অধ্যায়-০৪: ভাষা দক্ষতার ধারণা ও বিকাশ
সেশন-৪.১: ভাষাদক্ষতা: শোনা
১. শিশুর ভাষা দক্ষতা বিকাশের স্তর কয়টি ও কি কি তা বর্ণনা করুন?
ভাষা একটি আচরণ ।জন্মের পর থেকে শিশুর নানা ধরনের আচরণের প্রকাশ ঘটতে থাকে। শিশুর জীবন বিকাশে কল্পনা, চিন্তন ও ভাষা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ।আর ভাষাই শিশুর কল্পনা ও চিন্তনকে সুস্পষ্ট করে। কেননা শিশু তার কল্পনা ও চিন্তাগুলোকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে। শিশুরা সাধারণত নানা বিষয় নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ ,আলোচনা ,বর্ণনা, যুক্তিতর্ক ভাষার সাহায্যে করে থাকে। ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে শিশু এক স্তর থেকে অন্য স্তরের দিকে ধাবিত হয়। শিশুর ভাষা দক্ষতা বিকাশের স্তর সাতটি নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো:
প্রথম স্তর: শিশুরা প্রথমত স্বরধ্বনি (আ,উ)ও পরে ব্যঞ্জনধ্বনি (দি, দা, মা)উচ্চারণ করে।এই নিছক অর্থহীন শব্দ বা আওয়াজগুলো শিশু পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে আয়ত্ত করে থাকে।
দ্বিতীয় স্তর: শিশু বস্তু বা ব্যক্তির সাথে মিল করে শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। এই উচ্চারণ শিশু অনুকরণের মাধ্যমে করে থেকে।
তৃতীয় স্তর: ভাষা বিকাশের এই স্তরকে শিশুর অর্থবোধক স্তর বলে। এই স্তরে শিশু তার চারদিকে সব বস্তুর নাম বলতে পারে।
চতুর্থ স্তর: শিশু সচেতনতার সাথে ভাষা ব্যবহার করে। সাধারণত শিশুরা কতগুলো এলোমেলো শব্দ ব্যবহার করে মনের ভাব প্রকাশ করে। সম্পূর্ণ বাক্য বলতে পারেনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যের কথা বুঝতে ইশারা-ইঙ্গিতের প্রয়োজন হয়।
পঞ্চম স্তর : শিশু ক্রিয়া ও বিশেষণ পদ ব্যবহার করে সহজ বাক্য বলতে পারে। এক্ষেত্রে কোন প্রকার ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়াই অন্যের কথার অর্থ বুঝতে পারে।
ষষ্ঠ স্তর: শিশু যৌগিক বাক্য ব্যবহার করতে পারে ।কখনও কখনও বিমুর্ত শব্দ যেমন- সামর্থ্য, সাহসী ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে বাক্য বলতে পারে ।
সপ্তম স্তর : শিশু ভাষা পড়তে পারে। তাছাড়াও মনের ভাব লিখে প্রকাশ করতে পারে। এই স্তর থেকেই শিশুর ভাষার বিকাশ ধীরে ধীরে পূর্ণতা লাভ করে। এই স্তর থেকেই মূলত শিশুর ভাষা দক্ষতা অর্জনের পর্যায় শুরু হয়।
২. শোনা বা শ্রবণ কি? শ্রবণ এর বৈশিষ্ট্য প্রকারভেদ এবং গুরুত্ব আলোচনা করুন।
শ্রবণ একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া । এখানে দ্বিমুখীভাবে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে আলাপচারিতা চলে। অর্থাৎ একজন বলেন একজন শুনেন। শ্রবণ আবার একমুখী ও হতে পারে। যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, খবর শোনা ইত্যাদি। এখানে তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ থাকে না ।কেবলমাত্র শোনার সুযোগ পান ।তার বক্তব্যের অপর কোন কিছু বলার বা প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না ।শ্রবণ এর ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পন্থা হলো বক্তার বক্তব্য বাধাগ্রস্ত না করে তাকে বলার সুযোগ দেওয়া। এবং সতর্কতার সাথে বক্তব্য শোনা ।বক্তার বক্তব্যের মাঝে তাকে বিব্রত কিংবা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না ।অর্থাৎ একজন বলবেন অন্যজন শুনবেন। এভাবেই যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এ কারণে বলা হয় একজন ভালো শ্রোতা সাধারণত একজন ভালো বক্তা ।কেননা ভালো করে না শুনলে ভালো করে বলা যায় না । তবে শ্রবণের আসল উদ্দেশ্য হলো শুনে বুঝতে পারা।
শ্রবণ এর বৈশিষ্ট্য :
শ্রবণ এর বৈশিষ্ট্য চারটি । যথা:
১. শ্রবণ একটি গ্রহণমূলক ভাষিক দক্ষতা।
২. শ্রবণ একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া, আবার একমুখীও হতে পারে।
৩.শ্রাবণের সাথে মস্তিষ্ক ও শ্রবণেন্দ্রিয় কর্ণ জড়িত।
৪. একজন ভালো শ্রোতা সাধারণত একজন ভালো বক্তা।
শ্রবণ এর প্রকারভেদ :
শ্রবণ সাধারণত দুই ধরনের। যেমন :
ক. উদ্দেশ্যমুখী শ্রবণ এবং
খ. নৈমিত্তিক শ্রবণ।
ক. উদ্দেশ্যমুখী শ্রবণ: উদ্দেশ্যমুখী শ্রবন হলো শ্রোতা যখন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মনোযোগ সহকারে বক্তার বক্তব্য শুনে এবং প্রত্যাশিত ও প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সংগ্রহ করে।যেমন: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শুনে এবং প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো খাতায় লিখে নেয় ।এখানে শিক্ষার্থীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিক্ষকের বক্তব্য শুনে। কারণ শিক্ষকের বক্তব্য শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করে এবং তাদেরকে মূল্যায়নের ওপর প্রভাব ফেলে।
খ. নৈমিত্তিক শ্রবণ: উদ্দেশ্যহীনভাবে আমরা যখন কারো বক্তব্য শুনি তখন সেটা হয়ে ওঠে নৈমিত্তিক শ্রবণ। প্রতিদিনই আমরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য ও কথোপকথন শুনে থাকি। এই ধরনের শ্রবণ এর ক্ষেত্রে শ্রোতার মনোযোগ প্রাথমিকভাবে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত থাকে না, কোন তথ্য সংগ্রহ করার মানসিকতা ও এখানে বর্তমান থাকে না ।যেমন: শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের বক্তব্য শোনার সময় শ্রেণীকক্ষের বাইরের কোন ঘোষণা শোনা, রাস্তাঘাটে চলার সময় অথবা কোন আড্ডায় অনেক বক্তার কথাই আমরা শুনে থাকি। তবে নৈমিত্তিক শ্রবণ কোন গুরুত্ব বহন করে না তা কিন্তু নয়। নৈমিত্তিক শ্রবণ এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করে ।যেমন: মার্কেটিং করতে যাওয়ার সময় হঠাৎ রাস্তায় শোনা গেল যে অনিবার্য কারণবশত আজ মার্কেট বন্ধ। এই তথ্যটি ওই ব্যক্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রবণ এর গুরুত্ব:
