

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জনের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। উর্দু পাকিস্তানের কোনাে অঞ্চলেরই মাতৃভাষা ছিল না। এ ভাষায় পাকিস্ত নের মাত্র ৭.২% লােক কথা বলত। সাধারণত অধিকাংশ নাগরিকের মাতভাষাই যে কোনাে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। কিন্তু তা না করে পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। পূর্ব বাংলার জনগণ এর বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে যা ভাষা আন্দোলন বা মাতৃভাষার সংগ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীকার আন্দোলন। এটি আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সূচনাপর্ব। মাতৃভাষা রক্ষার দাবীতে বাঙালি জাতি সেদিন সােচ্চার হয়েছিল। এর মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদূর চেতনা জাগ্রত হয়। ছাত্র-জনতার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সাফল্য লাভ করে। যার ফলে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি গণপরিষদে উত্থাপন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘােষণা করে। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত একুশের গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি” বাঙালির শােক সঙ্গীত ও প্রেরণার উৎস হয়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বি-জাতিত্ত’-কে অসার প্রমাণ করে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবােধের উন্মেষ ঘটে। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হতে থাকে।

ছয় দফা আন্দোলনঃ

ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে এদেশের মানুষ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলে। এটি ছিল পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সনদ। এটিই পরবর্তীতে মুক্তি সনদ হিসেবে পরিগণিত হয়। আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচি দিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান  কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে ছয় দফা কর্মসূচি ছিল তীব্র প্রতিবাদ আর বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সনদ বা মুক্তির সনদ।

নিচে ছয় দফার দাবিসমূহ উল্লেখ করা হলো:

১. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান একটি সত্যিকারের ফেডারেশনরূপে (যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র) গড়ে তুলতে হবে। এতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকবে যেখানে সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভােটে অনুষ্ঠিত হবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে।

২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধুমাত্র দুটি বিষয় থাকবে-প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় বিষয়। অন্যান্য সকল বিষয়ে স্টেটস সমূহের (প্রদেশসমুহ) পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

৩. দেশের দুই অংশের জন্য দুটি পৃথক ও সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রা থাকবে; এবং মুদ্রার পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের ওপর। অথবা একই মুদ্রা থাকবে, তবে যাতে এক অঞ্চলের মুদ্রা অন্য অঞ্চলে সহজে পাচার না হতে পারে সেজন্য একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে দুই অঞ্চলের মধ্যে দুটি আলাদা আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

8. প্রাদেশিক সরকার রাজস্ব নীতি প্রণয়ন, কর ধার্য ও আদায় ক্ষমতা পাবে। তবে দেশরক্ষা ও প্রতিরক্ষা ব্যয় বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ। অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদান করবে।

৫. দুই প্রদেশের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব রাখতে হবে এবং অর্থের ওপর স্ব স্ব আঞ্চলিক সরকারের এখতিয়ার থাকবে। সংবিধানে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে মুদ্রা সরবরাহ করবে।

৬. প্রদেশগুলােকে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তােলার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে এদেশের মানুষ নিজেদের স্বাধিকার আন্দোলনকে জোরদার করে তােলে। যা পরবর্তীতে বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ছয় দফা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান :

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে এদেশের ছাত্র সমাজ সতिয় ভূমিকা পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নেতৃত্বে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। যারা এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে ১১ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে তার বাস্তবায়নের আন্দোলন সংগ্রাম করে।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের যে কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে প্রণীত ১১ দফার মধ্যে তাদের সমন্বিত কর্মকৌশল ও নীতির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ এর নেতৃত্বে গঠিত’ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'(student Action committee–SAC) আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। এই সর্বদলীয় ছাত্র সংসদ পরিষদ ১৯৬৯ সালের ৫জানুয়ারি 11 দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ছয় দফা অন্ধভক্ত করা হয়।

১১ দফার মূল বক্তব্য:

১) শিক্ষার সমস্যাবলীর সমাধান এবং ব্যাপক প্রসার ঘটানো,

২) প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা,

৩) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পুন্য স্বায়ত্তশাসন,

৪) পশ্চিম পাকিস্তানের শুদ্ধ প্রদেশ গুলোর জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও তাদেরকে ফেডারেল সরকারের অধীনে আনা,

৫.) ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণ,

৬) কৃষকদের খাজনা-ট্যাক্স হ্রাস করা,

৭) শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও বোনাস নিশ্চিত করা,

৮) পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জনো সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার,

