বাংলা : ভাষাক্ষদক্ষতা বিকাশ
প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ
আলোচ্য বিষয়:
- ভাষাদক্ষতার বিকাশ বলতে কী বুঝায়?
- ভাষাদক্ষতা বিকাশের কৌশল ব্যাখ্যা করুন।
- শোনার দক্ষতা বিকাশের কৌশল বর্ণনা করুন।
- বলার দক্ষতা বিকাশের কৌশল বর্ণনা করুন।
- পড়ার দক্ষতা বিকাশের কৌশল বর্ণনা করুন।
- লেখার দক্ষতা বিকাশের কৌশল বর্ণনা করুন।
- শিক্ষার্থীর ভাষাদক্ষতার বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকা বর্ণনা করুন।
প্রশ্ন: ভাষাদক্ষতার বিকাশ কী?
ভাষাদক্ষতা অর্জনে (Language acquisition) শ্রেণিকক্ষে শোনা, বলা, পড়া ও লেখার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দক্ষতাগুলো আয়ত্ত করার জন্য পর্যায়ক্রমে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ভাষা শেখানোর জন্য শ্রেণিকক্ষে প্রথমে শিশুকে ভাষা শুনতে দিতে হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের বলতে দিতে হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ভাষার লিখিত রূপ পড়তে দিতে হয়। চতুর্থ পযায়ে শিশুকে লিখতে দিতে হয়। এভাবেই শোনা, বলা, পড়া ও লেখা অনুশীলনের মাধ্যমে শিশুরা ভাষা শেখার কাজটি করে। এজন্য ভাষাদক্ষতা অনুশীলনে বেশি জোর দিতে হয়। কোনো শিশুর যোগাযোগ ও বিকাশের ক্ষমতার জন্য ভাষাদক্ষতা অপরিহার্য। এই দক্ষতাগুলোই শিশুকে তার চারপাশের লোকজন, পরিবেশ ও শ্রেণিকক্ষে যোগযোগ করতে সহায়তা করে। ভাষাদক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে শিশু কতগুলো শব্দ নিয়মানুযায়ী একত্র করে মনের ভাব ও অনুভূতি বলে বা লিখে প্রকাশ করে।
প্রশ্ন: ভাষাদক্ষতা বিকাশের কৌশল ব্যাখ্যা করুন।
ভাষাদক্ষতা অর্জনের জন্যে শিক্ষার্থী ভাষার ৪টি দক্ষতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। অর্থাৎ শোনা, বলা, পড়া ও লেখার দক্ষতা বিকাশের জন্যে বিভিন্ন ধরণের কৌশল প্রয়োগ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হল:
১) শোনার দক্ষতা বিকাশের কৌশল:
শোনার দক্ষতা অর্জনের যে প্রক্রিয়াগুলো রয়েছে তার বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করার জন্য আমাদের অবশ্যই কথ্য ভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা দরকার, যা লেখার দক্ষতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো একটি লেখা বার বার পড়ে তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়; কিন্তু কোনো কথা একবার বলা হয়ে গেলে তা আর শোনার উপায় থাকে না। সুতরাং শ্রোতাকে অবশ্যই বক্তার কথা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে তার অর্থ বুঝে নিতে হবে।
আলাপচারিতা অথবা কোনো কথা বলার সময় শ্রোতা যেন সে কথার তাৎক্ষণিকভাবে মর্মোদ্ধার করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য শিশুদের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে সক্ষম করে তোলা যেতে পারে। একজন বলবে, অন্যজন তা শুনে লিখবে, আর দুজন তা পরিমার্জন করবে, এভাবে যদি ধারাবাহিকভাবে শিশুদের কাজ দেওয়া যায় তাহলে এ ধরনের কাজ থেকে শিশুরা অবশ্যই শোনা দক্ষতার উন্নয়ন করতে সক্ষম হবে। এ প্রেক্ষিতে নিচের কাজগুলো বিশেষভাবে অনুশীলন করা যেতে পারে