ভাষা দক্ষতাগুলো মধ্যে শ্রবণ দক্ষতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ তথ্য আমরা শ্রবনের মাধ্যমে পাই। দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রয়োজনে আমরা এ তথ্য ব্যবহার করে থাকি। অনেক সময় পড়ে তথ্য পাওয়ার সুযোগ হয় না। সে ক্ষেত্রে কারো কাছ থেকে তথ্য গুলো শুনে পাওয়ার চেষ্টা করে থাকি। তাই ভাষা দক্ষতা বিকাশে শ্রবনের গুরুত্ব অপরিসীম।
৩. শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের ভূমিকাগুলি আলোচনা করুন।
শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ অনুশীলন প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা কোর্সে ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলন আবশ্যক। কেননা প্রাথমিক স্তর শিক্ষার জন্য উত্তম সময়।
শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের ভূমিকা:
শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের সহায়তাই পারে শিক্ষার্থীর শ্রবণ দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে। তাই শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের করণীয় বিষয়গুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি: শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনের জন্য শ্রেণিকক্ষে কোলাহল মুক্ত পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুপাত নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ভাষা শিক্ষা ল্যাবরেটরী, সাউন্ড সিস্টেম, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।
২. আগ্রহ সৃষ্টি: উৎসাহ প্রদান, পুরস্কৃত করা ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রাবণের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে।
৩. আকর্ষণীয় বিষয়: শ্রবণ এর জন্য আকর্ষণীয় বিষয় নির্বাচন করতে হবে। যেমন: টেপরেকর্ডার, টেলিভিশন, গ্রামোফোন ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
৪. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের বাচনভঙ্গি ও উপস্থাপনা কৌশল: শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনের জন্য শিক্ষকের বাচনভঙ্গি ও উপস্থাপনা অর্থাৎ কণ্ঠস্বর স্পষ্ট, ও নির্ভুল উচ্চারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিক্ষকের বক্তব্য শিক্ষার্থীরা শুনে এবং অনুকরণ করে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকের উচ্চারণে যদি অস্পষ্টতা এবং ভুল থাকে তাহলে শিক্ষার্থীরা ভুল শিখবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এ ব্যাপারে শিক্ষককে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪. একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি কিভাবে শিক্ষার্থীদের শ্রেণী কক্ষের শ্রবণ অনুশীলন ও মূল্যায়ন করবেন? আলোচনা করুন।
শিক্ষার্থীর ভাষা দক্ষতার উন্নয়নে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের আন্তরিক প্রচেষ্টা, নির্ভুল উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গির শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। শ্রেণিকক্ষে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে। শিক্ষক যা করেন শিক্ষার্থীও তাই করতে এবং বলতে চেষ্টা করে।
একজন শিক্ষক হিসেবে আমি যেভাবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ অনুশীলন ও মূল্যায়ন করব তা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. শ্রুতি লিখন: আমি প্রথমে শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের বোধগম্য ও শ্রবণ উপযোগী একটি রচনা কিংবা রচনা অংশবিশেষএকবার পড়ে শোনাবো। প্রয়োজনে দুবার নির্ভুলভাবে পড়ে শোনাবো ।শিক্ষার্থীরা আমার পঠিত বিষয় শুনবে এবং নির্দেশিত কাজ সম্পাদন করবে ।রচনার মূল বক্তব্য লেখা, নির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করা কিংবা প্রশ্ন উত্তর লিখতে দিব। এরপর আমার নির্দেশিত কাজের ওপর শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা মূল্যায়ণ করব ।
২. গল্প বলা: গল্প বলার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলন করাতে পারি। শিক্ষার্থীরা গল্প শুনতে পছন্দ করে । শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠ সংশ্লিষ্ট গল্প পড়ে শোনাবো।তারপর ওই গল্পের উপর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো এতে শিক্ষার্থীরা গল্পটি মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং তাদের শ্রবণ দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
৩. বক্তৃতা: বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলন করানো যেতে পারে। নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বক্তব্য উপস্থাপনের পর অভীক্ষা প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে পারি। শিক্ষার্থীরা বক্তব্য শুনার পর কতটুকু বুঝতে পারল কিংবা প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারল কিনা সেটা পরিমাপ করবো। তবে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের নিকট আকর্ষণীয় ও বোধগম্য হতে হবে।
৪. আবৃত্তি: আবৃত্তির সাহায্যে শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ অনুশীলন করাতে পারি। ছড়া, কবিতা আবৃত্তি শিক্ষার্থীদের নিকট একটি উপভোগ্য বিষয়। বস্তুত শিক্ষার্থীরা ছড়া, কবিতা আবৃত্তি শুনে শুনেই শিখে ফেলতে পারে। তাই আমি যথাযথভাবে ছড়া, কবিতা আবৃত্তি করব এবং শিক্ষার্থীদের কে মনোযোগ সহকারে আবৃত্তি শুনতে বলব। আবৃত্তি শেষে শিক্ষার্থীরা শুনলো কি না এবং কতটুকু বুঝতে পারল তা মূল্যায়ন করব।
৫. কথোপকথন: আমি নিজে অথবা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথোপকথন বা আলাপচারীতা সৃষ্টির মাধ্যমে শ্রেণীতে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলন করতে পারি। দুজন শিক্ষার্থীর মধ্যে কথোপকথন চলবে তখন অন্য শিক্ষার্থীরা তাদের কথোপকথন শুনবে। কথোপকথন শেষ হলে অন্যদলকে প্রশ্ন করব তারা কতটুকু শুনতে পারছে । এভাবে আমি দলীয় কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতার অনুশীলন এবং মূল্যায়ন করতে পারি।