৯) সিয়াটো, সেনকো ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ,

১০) নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার এবং

১১) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামিসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি প্রদান ।

মূলত হাজার ১৯৬৯ সালের ছাত্রসমাজের প্রদত্ত ১১ দফা ছিল গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে।এর মাঝেই তখন সারা দেশের শাসকগোষ্ঠীর শাসনকার্যের পটপরিবর্তন হয় । আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন আরও বেশি জোরদার হয়। সবার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় জাগে। এই আন্দোলন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে।

১১. ছয়-দফা কর্মসূচিকে কেন বাঙালির স্বাধীকার আদায়ের সনদ বলা হয়? ব্যাখ্যা করুন।

বঙ্গবন্ধুর ছয়-দফা এ অঞ্চলের জনগােষ্ঠীর নিকট ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তির সনদ রূপে পরিগণিত হয়। ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে এদেশের মানুষ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলে। এটি ছিল পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সনদ। এটিই পরবর্তীতে মুক্তি সনদ হিসেবে পরিগণিত হয়। আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচি দিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণের বিরুদ্ধে ছয় দফা কর্মসূচি ছিল তীব্র প্রতিবাদ আর বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সনদ বা মুক্তির সনদ।

১২. ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মাইল ফলক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলাে ইতিহাস উপস্থাপন করে এ উক্তি যথার্থতা বিশ্লেষণ করুন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মার্চ মাস ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল একটি মাস। তৎকালী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ১৯৭১ তারিখে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। তার পূর্বে তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠক করে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অভিহিত করেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকারের এ উদ্যোগ না মেনে ষড়যন্ত্রের নতুন খেলায় মেতে ওঠেন। তিনি ঢাকায় আসতে এবং ৩ মার্চ আহত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদান করতে অস্বীকৃতি জানান। ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে যােগদান করে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। এ ঘােষণা জনগণের চলমান আন্দোলনকে গণবিস্ফোরণের দিকে ঠেলে দেয়। সম়্। দেশের জনগণ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানান। অতঃপর তিনি একে একে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘােষণা করে আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯৭১ সালের ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান কর হয়। এছাড়া তিনি ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভা অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা হরতাল বানচাল করার লক্ষ্যে ঢাকায় কারফিউ জারি করে কিন্তু স্বাধীনতার নেশায় বিস্ফোরন্মুখ  জনগণের আন্দোলন এতটুকু স্তিমিত করতে পারেনি। ২ মার্চ কলাভবনের এক বিশাল ছাত্রসভায় বাংলাদেশ স্বাধীন করার শপথ গ্রহণ করা হয় এবং সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু সারা দেশে অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন। অন্যদিকে ১০ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সংকট ও অচলাবস্থা নিরসনের জন্য ঢাকায় নেতৃবৃন্দের এক গােলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কিন্তুহত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন চালু করার জন্য ৩৫টি বিধি জারি করেন। কার্যত দেশ পরিচালিত হতে থাকে উল্লিখিত বিধি দ্বারা। এ দিনই ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন এবং আলােচনার নামে ১০ দিন সময় অতিবাহিত করেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্রে যুক্ত হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। আলােচনার নামে প্রহসনের মাধ্যমে মূলত সামরিক বাহিনীকে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলীর এই অসৎ উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু ও জনগণ বুঝতে পারেন। আলােচনা ব্যর্থ হয় এবং ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ রাতে গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। 

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মাইলফলক-উক্তির যথার্থতাঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭ মার্চের জনসভা এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হয়। যেকোনাে বিচারেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর রাজনৈতিক বক্তৃতায় অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসাবে গুরুত্ব পেয়েছে। দেশ তখন এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে তিবাহিত হচ্ছিল। ইতােমধ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রকাশ্যে স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছে এবং জনগণও মানসিকভাবে স্বাধীনতার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তখন সকলের দৃষ্টি বঙ্গবন্ধুর দিকে তিনি কী বলেন। ৭ মার্চ রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঐদিন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ত থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় সারা দেশে অসহযােগ ও প্রতিরােধ আন্দোলন শুরু হয়। এ বক্তৃতায় বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়। স্বাধীনতার কৌশলী ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৩. মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় উপাধি গুলো উল্লেখ করুন।

মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় উপাধি:

বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কতকগুলো বীরত্বসূচক রাষ্ট্রীয় উপাধি প্রদান করেছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরত্বসূচক খেতাবের জন্য নির্বাচন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ পূর্বের ৪৩ জনসহ মোট ৫৪৬ জন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবের জন্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ইউনিট, সেক্টর, ব্রিগেড থেকে পাওয়া খেতাবের জন্য সুপারিশসমূহ এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে খন্দকারের নেতৃত্বে একটি কমিটি দ্বারা নিরীক্ষা করা হয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খেতাব তালিকায় স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর পূর্বে নির্বাচিত সকল মুক্তিযোদ্ধার নামসহ মোট ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ৪টি ক্যাটাগরীতে নিম্নোক্ত খেতাব প্রদান করা হয়। সেগুলো হলো:

১) বীরশ্রেষ্ঠ: এই খেতাব প্রাপ্ত মোট ৭ জন। এটি সর্বোচ্চে বীরত্বসূচক পুরস্কার। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।

২) বীর উত্তম: এই খেতাব প্রাপ্ত মোট ৬৮ জন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও ত্যাগের জনা প্রদত এটি দ্বিতীয় বীরত্বসূচক পুরস্কার।

৩) বীর-বিক্রম: এই খেতাব প্রাপ্ত মোট ১৭৫ জন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও ত্যাগের জন্য দেয়া এটি তৃতীয় গীরতুসুচক পুরস্কার।

৪) বীর-প্রতীক: এই খেতাব প্রাপ্ত মোট ৪২৬ জন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও ত্যাগের জন্য এটি চতুর্থ বীরত্বসূচক পুরস্কার।

১৪. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় অর্জনসমূহ কী?

মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি শুধুমাত্র একটি সুন্দই অর্জন করেনি। বরং অর্জন করেছে আরাে অনেক কিছু। আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশের নতুন পতাকা, বাংলা ভাষায় বলা, লেখার অধিকার, একটি সংবিধান, জাতীয় সংগীত, জাতীয় প্রতীকসমূহ, জাতীয় মনােগ্রাম, স্বাধীনতা দিবস, মহান বিজয় দিবস। আমাদের ভাষা বিশ্বের দরবারে পেয়েছে য্যাগ মর্যাদা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এ সব কিছু আমাদের এনে দিয়েঞ্চে জাতীয় মুক্তি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সম্মান। এর ফলেই বিশ্বের বুকে ‘বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ক্রমাগত একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। সের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এসব কিছু অর্জন করেছি তাদের আমরা সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাবো।

১৫. ব্রিটিশ আমলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমূহের মধ্যে সিপাহী বিদ্রোহ কেন গুরুত্বপূর্ণ তা লিখুন।

সিপাহি বিদ্রোহ আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সিপাহি বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসক ভারতবর্ষ শাসনে মৌলিক নীতির পরিবর্তন সাধন করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত শাসনের ক্ষমতা রহিত করে ব্রিটিশ সরকার ভারত সরকার আইন ১৮৫৮’-এর অধীনে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদ্রোহের পরাজয় জাতীয়তাবাদী চেতনার অবদান ঘটায়নি, বরং ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, বালাকোটের বিদ্রোহ এবং সিপাহি বিদ্রোহের মত ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের প্রয়াসগুলাে ব্যর্থতা সনাতন কায়দায় যুদ্ধ করে যে মুক্ত হওয়া যাবে না, সেই বােধই জাগিয়ে তােলে। এরই ধারাবাহিকতায় হিন্দু এবং মুসলমান জনগােষ্ঠীর মাঝে নতুন পর্যায়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে, ভারতবাসীকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা-দর্শন ও বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত করানাের নানা উদ্যোগ গড়ে ওঠে।

১৬. “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোন একক বাহিনীর পরিচালনাধীন যুদ্ধ ছিল না।” – ব্যাখ্যা করুন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের বাঙালিরা অংশগ্রহণ করে। তাই এ যুদ্ধকে গণযুদ্ধ বা জনযুদ্ধও বলা হয়। মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোন একক বাহিনীর পরিচালনাধীন ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ। এতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। প্রবাসে অবস্থানরত বাঙালিরা যুদ্ধে বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক মানুষ পাকিস্তানি গােষ্ঠীর এরূপ নির্মম ও ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং নানা ধরনের সহায়তা প্রদান করেন ।

Ad

error: Content is protected !!