- আদেশ/ নির্দেশ পালন করতে দিয়ে।
- গল্প/গল্পের অংশ শুনিয়ে প্রশ্ন করে তার উত্তর বলতে ও লিখতে দিয়ে।
- সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে প্রশ্ন করতে দিয়ে।
- নাটিকা ও নাট্যাংশ শুনিয়ে বা দেখিয়ে প্রশ্ন করে তার উত্তর বলতে ও লিখতে দিয়ে।
- রেডিও, টিভি ও ক্যাসেট শুনিয়ে প্রশ্ন করে তার উত্তর বলতে ও লিখতে দিয়ে।
- কথোপকথন/ বক্তৃতা শুনিয়ে প্রশ্ন করে তার উত্তর বলতে ও লিখতে দিয়ে।
- কোনো কিছু শুনিয়ে তার উপর কোনো কাজ সম্পাদন করতে দিয়ে।
২) বলার দক্ষতা বিকাশের কৌশল:
শিশুকাল থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা দিয়ে শিক্ষার্থীর বলার দক্ষতার উন্নয়ন সাধন করা যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে পর্যাপ্ত সহায়তা দেবেন। যেমন- শিক্ষার্থী যদি পূর্ণবাক্যে অথবা অর্থবহভাবে কোনো কথা না বলে তাহলে অর্থবহভাবে কথাটি বলে দেবেন। তবে ভুল সংশোধনের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ভুল শব্দ, বাক্য শুদ্ধভাবে পুনরায় বলবেন। প্রসঙ্গ বহির্ভূতভাবে কোনো শব্দ ব্যবহার করা হলে প্রসঙ্গ অথবা ক্ষেত্রটি উল্লেখ করবেন। বলার দক্ষতা অর্জনের কতিপয় কৌশল:
- প্রশ্ন করতে ও উত্তর বলতে দিয়ে
- ছবি/চিত্রের বিষয়বস্তু বলতে বা প্রশ্ন করে উত্তর বলতে দিয়ে
- গল্প শুনে বলতে দিয়ে
- গল্পভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর বলতে দিয়ে
- ছবি সাজিয়ে গল্প বলতে দিয়ে
- ছবি দেখে সংলাপ বলতে দিয়ে
- অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে দিয়ে
- নির্দেশ প্রদান করতে দিয়ে
- ছড়া/কবিতা আবৃত্তি করতে দিয়ে
- নিজের সম্পর্কে বলতে দিয়ে
- ধারাবাহিক গল্প বলতে দিয়ে
- উপস্থিত বক্তৃতা করতে দিয়ে
- নির্ধারিত বক্তৃতা করতে দিয়ে
- উপস্থাপন করতে দিয়ে
- খবর পাঠ করতে দিয়ে
৩) পড়ার দক্ষতা বিকাশের কৌশল:
ভাষার চারটি দক্ষতার মধ্যে শোনা ও পড়া গ্রহণমূলক (Receptive skills) এবং বলা ও লেখা প্রকাশমূলক দক্ষতা (Productive skills) । শুনে ও পড়ে আমরা সাধারণত তথ্য গ্রহণ করি। আর বলে ও লিখে আমরা গৃহীত তথ্য প্রকাশ করি। গ্রহণমূলক দক্ষতা অর্থাৎ শোনা ও পড়া দক্ষতা শেখানোর তিনটি পর্যায় রয়েছে;
- শোনা/পড়ার আগের কৌশল : এই পর্যায়ে শিক্ষক পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি বা শিরোনাম দেখিয়ে ছড়া বা কবিতা বা গল্পটি কী সম্পর্কে লেখা তা অনুমান (prediction) করতে দিতে পারেন।
- শোনা/পড়ার সময়ের কৌশল : এই পর্যায়ে শিক্ষক শোনা/পড়ার সময় পাঠটি সম্পর্কে সাধারণত ধারণা পাওয়ার জন্য পাঠের কিছু প্রশ্ন বা কথোপকথন বা মজার কোনো অংশ দিতে বা উল্লেখ করতে পারেন। শ্রুত/পঠিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়ার জন্য পাঠে দ্রুত চোখ বুলিয়ে যাওয়া (skimming) একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সাধারণত পাঠ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা নিতে ও গুরুত্বপুর্ণ জায়গা খুঁজে বের করতে এটি সরব পাঠের আগে করা হয়।