৫. শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের ভূমিকাগুলি আলোচনা করুন।
শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ অনুশীলন প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা কোর্সে ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলন আবশ্যক। কেননা প্রাথমিক স্তর শিক্ষার জন্য উত্তম সময় ।
শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের ভূমিকা:
শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের সহায়তাই পারে শিক্ষার্থীর শ্রবণ দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে। তাই শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের করণীয় বিষয়গুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি: শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনের জন্য শ্রেণিকক্ষে কোলাহল মুক্ত পরিবেশ, শিক্ষক -শিক্ষার্থীর সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুপাত নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ভাষা শিক্ষা ল্যাবরেটরী, সাউন্ড সিস্টেম, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।
২. আগ্রহ সৃষ্টি: উৎসাহ প্রদান, পুরস্কৃত করা ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রাবণের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে।
৩. আকর্ষণীয় বিষয়: শ্রবণ এর জন্য আকর্ষণীয় বিষয় নির্বাচন করতে হবে। যেমন: টেপরেকর্ডার, টেলিভিশন, গ্রামোফোন ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
৪. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের বাচনভঙ্গি ও উপস্থাপনা কৌশল: শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলনের জন্য শিক্ষকের বাচনভঙ্গি ও উপস্থাপনা অর্থাৎ কণ্ঠস্বর স্পষ্ট, ও নির্ভুল উচ্চারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিক্ষকের বক্তব্য শিক্ষার্থীরা শুনে এবং অনুকরণ করে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকের উচ্চারণে যদি অস্পষ্টতা এবং ভুল থাকে তাহলে শিক্ষার্থীরা ভুল শিখবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এ ব্যাপারে শিক্ষককে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৬. একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি কিভাবে শিক্ষার্থীদের শ্রেণী কক্ষের শ্রবণ অনুশীলন ও মূল্যায়ন করবেন? আলোচনা করুন।
শিক্ষার্থীর ভাষা দক্ষতার উন্নয়নে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের আন্তরিক প্রচেষ্টা , নির্ভুল উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গির শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। শ্রেণিকক্ষে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে। শিক্ষক যা করেন শিক্ষার্থীও তাই করতে এবং বলতে চেষ্টা করে।
একজন শিক্ষক হিসেবে আমি যেভাবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ অনুশীলন ও মূল্যায়ন করব তা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. শ্রুতি লিখন: আমি প্রথমে শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের বোধগম্য ও শ্রবণ উপযোগী একটি রচনা কিংবা রচনা অংশবিশেষএকবার পড়ে শোনাবো। প্রয়োজনে দুবার নির্ভুলভাবে পড়ে শোনাবো ।শিক্ষার্থীরা আমার পঠিত বিষয় শুনবে এবং নির্দেশিত কাজ সম্পাদন করবে ।রচনার মূল বক্তব্য লেখা, নির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করা কিংবা প্রশ্ন উত্তর লিখতে দিব। এরপর আমার নির্দেশিত কাজের ওপর শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা মূল্যায়ণ করব ।
২. গল্প বলা: গল্প বলার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলন করাতে পারি। শিক্ষার্থীরা গল্প শুনতে পছন্দ করে ।শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠ সংশ্লিষ্ট গল্প পড়ে শোনাবো।তারপর ওই গল্পের উপর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো এতে শিক্ষার্থীরা গল্পটি মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং তাদের শ্রবণ দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
৩. বক্তৃতা: বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলন করানো যেতে পারে। নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বক্তব্য উপস্থাপনের পর অভীক্ষা প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে পারি ।শিক্ষার্থীরা বক্তব্য শুনার পর কতটুকু বুঝতে পারল কিংবা প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারল কিনা সেটা পরিমাপ করবো। তবে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের নিকট আকর্ষণীয় ও বোধগম্য হতে হবে।
৪. আবৃত্তি: আবৃত্তির সাহায্যে শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ অনুশীলন করাতে পারি। ছড়া, কবিতা আবৃত্তি শিক্ষার্থীদের নিকট একটি উপভোগ্য বিষয়। বস্তুত শিক্ষার্থীরা ছড়া, কবিতা আবৃত্তি শুনে শুনেই শিখে ফেলতে পারে। তাই আমি যথাযথভাবে ছড়া, কবিতা আবৃত্তি করব এবং শিক্ষার্থীদের কে মনোযোগ সহকারে আবৃত্তি শুনতে বলব। আবৃত্তি শেষে শিক্ষার্থীরা শুনলো কি না এবং কতটুকু বুঝতে পারল তা মূল্যায়ন করব।
৫. কথোপকথন: আমি নিজে অথবা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথোপকথন বা আলাপচারীতা সৃষ্টির মাধ্যমে শ্রেণীতে শ্রবণ দক্ষতা অনুশীলন করতে পারি। দুজন শিক্ষার্থীর মধ্যে কথোপকথন চলবে তখন অন্য শিক্ষার্থীরা তাদের কথোপকথন শুনবে। কথোপকথন শেষ হলে অন্যদলকে প্রশ্ন করব তারা কতটুকু শুনতে পারছে ।এভাবে আমি দলীয় কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ দক্ষতার অনুশীলন এবং মূল্যায়ন করতে পারি।
উপরে উল্লিখিত কৌশলগুলো শ্রেণিকক্ষে প্রেরণ করে শিক্ষার্থীদের শ্রবণ এর প্রতি মনোযোগ বাড়ানো সম্ভব এবং ফলপ্রসূ করা সম্ভব ।এতে করে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শ্রবণের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে এবং পঠিত বিষয় ভালভাবে আয়ত্ত করতে পারবে।
সেশন-৪.২: ভাষাদক্ষতা: বলা
১. বলা কি? বলার বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, গুরুত্ব এবং বলার দক্ষতা বৃদ্ধির কৌশল আলোচনা করুন।
বলা: ভাষার মৌখিক রূপ হল বলা। বলা পারস্পরিক যোগাযোগের একটি প্রক্রিয়া। বলার সময় আমরা সাধারণত ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে থাকি। একজনের সাথে আরেকজনের সরাসরি যোগাযোগ ।এর মধ্যে কোন মাধ্যম থাকে না ।আবার দূরবর্তী স্থানে প্রয়োজনে আমরা টেলিফোন, রেডিও ,এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারি ।সেক্ষেত্রে টেলিফোন, রেডিও এবং টেলিভিশন মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। একজন বলার সাথে সাথেই অন্যের মনের মধ্যে উত্তর তৈরি হয়ে যায় ।বলার আগে আমাদের মাথায় চিন্তা হয় এবং সে চিন্তা প্রকাশ করতে হয় বলার মধ্য দিয়ে। বলার মধ্য দিয়ে আচরণ প্রকাশ পায় ।তাই বলা হয় কথাই মানুষের আচরণ। এর মধ্য দিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতারও প্রকাশ ঘটে। বলার বিষয়টা আসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে। বলা আমাদের চিন্তা ভাবনা এবং কল্পনার দিগন্তকে প্রকাশ করে এর মধ্য দিয়ে মানুষের ব্যক্তিত্ববোধ ফুটে ওঠে। বলা এক ধরনের সৃজনশীল প্রকাশ এবং এটি একটি শিল্প ।
বলার বৈশিষ্ট্য:
বলার বৈশিষ্ট্য চারটি। যথা:
১. বলা ভাষার একটি উৎপাদন মূলক দক্ষতা ।
২. বলার মধ্য দিয়ে আচরণ ও অভিজ্ঞতার প্রকাশ পায় ।
৩. বলা এক ধরনের শিল্প ।
৪. বলার মধ্য দিয়ে সৃজনশীলতা প্রকাশ পায় ও ব্যক্তিত্ববোধ ফুটে উঠে।
বলার প্রকারভেদ :
বলা দুই প্রকার। যথা:
১. আনুষ্ঠানিক বলা এবং
২. অনানুষ্ঠানিক বলা
১. আনুষ্ঠানিক বলা:
আনুষ্ঠানিক বলা পূর্বপরিকল্পিত ।বলার বিষয়, স্থান এবং সময় সুনির্দিষ্ট থাকে ।আমরা যখন আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে এবং প্রস্তুতি নিয়ে বলি তখন সেটা হলো বলার আনুষ্ঠানিক রূপ। কমিটি কেন্দ্রিক আলোচনা, প্যানেল আলোচনা, সংলাপ, গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার, সাক্ষাৎকার, বিতর্ক এবং রেডিও-টেলিভিশনে বলা, শ্রেণিকক্ষে বলা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক বলার বিভিন্ন রূপ ।
২. অনানুষ্ঠানিক বলা:
এ ধরনের বলার ক্ষেত্রে বিষয়, শ্রোতা ও সময় পূর্ব নির্ধারিত থাকে না। হঠাৎ কোন জায়গায় কারো সাথে আলাপ করা, পরিবারের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা, আড্ডায় বন্ধুদের সাথে অনির্ধারিত বিষয়ে আলাপচারিতা ইত্যাদি বলার অনানুষ্ঠানিক রূপ। শুধু বলার জন্য বলা। অর্থাৎ বিষয়ের ওপর পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই বলা।
বলার গুরুত্ব :
ব্যক্তির সামাজিক উন্নয়নে বলার গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজ আমাদের প্রয়োজন মেটায় ।সমাজের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য এবং সমাজকে কিছু দেওয়ার জন্য বলা প্রয়োজন। বলার মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তা ভাবনা প্রকাশ ঘটে। তাতে সমাজ যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও উপকৃত হয়। বলার মধ্য দিয়ে যে সকল তথ্যের আদান-প্রদান ঘটে তা সমাজের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান ঘটায় এবং তথ্যগতভাবে আমরা লাভবান হই। বলার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সমস্যা তুলে ধরতে পারি এবং অন্যের সমস্যার সমাধান করতে পারি। বলার মাধ্যমে আমাদের ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বুদ্ধির বিকাশের ক্ষেত্রে বলা অত্যন্ত কার্যকর ।বলার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা যায় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ।
বলার দক্ষতা বৃদ্ধির কৌশল:
১ শারীরিক দক্ষতা: শারীরিক দক্ষতা জন্মগত ।বলতে হলে প্রথমে শারীরিকভাবে সুস্থ ও ভালো থাকতে হবে। শরীর ভালো না থাকলে অথবা কণ্ঠ ভালো না থাকলে ভালো ভাবে বলা যায়না।
২. অনুশীলনের দক্ষতা: কতগুলো বিষয় অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করে একজন ভালো বক্তা হওয়া যায় এবং বলার দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়। যেমন:
ক. কণ্ঠের ব্যবহার এমন হওয়া উচিত যাতে কথাগুলো সবাই ভালোভাবে শুনতে ও বুঝতে পারে ।
খ. বলার আগে ভাবকে ঠিকমতো নির্বাচন করা এবং গুছিয়ে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বলা।
গ. এমন ধরনের শব্দ এবং বাক্য ব্যবহার করা যাতে ভাবটি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
ঘ. বলার সময় শারীরিক অঙ্গভঙ্গি যেন প্রাসঙ্গিক ও যথার্থ হয়।
ঙ. পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে বলা উচিত ।
চ. বলার সময় সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিবেচনা করা ।
ছ. প্রয়োজনবোধে উপকরণ ব্যবহার করা।
পরিশেষে বলা যায় ব্যক্তির সামাজিক উন্নয়নে বলার গুরুত্ব অপরিসীম। বলার মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তা ভাবনার প্রকাশ ঘটে। বলার মাধ্যমে আমাদের ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় ।বলার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা যায় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
২. শ্রেণিকক্ষে বলা অনুশীলনে শিক্ষকের ভূমিকাগুলো আলোচনা করুন।