- শোনা/পড়ার পরের কৌশল: এই পর্যায়ে শিক্ষক পাঠটির মূল ধারণা বা বোধগম্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু প্রশ্ন বা আলোচনার ব্যবস্থা করতে পারেন। নীরব পাঠের সময় কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে (scanning) ক্ষেত্রেএটি করা হয়। এক্ষেত্রে তিন ধরনের প্রশ্ন করা হয়; সরাসরি উত্তর প্রশ্ন (Literal question), বিকল্প উত্তর প্রশ্ন (inferential question) ও মুক্ত উত্তর-প্রশ্ন (open ended question)।
প্রকাশমূলক দক্ষতা অর্থাৎ বলা ও লেখা শেখানোর কৌশল আলাদা। বলার ক্ষেত্রে জোর দিতে হয় সঠিকভাবে ধ্বনি, শব্দ ও বাক্যের উচ্চারণ বা সাবলীলতায়। আর লেখার ক্ষেত্রে জোর দিতে হয় নিয়ন্ত্রিত, নির্দেশিত ও মুক্ত লেখা।বলার দক্ষতার বিকাশে অনুশীলন জরুরি। এই অনুশীলন একাকী, জোড়ায় ও দলে হতে পারে। ধ্বনি, শব্দ ও বাক্য অনুশীলনের প্রতিটি পর্যায়েই হতে পারে। যেমন, বর্ণ ও শব্দ উচ্চারণ, ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি, গল্প বলা ইত্যাদি।
৪) লেখার দক্ষতা বিকাশের কৌশল:
লেখার দক্ষতা বিকাশের তিনটি পর্যায় আছে। যেমন-
- নিয়ন্ত্রিত লেখা : শিক্ষক নিয়ন্ত্রিতভাবে পূর্বনির্ধারিত বর্ণ বা শব্দ লিখতে বলতে পারেন। যেমন, নিয়ম মেনে বর্ণ লেখা ও শূন্যস্থান পূরণ করতে দেওয়া (আমি ভাত খাই)। নিয়ন্ত্রিত লেখা শুদ্ধতার জন্য করা হয়।
- নির্দেশিত লেখা : শিক্ষার্থী অনেকটা স্বাধীনভাবে বর্ণ বা শব্দ লিখতে পারে। যেমন, বর্ণ লেখা ও শূন্যস্থান পূরণ করতে দেওয়া (আমি ভাত —, এখানে খাই, চাই হতে পারে)। আবার শিক্ষক কোনো ছবি দেখিয়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট বাক্য কাঠামো অনুসরণ করে কয়েকটি বাক্য লিখতে দিতে পারেন।
- মুক্ত লেখা : শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে শব্দ ও বাক্য লিখতে পারে। কোনো একটি গল্প বা কবিতা পড়ানোর পর এটি নিজের ভাষায় বর্ণনা লিখতে দিতে পারেন। আবার গল্প বা কবিতার নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রের জায়গায় তুমি হলে কী করতে? এমন প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিতে পারেন।
প্রাথমিক স্তরে লেখার দক্ষতা বিকাশের উল্লিখিত তিনটি পর্যায় অনুসরণ করে মূলত প্রাক-লিখন ও বর্ণ লেখা, বর্ণ যুক্ত করে শব্দ লেখা, শব্দ সাজিয়ে বাক্য লেখা ও অনুচ্ছেদ লেখার কাজগুলো করা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন: শিক্ষার্থীর ভাষাদক্ষতা বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকা বর্ণনা করুন।
শিক্ষার্থীর ভাষাদক্ষতা বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকা:
- প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুর বয়স অনুযায়ী ভাষার বিকাশের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। এই স্তরে ভাষাদক্ষতা শোনার ও বলার দক্ষতা উন্নয়নে জোর দিতে হবে।
- প্রাথমিক স্তরের প্রারম্ভিক পর্যায়ে (প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি) ভাষাদক্ষতা শোনা ও বলার প্রতি জোর দিতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে পড়া ও লেখার প্রতি জোর দিতে হবে।
- প্রাথমিক স্তরের শেষের দিকে গ্রহণমূলক ভাষাদক্ষতা বা শোনার ও পড়ার সঙ্গে প্রকাশমূলক ভাষাদক্ষতা বা বলার ও লেখার সমন্বয় করতে হবে।