বলা এক ধরণের শিল্প। এটি একটি দক্ষতা। বলা মানে বাকপটুতা নয়। বলার দক্ষতা এমনি এমনি আসে না। এর জন্য অনুশীলন করা প্রয়োজন। অনুশীলনের মাধ্যমে বলার দক্ষতা অর্জনের জন্য শ্রেণিকক্ষ একটি আদর্শ জায়গা। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বলার দক্ষতা অর্জন শিক্ষক কেন্দ্রিক।
শ্রেণিকক্ষে বলা দক্ষতা অনুশীলন শিক্ষকের ভূমিকা :
শ্রেণিকক্ষে বলার দক্ষতা অনুশীলনে শিক্ষকের যেসকল ভূমিকা রাখা উচিত সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো :
১.শ্রেণিকক্ষে আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করে প্রমিত ভাষায় কথা বলা। কারণ শিক্ষকের ভাষা শুনে এবং তাকে অনুকরণ করে শিক্ষার্থীরা ভাষা শেখে।
২. শিক্ষার্থীদের বলার জন্য শিক্ষক উৎসাহ প্রদান করবেন।
৩. শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার না করা ।
৪. শিক্ষার্থীর উচ্চারণে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া এবং সঠিক উচ্চারণে সুস্পষ্টভাবে বলতে সহায়তা করা ।
৫. গুছিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতে শেখানো।
৬. সহজ ভাষায় কথা বলতে শেখানো।
৭. বলার সময় ভাষা দূষণ যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলবেন ।
৮. শিক্ষার্থীদের বলার সময় প্রাসঙ্গিক অঙ্গভঙ্গি করতে শেখাবেন।
৩. একজন শিক্ষক কিভাবে শ্রেণিকক্ষে বলা অনুশীলন ও মূল্যায়ন করবেন ব্যাখ্যা করুন।
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সাথে সাথে তার ভাষিক বিকাশ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত ।এক্ষেত্রে বলার দক্ষতা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি পর্যায়ে তার মা-বাবা অথবা পরিবারের অন্য কারো ওপর তার দৈনন্দিন প্রয়োজন যথা- খাওয়া, ঘুমানো, খেলাধুলা করা ইত্যাদি কাজে সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে। কিন্তু যখন তার বয়স তিন থেকে চার বছর হয় তখন তাকে স্বাধীনভাবে এসব দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন- পিপাসা পেলে অথবা ক্ষুধা লাগলে তাকে বলতে হয় পানি খাবো অথবা ক্ষুদা লেগেছে ইত্যাদি ।এভাবে ক্রমান্বয়ে যখন সে আরো বড় হয় তখন তাকে তার অনেক প্রয়োজন তথা অধিকার মেটানোর জন্য যুক্তি প্রদর্শন করতে হয়। চিন্তা করতে হয়। কথা বলতে হয়। অথবা অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে হয়। এই মানসিক প্রক্রিয়া প্রকাশের জন্য শিশুকে অনেকাংশে বলা দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।
একজন শিক্ষক যেভাবে শ্রেণিকক্ষে বলা অনুশীলন ও মূল্যায়ন করবেন: একজন শিক্ষক যেভাবে শ্রেণিকক্ষে বলা অনুশীলন ও মূল্যায়ন করবেন তার কৌশল গুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. কথোপকথন: শিক্ষার্থীর মধ্যে কথোপকথন বা আলাপচারীতা সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষক শ্রেণীতে বলা অনুশীলন করতে পারেন । কথোপকথন মানে অনর্গল কথা বলা নয়। প্রত্যেক বক্তা বক্তব্যের বিষয় সম্পর্কে কিছু না কিছু বিষয়গত চিন্তাভাবনার অবদান রাখেন এবং পরস্পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কথোপকথনের সময় আলাপ কারীদের মধ্যে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
২. গল্প বলা: শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের গল্প বলতে বলবেন এবং গল্প বলার সময় শিক্ষার্থীর উপস্থাপনা, শব্দের উচ্চারণ, অঙ্গভঙ্গি, ইত্যাদি মূল্যায়ন করবেন।
৩. বক্তৃতা: বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অংশগ্রহণের মনোভাব তৈরি হয় এবং নেতৃত্বের গুণ বৃদ্ধি পায়। তবে বক্তব্যের বিষয় হবে সহজ আকর্ষণীয় ও সুনির্দিষ্ট ।
৫.আবৃত্তি : ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি শিক্ষার্থীদের নিকট একটি উপভোগ্য বিষয়।শিক্ষক সুন্দর করে চড়া কবিতা আবৃত্তি করবেন এবং শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সহকারে আবৃত্তি শুনতে বলবেন। শিক্ষকের আবৃত্তি শেষে অনুরূপভাবে শিক্ষার্থীরা আবৃত্তি করতে পারছে কিনা সেটা মূল্যায়ন করবেন।
৬. বিতর্ক : বিতর্ক হলো এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক আলোচনা। বিতর্কে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বক্তা নিজ দলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তিপূর্ণ ও তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। এতে করে বক্তার যুক্তিপূর্ণভাবে কথা বলার দক্ষতা উন্নয়ন ঘটে।
সেশন-৪.৩: ভাষাদক্ষতা: পড়া
১. পড়া কি? পড়ার বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করুন।
পড়া:
আমরা যখন কোন রচনা পড়ি তখন আসলে আমরা বিভিন্ন ধরনের ঘটনা, বস্তু, বিষয় ও তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পারি। অর্থাৎ কোনো না কোনো তথ্য পাই। আবার পড়ার মধ্য দিয়ে লেখক ও পাঠকের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। লেখক এর লেখা পড়ে পাঠক হিসেবে আমরা লেখক সম্পর্কে জানতে পারি এবং আমাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারি ।কোন রচনা পরে বুঝতে পারা কে পড়া বলে ।পড়ে রচনার অর্থ উদ্ধার করতে না পারলে পড়া হয়না ।
ডক্টর মাইকেলের ভাষায় পঠন হলো দৃশ্যত ধ্বনি উৎপাদন ও অর্থ উপলব্ধির মিলিত প্রক্রিয়া। আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রচনা পড়ি। যেমন: গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি পড়ার পর যদি আমরা পাঠের বিষয়বস্তু বুঝতে না পারি তাহলে আমাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া ঘটে না। পড়ে বুঝতে পারলে পড়া কার্যকর হয় এবং আমরা এক ধরনের পরিতৃপ্তি লাভ করি। অতএব পড়ার আসল কথা হলো রচনা পড়ে বুঝতে পারা।
পড়ার বৈশিষ্ট্য:
পড়ার বৈশিষ্ট্য চারটি। নিচে সেগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. পড়া একটি গ্রহণ মূলক ভাষিক দক্ষতা।
২.পড়া একটি শিল্প ।
৩.পড়ার সাথে মস্তিষ্ক ও দর্শনেন্দ্রিয় চোখ জড়িত।
৪. পাঠ সরব ও নিরব প্রক্রিয়া।
পড়ার উদ্দেশ্য:
পড়ার প্রধান উদ্দেশ্য দুটি। যেমন:
১. আনন্দ পাওয়ার জন্য
২. তথ্য পাওয়ার জন্য
১. আনন্দ পাওয়ার জন্য :
পাঠকের চিত্তবিনোদনই এই পাঠের মূল উদ্দেশ্য। পাঠের মধ্য দিয়ে পাঠক বিষয়বস্তুর রস আস্বাদন করে এবং পরিতৃপ্তি লাভ করে। সাহিত্য ধর্মী রচনা আনন্দলাভের জন্য পাঠের প্রধান বিষয়বস্তু। এই ধরনের পাঠে তথ্য সংগ্রহ করা মূল উদ্দেশ্য হিসেবে থাকে না ।
২. তথ্য পাওয়ার জন্য পড়া :
পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ এবং জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করা অর্থাৎ জ্ঞান অন্বেষণই এই পাঠের আসল কথা। সাধারণত প্রবন্ধ ধর্মী এবং তথ্যবহুল রচনা এই ধরনের পাঠের বিষয়বস্তু। তবে আনন্দলাভের জন্য যে পাঠ সেখানেও তথ্য পাওয়া যায়। তথ্য পাওয়ার জন্য পাঠেও আবার আনন্দ পাওয়া যায় ।এখানে পার্থক্য হল আনন্দলাভের জন্য পাঠে আনন্দলাভ মূখ্য এবং তথ্য সংগ্রহ গৌণ। অন্যদিকে তথ্য পাওয়ার জন্য পাঠে তথ্য সংগ্রহ মূখ্য এবং আনন্দলাভ গৌণ।
শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশে পড়ার গুরুত্ব অথবা প্রয়োজনীয়তা :
পঠন একটি জীবনব্যাপী চলমান প্রক্রিয়া। তাই শিশুর জন্ম থেকেই পঠনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শিশুর জীবনে পঠনের প্রয়োজনীয়তাগুলো নিম্নরূপ:
১) পঠন দক্ষতা শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং শিশুর মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করে, যা পরবর্তী জীবনে তার জীবন গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে ।
২) পঠন দক্ষতা শিশুকে বই পড়তে এবং পাঠাভ্যাস গঠনে সহায়তা করে। শিশু পাঠের প্রতি উৎসাহী হয় ।
৩) পঠন শিশুকে নিজের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী করে এবং স্বশিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে ।সমাজ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারে ।
৪) আনন্দের সাথে পাঠ করলে তথ্য অর্জনের পাশাপাশি যথেষ্ট বিনোদনও লাভ করা যায়। এই বিনোদন শিশুর জ্ঞানস্পৃহাকে বাড়িয়ে দেয় ।ফলে শিশু পাঠের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেনা।
৫) শিশুর শব্দভান্ডার বৃদ্ধির অন্যতম উপায় হলো পঠন।যত বেশি পাঠ করবে তত বেশি শব্দ ভান্ডার বৃদ্ধি পাবে।
৬) পঠনের মাধ্যমে শিশু বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ধর্ম, সমাজ ইত্যাদি বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য আহরণ করে । দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে।
৭) মনীষীদের জীবনী পঠন ও অন্যান্য বিষয় পঠনের মধ্য দিয়ে মূল্যবোধ, নান্দনিকতা, পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে শিশু পরিচিত হয় এবং এ জ্ঞান ও উপলব্ধি তার মানসিক বৃদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব গঠনের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
৮) পঠন শিশুকে সামাজিক, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী ও সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
৯) শিশুর সব বিষয়ে প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনে প্রান্তিক যোগ্যতা একটি কার্যকর মাপকাঠি ।
১০) উচ্চারণে শুদ্ধতা অর্জনের জন্য পঠন গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ।তবে এক্ষেত্রে শিশুর সরব পাঠ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায় শিশু মায়ের কোল থেকে পৃথিবীর বুকে আসার পর পিতা-মাতা, পরিবেশ থেকে যা শেখে তার চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তার পঠন।তাই পঠন শিশুর জীবনে মহৌষধ হিসেবে কাজ করে।
২. শিশুর পড়া ও লেখার শব্দ জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকের কী কী কৌশল অবলম্বন করা উচিত? আলোচনা করুন।
একটি শিশু পৃথিবীতে আসার পর পিতা-মাতা ও পরিবেশ থেকে যা শেখে তার চেয়ে বেশি শেখে পড়া ও লেখার মাধ্যমে। একটি শিশু যত বেশি শব্দ জানবে সে তত বেশি শব্দ বলতে ও লিখতে পারবে।
শিক্ষার্থীদের পড়া ও লেখায় শব্দ জ্ঞান দক্ষতা বৃদ্ধির কৌশল:
শিশুদেরকে পড়া ও লেখায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে হলে শব্দজ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে। শব্দজ্ঞান বৃদ্ধির কৌশল গুলো নিচে আলোচনা করা হলো।
১) নতুন শব্দ লেখার দক্ষতা অর্জন:
জরুরী। এজন্য শিশুকে নতুন শব্দের অর্থ বুঝতে সহায়তা করবেন। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেরাই নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে সঠিক বানানে শুদ্ধ উচ্চারণ করে সঠিক অর্থ খুঁজে বের করতে পারে সে দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবেন।
২. নতুন শব্দ শিখতে সহায়তা করা ও শব্দ তৈরি:
শিশুদের নতুন শব্দ শিখতে সহায়তা করার একটি কার্যকর পদ্ধতি হল শব্দের মূল অংশ চিনতে সহায়তা করা। এক্ষেত্রে প্রথমদিকে শিশুর পরিচিত শব্দ থেকে কোন একটির মূল অংশ ব্যবহার করে নতুন শব্দ তৈরি করার খেলার ব্যবস্থা করতে হবে । যেকোনো একটি শব্দের প্রথম অক্ষর কিংবা শেষের অক্ষর দিয়ে নতুন শব্দ তৈরীর খেলার মাধ্যমে শিশুদের কে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে।
৩) প্রাসঙ্গিক ধারণার ব্যবহার:
কোন শব্দ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক ধারণা দিয়ে এর অর্থ বুঝানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অপরিচিত শব্দ শিখতে সহায়তা করা যায়। যেমন: কোন পাঠে স্থানান্তর শব্দটি প্রথমবার পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের সাথে প্রাসঙ্গিক আলোচনার প্রয়োজন। এর অভিধানিক অর্থ কোন কিছুর অবস্থানের পরিবর্তন। অর্থাৎ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া। কিন্তু শিশুর কাছে প্রথম অবস্থায় শব্দটি নিরর্থক হবে যতক্ষণ না সে এর প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারে ।তাই শব্দটির অর্থ বোঝাতে সহজ উদাহরণ বা বাস্তব প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করলে তার শিখনে সহায়তা হবে। নতুন শব্দজ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ধারণা দিয়ে শেখানোর পদ্ধতি শব্দভান্ডারে নতুন শব্দ গঠনে খুবই সহায়ক। তবে কেবল একটি পদ্ধতি নতুন শব্দজ্ঞান শেখানোর জন্য যথেষ্ট নয়। শব্দ ভান্ডারে নতুন শব্দ সংযোজন তখনি কার্যকর হবে যখন অনেকগুলো পদ্ধতির সমন্বয়ে তা শেখানো হবে।বিভিন্ন পদ্ধতিতে শেখানো হলে শিখনের পুনরাবৃত্তি সুযোগ ঘটে। ফলে তা যথাযথভাবে শিশুর মস্তিষ্কের স্থায়ী হয় যা তারা পরবর্তীতে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারে।
৪) একই শব্দ খুঁজে বের করা:
যেকোনো নতুন শব্দ মাত্র একবার পড়ে মনে রাখা খুবই কঠিন। শিশুরা নতুন শব্দ ভালোভাবে শিখতে পারে যদি সেটি পড়ালেখার সময় বারবার শব্দটির ব্যবহার দেখে নিজে ব্যবহারের সুযোগ পায় ।যেমন: কোন একজন বিশেষ ব্যক্তির, বিশেষ বস্তুর নাম পড়ানোর সময় ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারেন, সংশ্লিষ্ট উপকরণের ব্যবহারের মাধ্যমে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের নিকট আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করেন তবে শব্দটি শিক্ষার্থীর মনে রাখা অত্যন্ত সহজ হবে । অথবা যে কোন বিষয়ের পাঠদান করার সময় যদি অপরিচিত শব্দগুলো শনাক্ত করে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ক্যালেন্ডার হিসেবে তৈরি করে রাখা যায় তবে শিশুর অপরিচিত শব্দটি বারবার দেখার সুযোগ হবে। শিক্ষার্থীর শব্দজ্ঞান বৃদ্ধিতে এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত কার্যকর।
উপরে উল্লেখিত কৌশলগুলো অবলম্বন করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান দিলে অবশ্যই শিক্ষার্থীর পড়া ও লেখার জন্য শব্দজ্ঞান বৃদ্ধি পাবে এবং শব্দ জ্ঞান বৃদ্ধিতে তারা আগ্রহী হবে।
সেশন-৪.৪: ভাষাদক্ষতা: লেখা
১. প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ভাষা দক্ষতা অর্জনে লেখার ভূমিকা কি? শিক্ষার্থীদের লিখন শিখনে শ্রেণীতে আপনার করণীয় কি কি ব্যাখ্যা করুন।
লেখা ভাষার একটি স্থায়ী রূপ। বিশ্বের প্রতিটি ভাষার লেখ্য রূপ রয়েছে। মানুষ লেখার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে এবং যোগাযোগ করে থাকে। লিখিত বক্তব্য লেখকের অনুপস্থিতিতেও পড়ার সুযোগ থাকে। গুণগত মানসম্পন্ন লেখা পাঠক মনের আনন্দে পড়ে। এবং লেখাটিও দীর্ঘদিন ঠিকে থাকে।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ভাষা দক্ষতা অর্জনে লেখার ভূমিকা:
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ভাষা দক্ষতা অর্জনের লেখার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –
১. লেখার নিয়মিত অনুশীলন শিশুর মাংসপেশির সঞ্চালনে সহায়তা করে।
২. বিমূর্ত ধ্বনিকে মূর্ত করে তুলে।
৩. সঠিকভাবে বর্ণ ও যুক্তবর্ণ লিখতে এবং যথাযথ যতিচিহ্ন ব্যবহার করতে সহায়তা করে।
৪. সঠিক আকৃতিতে কার, ফলা চিহ্ন লিখতে সহায়তা করে।
৫. শুদ্ধ বানান আয়ত্ত করতে সহায়তা করে।
৬. হাতের লেখা শিশুর ভাষাজ্ঞানের বিকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
৭. লেখা শিশুর মনের ভাবনা কে প্রকাশ করতে সহায়তা করে।
৮. লেখা শিশুকে ভাষার কাঠামোগত বিন্যাসের প্রতি সচেতন করে তুলে।
৯. হাতের লেখা শিশুর চিন্তা কল্পনা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে।
১০. সাধু ও চলিত রীতিতে ভাষা অনুশীলনে ক্রমাগত সহায়তা করে।
১১. শিশুর পরিচ্ছন্ন রুচি বোধের বিকাশে লেখা সহায়তা করে ।
১২. লেখার মাধ্যমে শিশুর দেহমন সমন্বিতভাবে কাজ করে, ফলে শিশুর একাগ্রতা ও মনোনিবেশের শক্তি বাড়ে।
১৩. লেখা শিশুর মধ্যে সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করে।
১৪. লিখিত বিষয়বস্তু স্মৃতিতে ধারণ করা সহজ হয়।
১৫. লেখা শিশুকে ভাবের আদান-প্রদান বা অন্যের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে সহায়তা করে।
১৬. লেখা শিশুকে কোন বিষয়বস্তুর মর্ম অনুধাবন করে নিজের ভাষায় লিখতে সহায়তা করে।
১৭. লেখা শিশুকে কোন গল্প বা কবিতার আলোকে নতুন কোনো গল্প বা কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে ।
১৮. লেখার মাধ্যমে যাচাই করা যায়।
শিক্ষার্থীদের লিখন শিখনে শ্রেণীতে আমার করণীয়:
শিক্ষার্থীদের লিখন শিখনে শ্রেণীতে আমার করণীয় বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
১. লেখার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে ।
২.শিক্ষার্থীদের নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ দিতে হবে ।
৩. শিক্ষকের ওপর নির্ভরশীল না করে শিক্ষার্থীদের নিজের প্রতি আস্থাশীল করে গড়ে তুলতে হবে।
৪.পঠন এর উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
৫. লেখার কৌশল তথা শ্রুতলিপি, বানান লেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ।
৬. সঠিক প্রবাহে বর্ণ লিখতে পারছে কিনা যাচাই করতে হবে ।
৭.ধারণাকে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে সহায়তা করতে হবে ।
৮.বারবার লিখতে দিতে হবে ।
৯. শিশুদেরকে ইচ্ছেমতো আঁকিবুকি করতে দিতে হবে।
১০. শিশুদেরকে সৃজনশীল লেখার প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে।
১২. শিশুর প্রাক লিখন দক্ষতা উন্নয়নের স্তর সমূহ বর্ণনা করুন।
শিশুর প্রাক লিখন দক্ষতা উন্নয়নের স্তরসমূহ নিম্নরূপ:
১. আঁচড় কাটা বা হিজিবিজি আঁকার মধ্য দিয়েই একটি শিশুর লেখা শুরু হয়। তারপর সে দাগ টানতে শুরু করে । ১৮ মাস বয়স থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে দাগ টানার সামর্থ্য অর্জন করে থাকে।
২. দুই বছর বয়স থেকে শিশু আনুভূমিকভাবে পাশাপাশি রেখা টানার পূর্বে উপর নিচে দাগ টানতে শুরু করে। আড়াই বছর পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। তিন বছর বয়স থেকে শিশু গুলা কার গোলাকার দাগ দিতে সমর্থ হয়।
৩. সাড়ে তিন বছরে শিশুরা দেখে দেখে পর্ব আঁকতে চেষ্টা করে। তখন তারা ডট দিয়ে আঁকা কোন চিত্র দেখে আঁকার চেষ্টা করে। যদিও এক্ষেত্রে তাদের আঁকা চিত্রের কোণগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৃত্তচাপের মত ঘুরানো রূপ লাভ করে ।
৪. যোগ চিহ্ন দেওয়ার সামর্থ্য অর্জিত হয় শিশুর ৪ বছর বয়সে। সুচারুভাবে না হলেও তখন থেকে শিশুরা অনুসরণ করে বর্গ, ত্রিভুজ আঁকতে পারে। ৫ বছর বয়সের আগেই সে সাধারণভাবে বর্গক্ষেত্র আঁকতে পারে এবং চিহ্ন দেওয়া ডায়মন্ড আকৃতির দাগ টেনে সম্পূর্ণ করতে পারে।
৫. পরবর্তী এক বছরের মধ্যেই শিশুরা লেখার অনেক দক্ষতা অর্জন করে এবং সমর্থ হয়ে ওঠে ।এর মধ্যে দিয়েই শিশুরা দিরেদিরে বর্গ আঁকতে ও লেখার দক্ষতা অর্জনের পথে পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
৩. লেখার উপদক্ষতাগুলো বর্ণনা করুন।
লেখার উপদক্ষতা:
লেখার উপর উপদক্ষতা বলতে আমরা বুঝি –
১) লেখার কলাকৌশল,
২) বর্ণ জুড়ে লেখা বাক্য,
৩) বাক্য লেখা
৪) অনুচ্ছেদ লেখা ইত্যাদি।
১) লেখার কলাকৌশল:
নিচে লেখার কলাকৌশল গুলো আলোচনা করা হলো:
ক. পেন্সিল নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা: যেসব শিশু আদৌ লিখতে শিখে নিয়ে তাদের বর্ণ লেখা শেখানোর পূর্বেই পেন্সিল বা কলম কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তা শেখানো অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে কলমের চেয়ে পেন্সিল ভালো হয়। পেন্সিল ব্যবহারের আগে শ্রেণীতে বা শ্রেণীর বাইরে কাঠি দিয়ে, আঙ্গুল দিয়ে খাতায় বা মাটিতে বর্ণের গঠন বা প্যাটার্ন আঁকতে সহায়তা করা উচিত।
খ. সঠিকভাবে পেন্সিল ধরা : উত্তম লেখা অনেকাংশে নির্ভর করে সঠিক ভাবে পেন্সিল ধরার উপর। তাই লেখা কিভাবে ভালো করতে হয় তার জন্য পেন্সিল ধরার কৌশল ও শিশুকে শেখানো প্রয়োজন।
গ. প্যাটার্ন বা আকৃতি আঁকা: বর্ণ লেখার পূর্বেই খাতায় প্যাটার্ন বা আকৃতি আঁকা শেখানো আবশ্যক ।কারণ সাবলীলভাবে পেন্সিলের গতি নিয়ন্ত্রণে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
২) বর্ণ জুড়ে লেখা:
শব্দ তৈরীর সময় বর্ণগুলোকে এলোমেলো করে দেওয়া হয়। উদাহরণ: বল শব্দ লিখতে লব কলা শব্দ লিখতে লাক লিখে দেওয়া হল। শিশুকে তা সাজিয়ে লিখতে হবে।
৩) বাক্য লেখা:
বাক্যস্থিত শব্দগুলোকে প্রথমে এলোমেলো করে লিখতে হয় এরপর তাদের সঠিক ভাবে সাজিয়ে বাক্য তৈরি করতে বলা হয়। যেমন: ভাত আমি খাই, জরিনা খেলে পুতুল।
বাংলা ভাষায় বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৈচিত্র বর্তমান ।তাই বাক্য বিন্যাসের প্রান্তিকরূপটি প্রাথমিকভাবে পরিহার করে পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত সহজ রূপটি অনুসরণ করতে হবে।
৪) অনুচ্ছেদ লেখা :
অনুচ্ছেদ সব সময় একটি প্যারায় লিখতে হবে। তথ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে একটি মাত্র প্যারাতে এটি লেখা হয়। একই তথ্যের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ১০-১২টির বেশি বাক্য না লেখাই বাঞ্ছনীয়।
৪. অনুচ্ছেদ লেখা শেখানোর কৌশল ও কতিপয় নিয়মগুলো লিখুন ।
অনুচ্ছেদ লেখা শেখানোর কৌশল: শিশুদের অনুচ্ছেদ লিখন এ সহায়তা করার জন্য শিক্ষককে কতিপয় কৌশল অবলম্বন করতে হয় । সেগুলো নিম্নরূপ:
১. বোর্ডে কোন বিষয়ের মূল শব্দ লেখা।
২ বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত শব্দগুলো কি হতে পারে তা শিশুদের সাথে আলোচনা করে নির্ধারণ করা ।
৩.আলোচনা করে প্রয়োজনে শিশুদের দিয়ে শব্দ গুলো বোর্ডে লেখা।
৪.বোর্ডে শব্দগুলি পর্যায়ক্রমে লেখা।
৫. শিশুদের অপরিচিত শব্দ বা প্রতিশব্দ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া ।
৬. শিশুদের পছন্দমত অনুচ্ছেদ লিখতে বলা।
৭. প্রত্যেকের লেখার ওপর ফলাবর্তন দেওয়া। যেমন: বানান, ভাষা, ধারণা, তথ্য ইত্যাদি।
৮. পুনরায় লিখতে দেওয়া।
৯ নিরীক্ষণ করা ও মন্তব্য প্রদান করা।
অনুচ্ছেদ লেখার নিয়ম:
অনুচ্ছেদ লেখার নিয়মগুলো নিম্নে দেওয়া হল:
১. একটিমাত্র প্যারায় লিখতে হবে ।
২. তথ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।
৩. একই তথ্যের পুনরাবৃত্তি করা যাবেনা।
৪. ১০-১২ টির বেশি বাক্য লেখা যাবে না।
৫. লেখার দক্ষতা উন্নয়নে নিয়ন্ত্রিত লিখন, নির্দেশিত লিখন, ও মুক্ত লিখন সম্পর্কে আলোচনা করুন।
১. নিয়ন্ত্রিত লিখন:
এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সম্পূর্ণ লেখাটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেমন- এমন একটি শব্দ বা বাক্য লিখতে দিয়ে তা অনুশীলন করানো, কতগুলো নির্দিষ্ট শব্দ দ্বারা শূন্যস্থান পূরণ করতে দেওয়া, কতগুলো সুনির্দিষ্ট তথ্য জানার জন্য কতগুলো প্রশ্ন ও উত্তর লিখতে দেওয়া, এলোমেলো শব্দ সাজিয়ে লিখতে দেওয়া ইত্যাদি। শব্দ ও বাক্যে সাজিয়ে লিখতে দেওয়া, হাতের লেখা ইত্যাদি। এতে বর্ণের বণ্টন শব্দ ও বাক্যের কাঠামো ও বানানের শুদ্ধতা আনয়নে সহায়তা করে।
২. নির্দেশিত লিখন :
এরূপ লিখনে শিক্ষার্থীকে কিছু সূত্র দিয়ে দেওয়া হয়। যেন সে সূত্র ধরে কিছু লিখতে পারে। যেমন- বাক্য সম্পূর্ণ করুন, ছবি দেখে বর্ণনা করা, নির্দিষ্ট বাক্য কাঠামো ব্যবহার করে অনেকগুলো বাক্য তৈরি করা, কোন প্রশ্ন ঘুরিয়ে করা ইত্যাদি।এরূপ লিখন এর সাহায্যে সাধারণত কিছু তথ্য সরবরাহ করা হয় কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয় বিধায় এরূপ লিখনকে নির্দেশিত লিখন বলে।
৩. মুক্ত লিখন:
কোন একটি বিষয় বা বস্তুর উপর শিক্ষার্থী নিজের মতো করে মনের ভাব বুঝিয়ে লিখবে। শিক্ষক শুধু লেখার সূত্র ধরে দিবেন কিসের উপর লেখা।এতে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতার বিকাশ লাভ করে।অনুচ্ছেদ লিখন, চিঠি লিখন, গল্প লিখন, রচনা লিখন, কোন কিছুর বর্ণনা, ব্যাখ্যাকরণ, তুলনাকরণ, বিশ্লেষণকরন ইত্যাদি এরূপ লেখার উদাহরণ।